সাতসকালে মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিল ইন্দ্র। একে শীতকাল, তায় কুয়াশাটাও পড়েছে বেশ। অশ্বিনী বদ্যির কথামতো মর্নিংওয়াকের সময় হাঁটার গতিটা বেশ দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। নিদেনমাফিক জোরেই হাঁটে ইন্দ্র। ভালোমন্দ খেয়ে খেয়ে কোলেস্টেরলের যা বহর, না হেঁটে উপায়ও নেই। ঠাণ্ডার চোটে আজ হাঁটছিল প্রয়োজনের থেকেও জোরে। ব্রহ্মাসাগরের কাছে পৌঁছে হাঁটার গতিটা আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে গেল। ব্রহ্মা জেঠু কি এই ঠাণ্ডাতেও ধ্যানে বসে গেছে নাকি!
এটা নামেই ব্রহ্মাসাগর। আসলে একটা বড়ো সরোবর। ব্রহ্মাজেঠুর সাধনার আখড়া বলে ছেলে-বুড়ো সবাই এই নামেই ডাকে। দিঘির সামনে দাঁড়িয়ে দুবার চোখ ড়গড়ালো ইন্দ্র। ভালো করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবে আবছা হলেও বোঝা গেল রুটিনে ফাঁকি দেয়নি বুড়ো।
ফাঁকি দেয়নি বলেই তো ত্রিভুবনে এখনো এই বুড়োই শেষ কথা। ফিরে যেতে যেতে ভাবছিল ইন্দ্র। আর সে নিজে? ব্রহ্মাজেঠু, বিষ্ণুকাকা আর শিবুখুড়ো- এই তিন বুড়োর দৌলতে রাজা হয়েছে। তার কাজ বলতে কেবল ভালোমন্দ খাওয়া আর সকাল সন্ধে অপ্সরাদের নাচ দেখা। কোলেস্টেরল কি আর সাধে জমেছে। ইউরিক অ্যাসিডও কানা ছুঁই-ছুঁই। উপচে পড়লেই লিস্ট থেকে আরও কিছু খাবার বাদ চলে যাবে।
প্রাসাদে পৌঁছানোর আগেই ভারী দুঃখু হল ইন্দ্রর। ইউরিক অ্যাসিডের বাড়বাড়ন্তের কথা ভেবে যেমন, তেমনি তিনবুড়োর কথা ভেবেও। এরই মধ্যে অবস্থা কিছুটা ভালো তবু বিষ্ণুকাকার। তবে সেও তো লক্ষীকাকিমার দৌলতে। ভারি গুছিয়ে সংসারটা করেন কাকিমা। বিশেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আসার পর ওকে ধরে যা হোক একটা দু'কামরার পাকা ভিটে করে নিয়েছেন। আর শিবুখুড়োর তো কিছুই নেই, থাকে শ্মশানে-শ্মশানে। ব্রহ্মাজেঠুর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কাটে ওই পদ্ম ফুলের উপর বসে, খোলা আকাশের নিচেই। মনে আছে ছোটোবেলায় আকাশে মেঘ হলেই ওর খুব ভয় হত। ওর মাথায় যদি বাজ পড়ে। এখন অবশ্য বজ্রবিদ্যুৎ ওরই কন্ট্রোলে, সে ভয় আর নেই। তবুও যাদের দৌলতে স্বর্গরাজ্যের এত রমরমা, তারা এমন দুঃখ-কষ্টে থাকলে কারো ভালো লাগে? নাকি সেটা ভালো দেখায়?
প্রাসাদে ঢোকার আগে রাস্তাতেই একটু ফুঁপিয়ে কেঁদে নিল ইন্দ্র। ঘরে এসব কান্নাকাটি দেখলে শচী ভীষণ রাগারাগি করে। বলে, ব্যাটাছেলের আবার কান্না কি? তুমি আবার রাজা না? এসব অবিশ্যি মাথায় ঢোকে না ইন্দ্রর। আরে ব্যাটাছেলে বলে কি তার দুঃখ-কষ্ট থাকবে না! রাজা বলে একটু নিশ্চিন্তে কাঁদতেও পারবে না!
প্রাসাদে পৌঁছে বেগুনি-মুড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে ইন্দ্র প্রতিজ্ঞা করে ফেলল, নাঃ এর একটা বিহিত করে ছাড়বে সে। দুইবুড়োর এত কষ্ট ধম্মে সইবে না।
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। কাজ ফেলে রাখা ইন্দ্র কোনোকালেই পছন্দ করে না। সন্ধেবেলা বন্ধু বিশ্বকর্মাকে নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হল ব্রহ্মাসাগরে। ব্রহ্মাজেঠু তখনও সান্ধ্যাহ্নিকের তোড়জোড় করছিলেন।
- কি রে ইন্দ্র, কি মনে করে? কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো?
মনে মনে ভারি লজ্জা পেল ইন্দ্র। সত্যি, কেবল কাজের সময় ছাড়া না এসে এসে কি রেপুটেশনটাই না করে ফেলেছে।
- না জেঠু, তেমন কিছু নয়। একটু কথা ছিল। আপনি আহ্নিক সেরে নিন, আমরা বসছি।
ব্রহ্মা সময় নিলেন না বেশি। আহ্নিক সেরে এসে বললেন, বল কি বলবি?
কিভাবে কথাটা পাড়বে বুঝতে পারছিল না ইন্দ্র। গলা ঝেড়ে বলল, বিশুকে তো আপনি চেনেন জেঠু।
- চিনব না কেন রে? ওর বাপ-ঠাকুরদা সবাইকে চিনি।
- ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসেছে আপনি জানেন?
স্নিগ্ধ হাসলেন ব্রহ্মা। ইন্দ্র কি ভুলে গেছে, ত্রিভুবনের সৃষ্টিকর্তা তিনিই। সবই তাঁর নখদর্পনে! হাসির ডিজাইন দেখেই বুঝে গেল ইন্দ্র, জেঠু কি বলতে চাইছেন। আবার লজ্জা পেল সে। ভূমিকা না করে সরাসরি কোথায় ঢুকে পড়ল এবার।
- জেঠু, আমি ভাবছি এবার আপনাকে একটা বাড়ি বানিয়ে দেব।
- কেন রে, আমার আবার বাড়ি-টাড়ি কী হবে? তোর মাথায় এসব ভূত চাপল কেন রে আবার?
ইন্দ্র নাছোড়বান্দা বালকের ভঙ্গিতে বলল- না জেঠু, তা বললে চলবে না। আপনার বয়স হচ্ছে। এখনও সারা বছর এমন খোলা আকাশের নিচে...
- তা বুঝেছি, আমরা বুড়োগুলো রোদে-জলে ভিজলে তোর প্রাসাদে থাকতে লজ্জা করে।
ইন্দ্র ভেতরে ভেতরে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেও মুখে কিছু বলল না। ত্রিকালদর্শী বুড়ো এ তো সব জেনেই বসে আছে। সে তাই নিজের ঝোঁকেই বলল, সে আপনি যাই বলুন। আমি কিছু শুনছি না। বিশুকে সঙ্গে এনেছি। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে একটা প্ল্যান বানিয়ে নেবে।
- বোস তোরা, দেখি কিছু খাওয়ানো যায় কিনা। বলে ব্রহ্মা ওঠার চেষ্টা করছিলেন, ইন্দ্র আটকে দিল। আটকে দিল মানে কী, নিজের বয়স, পদমর্যাদা সব ভুলে জেঠুর কোমর জড়িয়ে ধরল।
- আরে আরে করিস কি, সুড়সুড়ি লাগে যে। বলে- ফের বসে পড়লেন ব্রহ্মাবুড়ো। বসে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, কি বলি বলতো তোদের? ওরে আমি চার দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়লে এই ত্রিভুবন চলবে?
- কেন চলবে না?
ইন্দ্রকে আজ যেন ছেলেমানুষিতে পেয়েছে। ব্রহ্মা হাসলেন।
- তোর পকেটে ওটা কি?
ইন্দ্র তাড়াতাড়ি বুকপকেটে হাত দিল। তারপর ভ্যাবলার মতো বলল, কেন মোবাইল।
- তোর প্রাসাদের মধ্যে ওটা চলে কেমন?
- উঁহু, ভালো নয়। বাইরে ঠিক আছে, ঘরে ঢুকলেই বেগড়বাই করে।
- কেন?
- কেন আবার? নেটওয়ার্কের প্রবলেম। সরকারি নেটপ্যাক হলে যা হয় আর কি।
- সেকি রে, সরকার তো তুই নিজেই। তাহলে রাজপাট সামলাতে পারছিস না বল!
এবার লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল ইন্দ্র। বিশ্বকর্মা দাঁত বের করে ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসতে শুরু করল। সেই হাসি দেখে ব্রহ্মারও হাসি পাচ্ছিল। হাসি চেপে তিনি বললেন, ওরে বোকা, রাজ্যপাট চালাতে গেলে একটা স্ট্রং নেটওয়ার্ক দরকার হয়। আর ত্রিভুবন চালাতে গেলে সেটা আরো কতটা স্ট্রং হওয়া দরকার বুঝেছিস। তোর চার দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়লে আমার কাছে সব সিগন্যাল এসে পৌঁছবে?
অকাট্য যুক্তি। বিশ্বকর্মা বুঝেছিল এ বুড়োকে বিশেষ ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া বুড়োগুলো কেমন গোঁয়ার মতো হয়। নিজে যেটা ভালো বুঝবে সেখান থেকে কিছুতেই নড়বে না। সে বন্ধুর পায়ে গোপনে একটা চিমটি কাটল। চিমটির কামড়টা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। ইন্দ্র উঃ করে লাফিয়ে উঠল। ব্রহ্মা মৃদু তিরস্কার করলেন।
- তোর ছেলেমানুষি এখনো গেল না বিশে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিস, সংসারধর্ম করার বয়স হল, একটু আস্তে কাট।
ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলে বিশ্বকর্মা। ইন্দ্র যে চিমটি খেয়েই লাফিয়ে উঠল, বুড়োটা বুঝল কি করে! নিজের হাতের অবস্থানটা একবার নিঃশব্দে জরিপ করে নিল সে। নাঃ, সে যে চিমটি কেটেছে এটা বোঝা অসম্ভব। তারমানে দূরদৃষ্টি। এই দৃষ্টির কথা শুনেছে আগে, চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে কেমন ঘেমে উঠতে লাগল বিশ্বকর্মা।
এখানে থেকে যে কাজ কিছু হবে না সেটা ইন্দ্র বুঝতে পারছিল।
- তাহলে আসি জেঠু। বলে উঠে পড়ল সে।
- আয়, এবার কোথায় যাবি? শিবুর কাছে? যা, ঘুরে আয়। নইলে যে তোর আবার কাঁটাটা খচখচ করবে।
স্বর্গের শ্মশানের চিতা বলে কখনো নেভে না। মানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেবদেবী দেহ রাখে। কিন্তু স্বর্গের এই শ্মশানটির কথা মর্তের মানুষ বিন্দুবিসর্গ জানে না। তারা জানে, দেবতারা অমর। দেবতারাও মরে। মরে ভুত হয়, ভূত হয়ে জ্বালাতন করে। এসব তথ্য একবার কানে উঠলে মানুষগুলো আর দেবতাদের পাত্তা দেবে ভেবেছ!
যথারীতি শ্মশানে আজও একটা চিতা জ্বলছিল। সেটা দেখেই ইন্দ্রর জামা খিমচে ধরল বিশ্বকর্মা। তুই ঘুরে আয় ইন্দ্র, আমি আর যাচ্ছি না। বিশুর ভূতের ভয়ের কথা জানা ছিল ইন্দ্রর। সে বলল, চল আমরা এদিকটায় ঢুকব নাকি? শিবুখুড়ো ওদিকটায় থাকে।
স্বর্গের আকাশে চাঁদের আলো সব সময় থৈ থৈ করে। কিবা দিন, কিবা রাত। দেখাশোনার কোনো অসুবিধা নেই। আর তাই শ্মশানে ঢোকার দ্বিতীয় রাস্তার মুখটাতে আসতেই ওদের দুজনকে দেখতে পেল নন্দী আর ভৃঙ্গী। একটা গাছের ঝুরি ধরে দোল খাচ্ছে নন্দী আর রাস্তার একপাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে ভৃঙ্গি। সম্ভবত আফিম খেয়েছে।
শিবুখুড়ো গাঁজার কলকেয় ভুড়ুক-ভুড়ুক করে দম দিচ্ছিলেন। ইন্দ্রকে দেখে বললেন, কি মহারাজ, কি মনে করে? ভারি লজ্জা পেয়ে গেল ইন্দ্র। ঢিপ করে একটা প্রমাণ করে, ঈষৎ মাথা চুলকে, কি বলবে বুঝতে না পেরে বলে ফেলল, এই যে খুড়ো বিশেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে।
বেশ প্রশ্রয় মাখানো হাসি হেসে মহাদেব বললেন, আর তাই তুই ওকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবার বাড়ির প্ল্যান করে বেড়াচ্ছিস?
ইন্দ্র বুঝল, দুইবুড়োর ইতিমধ্যেই মোবাইলে কথা হয়ে গেছে। তার আঁতে ঘা লাগল। দুঃখ হল বেবাক। ও এল একটা ভালো সংকল্প নিয়ে আর শুরুতেই...। ইন্দ্র কি উত্তর দেবে ভাবছিল। তার আগেই মহাদেবই আবার বললেন, হ্যাঁ রে মহারাজ, আজকাল বিষ্টুটার কেমন ঠাণ্ডা লাগার ধাত হয়েছে খেয়াল করেছিস? সব সময় নাক দিয়ে গড়াচ্ছে।
খুড়ো কি বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে ইন্দ্র এমন অনিশ্চিতভাবে ঘাড়টা দোলাল যার অর্থ হ্যাঁ-ও হয়, না-ও হয়। শিবুখুড়ো ফের বললেন, যত নষ্টের গোড়া আমার মেয়েটাই। লক্ষী। বিশেকে বলে ঘর বানালো। তারপর, তোদের এখন কি সব হয়েছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং না কি যেন? মেয়ে আমার ঘরের মধ্যে ঘেমে অস্থির। সেই দেখে তুই শুনলুম একটা এসি লাগিয়ে দিয়েছিস। বিষ্টুর আর দোষ কি? ফ্যাচ-ফ্যাচ করবে না সবসময়?
ইন্দ্র ক্ষীণ কন্ঠে প্রতিবাদ করতে গেল, কিন্তু লক্ষী কাকিমার তো...
দাবড়ে থামিয়ে দিলেন মহাদেব। - আরে ওর আবার কী হবে? ওকে বিষ্টুর মতো হাজারবার ঘর-বার করতে হয় নাকি?
ওর সংকল্পের যে দফারফা সেটা বুঝতে পারছিল ইন্দ্র। তবু একবার শেষ চেষ্টা করল।
- কিন্তু আপনারও তো বয়স হচ্ছে খুড়ো। এরকম খোলা আকাশের নিচে আর কতদিন...
- ব্যাস, ব্যাস। তোর মতলব বেশ বুঝতে পারছি। বুড়োগুলোকে আরামের মধ্যে ঠেলে দাও। রোগ জ্বালা ধরে এমনিই টেঁসে যাব।
আর কোনো কথা বলার চেষ্টা করল না ইন্দ্র।
একে তো দু'জায়গাতেই ব্যর্থ, তার ওপর দুই বুড়োর কথার খোঁচা খেয়ে ও যখন বেরিয়ে এলো, তখন শীতের মধ্যেও ইন্দ্রের কপালে ঘামের ফোঁটা জমছিল। শুকিয়ে আমসি হয়ে যেটুকু বাকি ছিল, সেটা হয়ে গেল হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। সাড়ে নটা। মানে, শচীর টিভি সিরিয়াল শুরু হয়ে গেছে। চলবে এখন পরপর চার-পাঁচটা দু-আড়াই ঘন্টার ধাক্কা। এখন আর খাবার-টাবার তো জুটবেই না, উঠে এসে দরজা খুলতে হলেই... ভাবতেই গা শিউরে উঠল ইন্দ্রর। ডুবতে বসা মানুষের মতো আর্তস্বরে সে বলল, বিশে, আমায় একটু বাড়ি পৌঁছে দিবি ভাই?
অলংকরণ- রাহুল মজুমদার
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২৪
Topic : মজার গল্প, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের গল্প, Funny stories, Funny stories of gods and goddesses, stories of Brahma-Vishnu-Maheshwar
0 মন্তব্যসমূহ