Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ময়ূরের মোহভঙ্গ ।। সুকুমার মণ্ডল



অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক প্রকাণ্ড সরোবরের ধার ঘেঁষে ভারি চমৎকার এক বন। বসন্তকাল এসে গেছে। গাছে গাছে নতুন পাতার সাজ। এমনি এক সকালে বকুল গাছের ডালে বসে চৈতালি চড়াই দুঃখ করে বলল, জানো তো ভাই, ময়ূর কাল সাফ বলে দিয়েছে, আমার বিয়েতে সে নাচতে পারবে না।

ঝুপসি পাতার আড়ালে চোখ বুজে বসেছিল নিশি-পেঁচা।  বিজ্ঞের মতো দুপাশে মাথা দুলিয়ে সে বলল, আমি জানতুম, ময়ূরের বড়ো অহংকার হয়েছে। এইতো কয়েক মাস আগে বর্ষার সময় মেঘ দেখেও ও নাচে নি। ইদানিং ওর ভারি  গুমোর হয়েছে।

ওদের কথাবার্তার মধ্যেই ময়ূরকে দেখা গেল বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে নরম ঘাসের ওপর দিয়ে সে হেঁটে চলেছে। তাকে দেখতে পেয়ে চড়াই গলা চড়িয়ে পেচাঁকে বলল, ওই চলল দেখো। রোজ এক নেশায় পড়েছে ময়ূর। সারাদিন ঝিলের ধারে বসে জলে নিজের ছায়া দেখে আর বিভোর হয়ে থাকে। এসব কথা ময়ূরের কানে গেল বটে, কিন্তু সে ভ্রুক্ষেপ করল না

ওই বনের ধারে থাকত এক ঠানদি বুড়ি। ময়ূরের রূপের অনেক খ্যাতি শুনেছে সে। ময়ূরের সঙ্গে আলাপ করবে বলে আজ সকালে ঝিলের ধারে হাজির হয়েছে। জলের ধারে ময়ূরকে বসে থাকতে দেখে গুটি গুটি পায়ে কাছে এগিয়ে এল। আহা কি রূপ! নরম রোদে নীলাভ রঙ যেন পিছলে পড়ছে। ময়ূরের কাছে গিয়ে বলল, সত্যি কি সুন্দর দেখতে তোমাকে। তোমার চমৎকার পালকের একটি দেবে আমাকে? ফিরে গিয়ে সেখানে রাজাকে উপহার পাঠাব।

ঠানদি বুড়ির অনুরোধে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, ভারি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ময়ূর ঝাঁঝিয়ে উঠল, বিদেয় হও দেখি বুড়ি, দেখছ না আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।

ঠানদি বুড়ি এমন ব্যবহার পেয়ে রেগে আগুন বললে, তুমি দেখছি বেজায় ছোটো মনের। রোসো তোমার একটু শিক্ষে হওয়া দরকার। একথা বলতে বলতে বুড়ি তার ঝোলা থেকে একটা রূপোর বাঁশি বের করে তাতে ফুঁ দিল। সেই সুর শোনা মাত্র ময়ূরের শরীরে যেন শিহরন খেলে গেল। গেল তার দু-পা মাটিতে আটকে গেল। বিস্ময় ক্রমে পরিণত হল, যখন ময়ূর দেখল ওর ডানাগুলির রং পাল্টে গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। আর পা-দুখানি শিকড় হয়ে ক্রমশঃ মাটির মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণ পরে ময়ূর এক চমৎকার ঝাঁকড়া আম গাছ হয়ে গেল। অসহায় ময়ূর চিৎকার করে উঠতে চাইল, বুড়িমা আমাকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দাও। কিন্তু ময়ূরের গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হল না, কেবল আম গাছের ডালপালা দুলে উঠে খসখস আওয়াজ তুলল। সে কথার অর্থ শুধু ঠানদি-ই বুঝতে পারল। চলে যাওয়ার আগে সে বলে গেল, যেদিন অন্যের জন্য সহানুভূতি জন্মাবে তোমার মনে, সেই দিনই তুমি মুক্তি পাবে।

সেই গাছে বাসা বাঁধল পাখির দল। গাছের সুমিষ্ট ফল খেত তারা। একদিন পেঁচা সেই আমগাছ বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এল। প্যাঁচার বন্ধু অল্প কিছুদিন আগে বাসা গড়েছিল ওই আমগাছে। গল্প করতে করতে একসময় পেঁচা বলে উঠল, সেই দেমাকি ময়ূরটাকে আর দেখতে পাই না আজকাল। মনে হয় ওই তল্লাট ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। বাব্বাঃ বাঁচা গেছে।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে এমন সব মন্তব্য শুনতে হয় আজকাল ময়ূর-কে।

গ্রীষ্মের এক দুপুরে এক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ময়ূর দেখল, চমৎকার পোশাক পরা এক সুন্দরী মেয়েকে তাড়া করে আসছে কয়েকজন ঘোড়-সওয়ার ডাকাত। ভয়ে-ক্লান্তিতে মেয়েটি ফ্যাকাশে। আম গাছের নিচে দম নিতে একটু দাঁড়ায় সে। তারপর চেঁচিয়ে বলে ওঠে, বাঁচাও... বাঁচাও...  কেউ কি আছ এখানেআমি সুবর্ণগরের রাজকুমারী ফুলমতিদুষ্টু ডাকাতরা আমাকে ধরতে আসছেবাঁচাওশুনছো কেউ আছ এখানে? রাজকুমারীর কাতর আর্তনাদ বনে বনে প্রতিধ্বনি হল। রাজকন্যাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল ময়ূর, কিন্তু সে দেখল তার কোনো ক্ষমতাই নেই। কেবল আমগাছের ডালগুলো ঝাপটিয়ে উঠল। কেউ এগিয়ে এলো না রাজকুমারীর রক্ষায়। ঘোড়ায় চড়া ডাকাতগুলো দেখতে পেয়ে গেছে। এদিকে এগিয়ে আসছে ওরা। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ফুলমতি তরতর করে আমগাছটায় চড়ে বসল। রাজপ্রাসাদের বিলাসে মানুষ, অথচ কি করে যে গাছে উঠতে পারল তা ভেবে নিজে অবাক হয়ে গেল ফুলমতি। উঁচু দিকের একটা ডালে উঠে হাঁফাতে থাকে সে।

নীচে তখন ডাকাতগুলো এসে পড়েছে। গাছের উঁচু ডালে রাজকুমারীকে দেখতে পেয়ে একজন তক্ষুনি গাছে চড়তে গেল। আর অমনি এক আশ্চর্য কাণ্ড হল। একটা বড়ো শিকড় মাটি থেকে সটান জেগে উঠল এবং কিছু বুঝে ওঠার আগে সেই ডাকাতটাকে আছড়ে ফেলল মাটিতে। অন্য ডাকাতটা আবার ওঠার চেষ্টা করল। ওমা! কি কাণ্ড! শক্ত-শক্ত ইয়া বড়ো-বড়ো কাঁচা আম ধাঁই ধাঁই করে বৃষ্টির মতো এসে পড়তে লাগল ডাকাতগুলোর মাথায়, মুখে। বাবাগো-মাগো বলে দ্বিতীয় ডাকাতটাও নেমে এলো গাছ থেকে। নিশ্চয়ই এই আম গাছে ভূত-প্রেত আছে। বিষম ভয় পেয়ে ডাকাত দুজন তক্ষুনি পালাল সেখান থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর রাজার রক্ষীরা রাজকুমারীর সন্ধান করতে করতে সেখানে এসে পৌঁছাল। আমগাছ থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ার আগে ফুলমতি একটি কাজ করল। এক সৈনিকের কাছ থেকে অস্ত্র চেয়ে নিয়ে সেই আমগাছের গুঁড়িতে ছোট্ট করে খোদাই করে লিখল, 'তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে'

পরদিন সেই বুড়ি কোথা থেকে হাজির। আমগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজকুমারীর লেখাটি পরল। তারপর বলল, হুম! এতদিনে তোমার শাপমুক্তির সময় হয়েছে। ঝোলা থেকে বাঁশি বের করে ফুঁ দিল সেই বুড়ি। দেখতে দেখতে আমগাছের ডালপালা উধাও হয়ে গেল। ময়ূর অবাক হয়ে দেখল, সে এক সুপুরুষ মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। গায়ে ঝকমকে পোশাক। বুড়ি বলল, রাজকুমারী ফুলমতি তোমার অপেক্ষায় আছে।

সারাদিন পথ হেঁটে ময়ূর পৌঁছাল সুবর্ণনগরের রাজপ্রাসাদে। রাতের মতো বিশ্রাম চাইল রাজার কাছে। রাজার অতিথিশালায় দরাজ ঠাঁই মিলল। এরপর সারাদিন পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য রাজপ্রাসাদের বিশাল পুকুরে স্নান করতে গেল ময়ূর। এখন সে নাম নিয়েছে ময়ূরবাহন। রাজপ্রাসাদের অলিন্দে সখীদের সঙ্গে গল্প-গুজব করছিল রাজকুমারী ফুলমতি। ময়ূরের পিঠে লেখাটি ঠিক নজরে পড়ে গেল ফুলমতির। চমকে ওঠে সে এ-কী করে সম্ভব! একথা কটি সে তো লিখে এসেছিল আমগাছের গুঁড়িতে। রক্ষীদের দিয়ে তখনই ডাকিয়ে আনল রাজকুমারী। জানতে চাইল, ওঁর পিঠে এমন লেখা কি করে এলো?

ফুলমতিকে দেখামাত্র ময়ূরবাহন চিনতে পারল। মিষ্টি হেসে সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি শাপগ্রস্ত হয়ে আমগাছ হয়েছিলাম। এখন শাপমুক্তি হয়েছি। আর তা সম্ভব হয়েছে তোমার এই লেখাটির জন্য। তোমার প্রশংসায় আমি নতুন জীবন পেলাম।

রাজকুমারী ফুলমতি লজ্জা পেয়ে যায়। খিল্ খিল্ করে হেসে ওঠে ওর সখীরা।

সুবর্ণগরের রাজা সব ঘটনা জানার পর ময়ূরবাহনের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে দিল ধুমধাম করে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১১

 

Topic :   ছোটোদের রূপকথার গল্প, বুড়িমা ও ময়ূেরর গল্প, Fairy tails for children and Kids, Best story of children, Story of the old Woman and Peacock

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ