তিতলির বয়স কত হবে? সাড়ে পাঁচ কিংবা ছয়ের মতো। বড়ো নামকরা এক স্কুলে কিছুদিন হল ভর্তি হয়েছে। খুব স্মার্ট। মনে খুব দয়া। যখন আরও একটু ছোটো ছিল তখনই সে বেড়াল, কুকুর, পাখিদের খেতে দিত। আর ওদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলত। ফলে অন্যদের থেকে ও একটু বেশি পশুপাখিদের হাবভাব বুঝতে পারত। একদিন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। রেনকোর্ট পরে স্কুলে যাবে এমন সময় কানে ম্যাঁও আওয়াজ আসতেই বুঝতে পারল ধারে কাছে কোথাও একটা ছোট্ট বেড়ালছানা একা আছে। সঙ্গে যে আন্টি ছিল তাকে বলল, দেখো তো, বেড়ালছানাটা কোথা থেকে আওয়াজ করল?
আন্টি তো অবাক! এখন তাড়াতাড়ি চলো। স্কুলের বাস চলে গেলে আমায় বকুনি খেতে হবে।
তিতলির মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। বলল, আর এক মিনিট দেখো না।
আন্টি কী আর করে? ভাগ্য ভালো পাঁচিলের এক কোণে বেড়ালছানাটাকে দেখতে পেয়ে গেল। তিতলি ও দেখতে পেয়েছিল। বলল, কী ছোট্ট! কী মিষ্টি! ও একা কেন? ওর মা কোথায়? আন্টিকে বলল, তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও। আমি স্কুলবাসে উঠে পড়ছি।
আন্টি বলল, দাঁড়াও। মনে হয় ও এখানেই থাকবে। ও ওর মাকে ডাকছে। মাকে না পেলে কোথাও যাবে না। তোমাকে স্কুলবাসে বসিয়ে আমি বাড়িতে নিয়ে যাব। তুমি স্কুল থেকে এসে ওকে দেখতে পাবে।
তিতলি শুনে বলল, ঠিক আছে। মাকে বলে ওকে একটু দুধ খাইয়ে দিও।
স্কুল থেকে এসেই তিতলি বসে পড়ল বেড়ালছানাটার সঙ্গে গল্প করতে। বেড়ালছানাটাও ওকে খুব তাড়াতাড়ি মেনে নিল। তিতলি ওকে ভাত-মাছ চটকে মেখে খেতে দিল। এতো ছোট্ট বেড়ালছানা আগে এসব তো খায়নি। তিতলির দিকে তাকিয়ে মিঁউ মিঁউ করতে লাগল। আর ছোট্ট লালচে জিভ দিয়ে খাবারটা চাটতে লাগল। তিতলির মা তো এসে দেখে অবাক। তিতলিকে বলল, এ কী করছ? ওকে এভাবে খেতে দিলে খেতে পারে? আন্টিকে বলো আর একবার দুধ খাইয়ে দেবে। আর শোনো, ওকে এত ছোটো অবস্থায় রাখা যাবে না। ওর অসুখ হলে কে দেখবে? ওর মাকে খুঁজে বের করে কাল সকালে দিয়ে দিতে হবে।
তিতলি বলল, ওর মাকে কোথায় পাবো?
তিতলির মা বলল, সে দেখা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে হোমটাস্কগুলো করে নাও।
বেড়ালছানাটা অল্পসময়েই তিতলিকে বেশ চিনে গেছে। গুটিগুটি পায়ে ওর পাশে বসে মিঁউ মিঁউ করে বলল, আমার সঙ্গে কথা বলবে না। কী করছো?
তিতলি বলল, দাঁড়া। একটু পড়ে নিই, তারপর গল্প করব। দেখলি না মা পড়তে বলে গেল।
এদিকে বেড়ালছানাটা মিঁউ মিঁউ করে আবার বলে উঠল, খিদে পাচ্ছে। আমি তো ঘুমিয়ে পড়ব।
তিতলি আন্টিকে ডেকে একটু দুধ দিতে বলল।আন্টি দুধ এনে ওকে চামচে করে হাঁ করে খাওয়াতে লাগল। বেড়ালছানাও চুকচুক করে দুধ খেয়ে মিঁউ মিঁউ করে বলল, পেট ভরে গেছে। এবার ঘুমাই।
তিতলি হেসে বলল, ঘুমাও। কী আর করবে? আমার এখন কত কাজ।
এদিকে বেড়ালছানা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতও হয়ে আসছে। বাবা অফিস থেকে ফিরবে ফিরবে করছে। এমন সময় একটা মেনি বেড়ালের আওয়াজ শুনে তিতলি চমকে ওঠে। কেমন যেন করুণ স্বরে ম্যাঁও-ম্যাঁও করে ডাকছে। এই আওয়াজে এত করুণ সুর কেন? তখনই তিতলির মা তিতলিকে বলল, শুনছো। ওর মা ওর বাচ্চাকে খুঁজে না পেয়ে কেমন করে কেঁদে কেঁদে ডাকছে।
তিতলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওর মা কী করে জানলো যে ওর বাচ্চা আমাদের এখানে আছে?
তিতলির মা তিতলিকে কাছে টেনে বলল, ওরা ঠিক গন্ধ পায়। তাছাড়া নিজের বাচ্চাকে কত আকুল হয়ে খুঁজছে। এখন ঠিক খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না বলে কাঁদছে। ওর মাকে ওর বাচ্চাকে দিয়ে দাও।
তিতলি ধীর গলায় বলল, মা, বাচ্ছাটাতো ঘুমোচ্ছে। তাছাড়া রাত হয়ে আসছে। কোথায় যাবে? বরং কাল সকালে দেব।
তিতলির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওর মা বলল, দ্যাখো এতক্ষণ ধরে ওর মা কত কষ্ট পেয়েছে। আর কষ্ট দিও না। সারারাত ধরে ম্যাঁও-ম্যাঁও করে ডেকে ডেকে আরো কত কষ্ট পাবে বলো তো? তার চেয়ে ওর বাচ্চাকে পেলে ওর মাও শান্তি পাবে। বাচ্চাটাও খুশি হবে। মনে আছে, একবার তোমার বয়স তখন তিন-সাড়ে তিন হবে। মেলায় তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে। মেলার কাকুরা তোমাকে পেয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। এদিকে আমি আর তোমার বাবা তো পাগলের মতো তোমায় খুঁজছি। খুঁজে না পেয়ে বুকের ভিতরে কী যে কষ্ট হচ্ছিল ভাবলে এখনও কষ্ট হয়। তারপর তো একসময় হাঁউমাঁউ করে কাঁদছিলাম। সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তোমায় দেখেছে কি না? মাত্র আধ ঘন্টা তাতেই আমার কী অবস্থা! ওদিকে তুমিও কাঁদছিলে।
মেলার কাকুরা তোমাকে লজেন্স চকলেট দিয়ে ভুলিয়ে তোমার নাম জানতে পেরে যখন মাইকে ঘোষণা করল তখন আমি ধাতস্থ হয়েছিলাম। ছুটে তোমার কাছে গিয়ে যখন দেখলাম তখন কী শান্তি। তুমি, আমি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কেঁদেছিলাম। তারপর একটু শান্ত হতে ওদের অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম।
তিতলি ঘটনার কথাটা আগে শুনেছিল। একটু একটু মনে ছিল। আজ আবার মনে পড়ল। সে মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেল। বেড়ালছানাটাকে ঘুম থেকে তুলে বলল, কী রে? তোর মা তোকে ডাকছে শুনতে পাচ্ছিস না? সাড়া দে। তুইও মাকে ডাক।
বেড়ালছানা কী বুঝল কে জানে! মিঁয়াও-মিঁয়াও করে মিহি সুরে ডাকতে লাগল। ওদিকে মেনি মানে ওর মাও সাড়া দিল। ঘরের দরজাটা খুলে দিতেই মা বেড়ালটা ছুটে এসে বাচ্চাটার সারা গা জিভ দিয়ে চাটতে লাগল। চোখ, মুখ শুঁকতে থাকল। বাচ্চা বেড়ালটাও ওর মায়ের গা ঘেঁষে আরাম খেতে লাগল।
এই দৃশ্য দেখে তিতলির মা, বাবা, আন্টি আর তিতলির নিজেরও গভীর আনন্দে চোখ জলে ভরে গেল।
বেড়ালছানা তিতলির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মিঁউ সুরে ডেকে বলল, ভাগ্যিস্ তোমরা ছিলে। তাই মাকে পেলাম।
তিতলি বলল, ভালো থাকিস। একা হোস্ না। বড়ো হলে আসবি কিন্তু।
বেড়ালছানাকে নিয়ে বেড়ালের মা চলে গেল। যাবার সময় বড়ো করে ম্যাঁও মানে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল।
অলংকরণ – অর্পিতা খাঁ
Topic : অনুভবের গল্প, ছোটোদের ভালো গল্প, একটি ছোট্ট মেয়ে ও বেড়ালছানার গল্প, Stories of feelings, Best stories of little ones, Stories of a little girl and kitten
0 মন্তব্যসমূহ