মেজর দীনেশ সিং ছুটিতে বাড়ি এসে ঘুরতে বেরোলেন তাঁরই সহযোদ্ধা শহীদ রামেশ্বর তিওয়ারীর বাড়ি। রামেশ্বরের একটি ডায়েরি একমাস ধরে তাঁর কাছে সুরক্ষিত ছিল। তিনি প্রত্যহ ডায়েরি লিখতেন। শেষ দিন অবধি এতেই নিজের মনের কথা লিখে গিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর শেষ ইচ্ছে রাখতে ডায়েরিটা তাঁর স্ত্রীকে ফেরত দিতেই মূলত তাঁদের বাড়ি যাওয়া। শুধু স্টেশনের নাম ছাড়া আর কোনো ঠিকানাই তিনি জানতেন না।
শেষ অবধি ট্রেনটা মিথিলা গ্রামে গিয়ে রাত দশটায় থামল। রামেশ্বরবাবুর বাড়ি স্টেশনের কেউই বলতে পারছেন না। হেঁটে চলেছেন। দূর-দূর অবধি কোনো রিক্সা, ভ্যান, গাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনো লোকজনও নেই। একজন লোককে হেঁটে ওঁর দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গিয়ে রামেশ্বরবাবুর নাম বলতেই লোকটা যেন কত চেনা স্বরে আসুন বলে সোজা হেঁটে চললেন। একদম রামেশ্বরের গলা। হয়তো ওঁর কেউ হবে। কারণ রামেশ্বর কোথা থেকে আসবে? সে তো আর নেই!
ওঁর পেছন-পেছন হেঁটে গিয়ে অবশেষে পৌঁছিয়ে দেখলেন ওঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বাড়ির সকলে দাঁড়িয়ে। যেন সবাই কত চেনেন। পরিচয় পর্ব সেরে রামেশ্বরের ডায়েরিটা তাঁর স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন। আপাদ মস্তক কাপড়ে মুখ ঢাকা। সকলের গলাগুলো কেমন যেন নাকিসুরে শোনাচ্ছে। হয়তো গ্রামের লোকেদের গলা এমন হয়। প্রতিটা গ্রামের লোকেরই নিজস্ব বলার ভঙ্গি আছে। এঁদেরও হয়তো নাকিসুরে বলা স্বভাব। রামেশ্বরের ছোটো ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়ালে বাবা-মরা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলেন। গা-টা কী অসম্ভব ঠাণ্ডা! শীতকালেও এঁরা কেউ কিছু দেননি গায়ে। দীনেশ সিংয়ের তো এত কিছু গায়ে পরেও কাঁপুনি আসছে।
সারা গ্রামে আলোর বিন্দু অবধি নেই। টিমটিম করে প্রদীপের মতো কুপি জ্বলছে। এঁদের বাড়ির লোক সংখ্যা যেন অগুনতি। রামেশ্বরের মা এসে দীনেশের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে দুফোঁটা চোখের জল ফেললেন। ছেলের ব্যাপারে শোক প্রকাশ করে। দীনেশ ওঁকে মাতৃজ্ঞানে প্রণাম করতে গিয়ে পায়ে হাত দিতেই বরফের মতো ঠাণ্ডা অনুভব হল। রাত প্রায় অনেক। কত ঠিক দেখা যাচ্ছে না। দীনেশের চোখ যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে বেশি আঁধার লাগছে চারিপাশ। শরীরে প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভব হল। সারা শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ঘরের কুপিটাও নিভে গেল। তারপর গল্পে-গল্পে ঘন্টা চারেক কেটে গেছে কোনদিক দিয়ে দীনেশের খেয়ালও নেই। খেতে বসলেন সবাই দীনেশকে নিয়ে। থালাটা ভালো করে সাজিয়ে দীনেশের সামনে দিতে বললেন, যে লোকটা ওঁকে নিয়ে এসেছিলেন।
ঘরে এক ফোঁটা আলো নেই। তাতে দীনেশের আর অস্বস্থি হচ্ছে না। লোকটার গলাটাতে বারবার রামেশ্বরের কথা মনে পড়ছে দীনেশের। সব খাবারগুলো বানানো হয়েছে ওঁর একান্ত পছন্দের। এটা কি শুধুমাত্র কাকতালীয়! না বেঁচে থাকতে রামেশ্বর বলেছিল! তবে ও তো কাউকে না জানিয়ে এসেছে। নিছকই তবে কাকতালীয়। খাওয়া চলছে। এমন সময় রামেশ্বরের বউ 'আর কিছু লাগবে' বলে এগিয়ে আসাতে পা-টা দীনেশ লক্ষ্য করলেন উল্টো মনে হচ্ছে। পায়ের গোড়ালিটা সামনের দিকে। আঙ্গুলগুলো পেছনে। চমকে উঠলেন দেখে। বাকিদের লক্ষ্য করছেন অন্ধকারে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। রামেশ্বরের মা'র চোখ দুটো কেমন অস্বাভাবিক লাগছে, একটু বেশিই উজ্জ্বল। দূর থেকেই মুখটা দেখা যাচ্ছে।
এঁদের সবার মধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিকতা। সবার সঙ্গে পরিচয় হলেও পাশের লোকটির সঙ্গে এখনো পরিচয় হয়নি। রামেশ্বরের বউ-ই বা মুখ ঢেকে ঘুরছেন কেন! কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। পাশের লোকটাও মুখ ঢাকা গামছায়। রামেশ্বরের স্ত্রীর খেতে দেওয়ার সময় হাতের কাপড়টা সরে যেতে দীনেশ হতবাক। পুরোটা পুড়ে গিয়ে কালো বর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু রামেশ্বর তো বার-বার বলতেন ওনার স্ত্রী খুব সুন্দরী। কোনো বিবদ কি তবে ঘটে গেছে এ ক'দিনে! পাশের লোকটাই বা কে! এত কৌতুহল একসঙ্গে চেপে রাখতে না পেরে রামেশ্বরের বউকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, আপনার কি কোনো দুর্ঘটনা হয়েছিল? হাতটা পোড়া মনে হল।
শুধু হাত না! সারা শরীরই পুড়ে গেছিল, দেখবেন? বলে ঘোমটা সরাতেই পোড়া মুখে ঠিকরে পড়া চোখ দুটো দেখে দীনেশ আঁতকে উঠে বললেন, বাঁচলেন কি করে?
বাঁচিনি তো! কার জন্য বাঁচতাম বলুন? আপনার বন্ধু গত একমাস আগে ছেড়ে চলে গেলেন সেই শোকে শাশুড়ি মাও সেই যে জ্ঞান হারালেন আর সেই জ্ঞান ফিরল না। উনিও প্রাণ হারালেন। গত সাত দিন আগে মাত্র ক'দিনের জোরে ছেলেটাও ছেড়ে চলে গেল, সেদিন আমিও গায়ে আগুন দিয়ে...
তারমানে আপনারা সবাই মৃত? আর আপনি তবে কে? এই মৃতদের সঙ্গে কি করছেন?
লোকটা হাতে একটা মিষ্টির থালা নিয়ে মুখে গামছাটা সরিয়ে, দীনেশের মুখে একটা মিষ্টি গুঁজে দিয়ে বললেন, স্যার ওয়েলকাম টু আওয়ার জোন।
একি! রামেশ্বর তুমি এখানে কি করছ? তুমি তো একমাস আগেই যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছিলে?
রামেশ্বরের মাথা এবং বুকের গুলি লাগা জায়গায় ক্ষত এখনো জ্বলজ্বল করছে।
শুধু আমি না, চার ঘণ্টা আগে আপনিও স্যার আর বেঁচে নেই। শেষবারের মতো আপনার শরীরে ঝাঁকুনি এসেছিল। চার ঘণ্টা আগে, ভেবে দেখুন। তারপর আপনার শরীরের না কোনো কষ্ট, না কোনো অনুভূতি। স্তম্বিত দীনেশ সিং দুচোখের জল নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে রামেশ্বরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, এরা কি সবাই তোমার পরিবার?
না স্যার, এরা সবাই অতৃপ্ত আত্মা। আপনার-আমার মতো। আপনি চিরকাল কর্তব্য পরায়ণ মানুষ মৃত্যুকালে আমার শেষ আকুতি রক্ষা করতেই মৃত্যুর আগেই আপনার মন ছুটে এসেছিল ডায়েরি হাতে। আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে আনি। তারপর তো সবই আপনার জানা। এখান থেকেই কর্মফল অনুযায়ী মুক্তি মিলবে সবার।
কর্তব্য পালনের পর দীনেশ সিংয়ের আত্মা ছুটে চলেছে প্রিয়জনদের কাছে। একটাই খবর নিউজ চ্যানেলগুলোতে ক-ঘণ্টা আগেই মেজর দীনেশ সিং একমাসের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ছেড়ে চলে গেলেন। ডাক্তাররা মাথা ও বুকের গুলি বের করলেও তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। কোমা থেকে আজ চিরবিদায় নিলেন। দূর থেকে ওঁর আত্মা সকলকে দেখছে, ছুঁতে চেয়েও পাচ্ছেন না। নিথর দেহটা ওর সামনে দিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
না কোনো কষ্ট না পরিজনকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে, কিছুই নেই তাঁর মনে। পেছন ফিরে তিনিও চললেন সবকিছু ছেড়ে প্রেত পুরীতে। এখন শুধু মুক্তির অপেক্ষা।
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৯
অলংকরণ- অমর লাহা
Topic : গা ছমছমে ভূতের গল্প, একটি রাতের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ