Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পটলা এন্ড ফ্রেন্ডস্ কোম্পানি লিমিটেড ।। মানব মণ্ডল

 




আপ্পু, বাপির ভুলেই তো রাজকন্যা পুতুল হয়ে রয়ে গেল। দাদু ছাড়া কেউ মানতেই চাইল না সে কথা। আপ্পু তো নিজের ভুল না ধরা পড়ে তাই চুপ করে গেছিল। কিন্তু বাপি! ব্যাটাকে ফড়িং করে দিয়েছিল সেটাই ভালো ছিল! কেন যে ওকে বাঁচাতে গেলাম! দাদুর দু-লাইনের মন্ত্রটুকু মুখস্থ করতে পারল না কুমড়ো পটাশ আপ্পুটা। অথচ ইংরেজি পোয়েমগুলো টকাটক বলে রোজ আমাকে কানমলা খাইয়ে আমার বেলে মোরব্বায় ভাগ বসায়।

আসলে সবই হিংসে। গল্পটায় আমি হিরো কিনা! ওদের কোনো ক্রেডিট-ই নেই। তবে গল্পের সূত্রপাতটা ওকে দিয়েই। আমাদের তরোয়ালের ছত্রভঙ্গ তখন দাদুর বাগান। কচু গাছগুলোকে একেবারে কচুকাটা করে ফেলেছি। মুখটুখ ফাটিয়ে টমেটোগুলোর রক্তারক্তি কাণ্ড। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় হেরো আপ্পুর নালিশ শুনে দাদু ছুটে এসে বলল, সত্যি বীর হলে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে দেখা।

দিঘির ওপারে রাজকন্যা আছে। আঁধার হলেই দিঘিরপাড়ের তেঁতুল গাছটা আতা গাছ হয়ে যায়, আর রাজকুমারী সেই আতা গাছের ডালে বসে রূপকথার গল্প শোনে।

ওদের উৎসাহের শেষ নেই। বোকার দল সব। অশিক্ষিত আবার রাজা হবে কি করে, বাপি তো ফেলুরাম। আর আপ্পু তো কুমড়ো পটাশ। ওর বুদ্ধি বেশি, তাই ও মন্ত্রী হবার যোগ্য। সুতরাং সব হিসেব-নিকেশ করলে দেখা যাবে পটলা মানে আমি রাজকন্যা পাব। কোনো তর্কে-বিতর্কে না গিয়ে ওদের সব শর্তেই এক পায়ে রাজি হয়ে গেলাম, থুড়ি-থুড়ি দু-পায়ে। বাঁশের তীর-ধনুক, গুলতির মতো ব্যাকডেটেড অস্ত্রগুলো আমার ভাগ্যে জুটলো।

এক লাফে হনুমান সাগর পার হয়ে গেছিল। তা রাজকন্যার জন্য আমরা দিঘিটা পার হতে পারব না! লোকে যদিও বলে, তবে আমরা কিন্তু হনুমান নই। রাজকন্যা উদ্ধারে পক্ষীরাজ ঘোড়া লাগে। ঘোড়া নেই তো কি আছে, আমাদের ভ্যাবলারাম তো আছে। কিন্তু ওর গায়ে ভীষণ গন্ধ! আর স্টাইল-টাইলও ঠিক মতো জানে না। গোঁফ কেটে মাকুন্দ হয়ে একগাছা দাড়ি রেখেছে।

আবার আলোচনায় ওর নাম শুনতেই ম্যা-ম্যা করে মাথা নেড়ে এগিয়ে এল কত উৎসাহ নিয়ে। আপ্পুটা না একেবারে বাজে! ওকে অপমান না করলেই হত। ওর যুক্তি, ছাগলের পিঠে চেপে গেলে রাজকন্যার কাছে আমাদের প্রেস্টিজ থাকবে না। টিকটিকিতে সায় দিয়ে তাতে ঠিক ঠিক বলে উঠল। বাপি তো বুদ্ধির ঢেঁকি, ও তো মাথা ঘামায়ই না, উল্টে লোকের মাথা খায়।

শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল কলাগাছের ভেলায় করেই যাওয়া হবে। এখানে আমার আপত্তি ছিল। হেঁটে মাঠটা তো পেরনো যেতই! এখন তো স্কুলেও ছুটি। কি দরকার, না হয় দিন দশেক সময় বেশিই যেত। বাপি আমায় ইনসাল্ট করে বলল, পটলা গ্যাঁড়াগেঁড়ির মতই থাকবি, মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবি না। সব অপমানই সহ্য করে নিলাম। যখন পানিফল, পদ্মফুল তোলার বাবলুদের ডেঙিটা চুরি করে আনল বাপি।

শেষমেষ রাজকন্যা উদ্ধারে অভিযান শুরু হল। দুটো শালিক নিজেদের ফুলিয়ে একটু বড়ো চেহারা করে বারবার মাথা নাড়িয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে যেতে বলছিল। কিন্তু হল না। অভিযান শুরুর আগেই একটা মৌমাছি গুন-গুন করে কি যেন বলতে চাইল। শুনিনি বলে ফস করে কামড় বসিয়ে দিল নাকের ওপর। জানি এটাও বাপির পোষা মৌমাছি। ব্যাটা আমি ওদের গুড়ের হাঁড়ি থেকে মাছিদের তাড়াতে গেলেই বলে, ওরা আর কত খাবে? কিন্তু আমরা চাইলেই বলে, এবার গাছের রস কম হয়েছে। মশা-মাছিদের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। তাইতো ও কি সুন্দর ফড়িং ধরতে পারে।

শালুকগুলোর মধ্যে দিয়ে কালো মতো কি একটা মাথা তুলল। ধ্যাৎ, সাপ নয় ওটা, পানকৌড়ি। বাপি জানে, দু'তিন দিনের যাত্রাপথ হতে পারে। তাই গামছা বেঁধে রুটি আর অনেক ক'টা পাটালি এনেছে। জানি না ঘন্টা দু'য়েক তো বইলাম।

এ বাব্বা! আমি এক্কেবারে ভুলে গেছি। দাদু কতবার গল্পটা বলেছে, শালুক-পদ্মে লুকনো থাকে জাদুকরের জান, তরোয়াল দিয়ে করতে হবে তাকে খান-খান। তরোয়াল পায়নি, লাস্ট বার্থডের কেক কাটার ছুরিটা এনেছি। ঐকিক নিয়মের নাকি পরিমিতির নিয়মে কি একটা হিসেব করে আপ্পু বলল, তিনদিনে সবক'টা শালুক-পদ্ম খুলে ফেলতে পারব। নতুন অঙ্ক শিখেছে, তবে ও ভুল খুব কমই করে। তবু যতদিনই লাগুক খুঁজতেই হবে পোকাটাকে।

অবশেষে আপ্পুই পেল পোকাটাকে। পাড় ঘেঁসা একটা শালুকের গায়ে দেখতে পেলাম কাঠ পিঁপড়েটাকে। জব্বর কামড়ে বুড়ো আঙ্গুল ফুলে ঢোল আপ্পুর। তবু পিঁপড়েটাকে ছাড়লাম না আমরা। দু' টুকরো করে দিলাম। যেমন ইংরেজরা ভারত-পাকিস্তান ভাগ করেছিল। জাদুকর চেষ্টা করলেও জুড়তে পারবে না। আপ্পুর চেঁচানি না যাদুকরের মৃত্যু জানি না, কাকগুলো একসাথে 'ক্যা-ক্যা' করে উঠল। বাপি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গেল। কাকের ঝাঁকে বক্ কোথা থেকে পেল কে জানে! বলল, বক মরেছে, বকের মাংস খেতে দারুণ। রাজকন্যে আমার চাইনে, বলেই দে ছুট। হাওয়ার মতো মিশে গেল গাছপালা ভরা জঙ্গলে।

এদিকটা আমি ঠিক চিনি না। রাজকন্যা উদ্ধার হলে তাকে নিয়ে ফিরব কী করে! আপ্পু বড়ো স্বার্থপর। বলল, রাজকন্যা-রাজত্ব নিয়ে সে সেটেল হয়ে যাবে এখানেই। কিন্তু সে কি করে হয়, মাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। রাজামামা আমেরিকায় সেটেল হয়েছে। রাজকন্যার মতো তারও নাকি বউটা। কিন্তু রাঙাদাদু দিদার কত কষ্ট!

কোথা থেকে বাপি লাফিয়ে এসে পড়ল নৌকাতে। হঠাৎ দেখি একটা ধাক্কা। আপ্পু মন্ত্র আওড়াতে থাকল। যেন ও আমাদের পাড়ায় লক্ষ্মী বা সরস্বতী পুজোয় কিডন্যাপ করে আনা পুরুতের মতোই ভয় পেয়ে ভুলভাল মন্ত্র বলল।

মাথা ঝিমঝিম কমেছে। ইস্ কি পচা গন্ধ! আপ্পু বাপি কোথায় তোরা? চেঁচাতেই থপ্-থপ্ করে লাফাতে লাফাতে হাজির হল একটা কোলাব্যাঙ। এক ঝটকাতেই সরিয়ে দিতেই ড্যাবাড্যাবা চোখে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে ছল্ ছল্ করে উঠল বুঝি ওর চোখটা। ভারী বিপদ, ফড়িংটাও গায়ে পড়ে ঝগড়া করে কি একটা বলতে চাইল।  এক নাগাড়ে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর করে বোঝালো ওই কোলা ব্যাঙটাই আপ্পু, আর ফড়িংটা আসলে বাপি! ব্যাটা আমাকে সাপ বানিয়ে আমাদেরকে নিয়ে খাদ্য শৃংখল বানাবে! কিন্তু তা কিছুতেই হতে দেব না।

গল্পের শর্ত অনুসারে জাদুকর তো মারা গেছে। তা নতুন জাদুকর আবার কোথা থেকে এল! আমিও বোকা বটে! এই রূপকথার গল্পটা তো দাদুও তার ঠাকুরমার কাছ থেকে শুনেছে। তা এতদিনে কি জাদুকরের ছেলেপুলে হবে না! আমি গাধা, ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি তো, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। ফিল্মেও দেখেছি ম্যাহেমুদ, জুনিয়র ম্যাহেমুদ। কলকাতায় পি. সি. সরকার, জুনিয়র পি. সি. সরকার। নিরুপায় হয়ে হঠাৎ মনে হল দাদু-দিদা-মা সবাই বিপদে পড়লে ঠাকুরকে ডাকে। কিন্তু আমি কোন ঠাকুরকে ডাকব! উবু দশ কুড়ি ...। শেষ পর্যন্ত সবাইকেই ডাকতে শুরু করলাম। যার লাইনটা পাওয়া যায়। কাস্টমার কেয়ারের লাইন তো সব সময় বিজি!

অনেকক্ষণ পরে একটা পরী এসে বলল, যে কোনো একজনকে ডাকলেই হত, সবাই একসঙ্গে আসতে গিয়ে পুরনো পুষ্পরথটা নাকি ভেঙে গেছে। তাই পরীকে পাঠিয়ে দিয়েছে তিনটে বর দিয়ে। জাদুকরকে মারবার বরটা নিতেই হবে। নয়তো সে এসে তোমাকে সাপ বানিয়ে দেবে। এবার আরো দুটো বর বাছতে পারো। রাজকন্যা, আপ্পু আর বাপি তিনজনের মধ্যে যেকোনো দুজনকে ফিরে পাবে। তবে চৈত্র সেলের মতো বাড়ি যাওয়াটা একদম ফ্রি, সেটাও আবার দুধের মতো সাদা মেঘ কাটিয়ে পরীর হাত ধরে। আমি তো ওদের মতো স্বার্থপর নই। রাজকন্যা দূরে থাক, বন্ধু আগে। রাজকন্যা মানে পুতুলটাও দিয়ে দিল আমাকে পরী। বিশ্বাস না করলে দেখে নিতে পারো আমাদের সোকেশে। আমাকে পাছে কেউ মেয়ে বলে, তাই বোনকেই দিয়ে দিয়েছি ওটা। ঠিক আছে, ভালো করে লক্ষ্য করো আপ্পুর ভুঁড়িটা পুরো কোলা ব্যাঙের মতো। আর দেখবে বাপি কারণে-অকারণে পা নাচায়, যেমন ফড়িংগুলো লেজ নাড়ে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১১

 

Topic : Best Fairy tale in Bengali, রূপকথার গল্প, রাজকুমারী উদ্ধারের গল্প, The story of the rescue of the princess, Magician & Little Boy's wonderful story

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ