Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কিডন্যাপ ।। গোপাল দাস




আইপডটা নিয়ে বেশ খুশি খুশি মনে অনিশ স্কুলে আসছিল। নতুন জিনিসটা বন্ধুদের দেখাবে। ওরা নিশ্চয়ই চমকে যাবে ভেবে মনে মনে হাসছিল। স্কুলের কাছাকাছি এসে গেছে, সেই সময় ওর মনটা সজাগ হয়ে উঠল। রাস্তার পাশে ঘন বনের মধ্যে একটা বড়ো গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ওর একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সবসময় কাজ করে।

মনিরামপুর মাল্টিপারপাস স্কুলে সকালে মেয়েদের স্কুল হয়। সামনের বড়ো রাস্তা দিয়ে সবাই যাওয়া-আসা করে। এই সরু কাঁচা রাস্তায় কেউ আসে না। এক ঘন্টা আগেই বাড়ি থেকে বেরোয়। ওর বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে বড়োজোর পনেরো মিনিট সময় লাগে। আসলে ও দেখতে দেখতে আসে, কোন গাছে আম পেকেছে, হনুমানগুলো আছে কিনা, গাছের কোটরে পাখির ডিমটা ফুটল কি না ইত্যাদি। এইভাবে দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে ও যখন স্কুলের প্রায় সামনে এসে পড়েছে, দেখতে পেল গার্লস স্কুলের ড্রেস পরা ছোট্ট একটা মেয়েকে কারা যেন পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলেছে।

একটা ছোট্ট গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। লোকগুলোর হাবভাব ওর ভালো লাগল না। ও পকেট থেকে গতকাল জন্মদিনে মামার দেওয়া আইপডটা বের করে গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ছবি তুলতে থাকল। ওরা দেখতেও পেল না যে ওদের ছবি আইপডে উঠে গেছে।

সেবার, মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যাচ্ছিল অনিশ। ট্রেনটা আসতে দেরি। দেখল অনেকক্ষণ ধরে একটা কালো ব্যাগ রাখা আছে টিকিট ঘরের বাইরে এক কোণে। সকলের যাচ্ছে-আসছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। ও টিভিতে দেখেছে, যে একজন পুলিশের লোক বলছে, কোনো জায়গায় ব্যাগ বা ওই জাতীয় জিনিস অনেকক্ষণ পড়ে থাকলে পুলিশকে খবর দিন। ব্যাপারটা ব্যাগটা দেখে ওর কেমন সন্দেহ হল। ওই দূরে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ও ছুটতে লাগল পুলিশটার দিকে। ভাবলো, কি বলে ডাকবে। ও শুনেছিল পুলিশও নাকি মামা হয়। সূর্যঠাকুরকেও মামা বলে, চাঁদও মামা। এঁরা সকলেরই মামা। তাই ও মামাই বলবে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছল পুলিশ মামার কাছে। বলল, মামা, ওখানে একটা কালো ব্যাগ অনেকক্ষণ ধরে পড়ে রয়েছে। পুলিশ মামা প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল তখন ওকে সঙ্গে নিয়ে সেই ব্যাগটা দূর থেকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে কাকে যেন কী বলল। তারপর ওর পিঠ চাপড়ে দিল। ওর ঠিকানা নিল, তারপর ও দেখল বেশ কয়েকজন পুলিশ এল। সকলকে স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার জন্যে মাইকে বলল। একটা ভ্যান থেকে এক বিশেষ ধরনের লোহার স্টিক, মিটার ইত্যাদি নিয়ে নামল আর খুব সাবধানে ব্যাগটা পরীক্ষা করতে লাগল। ব্যাগটার ভেতর নাকি বোমা ছিল। ওরা বোমটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিল। কাগজের লোকেরা ওর ছবি নিয়েছিল। একটা কাগজে লেখা হয়েছিল, অনেকের মতো সকলের সজাগ হওয়া উচিত।

গাড়িটা চলে যাওয়ার পর ও আবার রাস্তায় নেমে স্কুলে পৌঁছল। স্কুলের সব বন্ধুদের দেখাল ওর আইপডটা। সকলে খুব আনন্দ পেল। অনিশ শুধু গতকাল জন্মদিনে তোলা ছবিগুলো দেখাল। আজকের ঘটনার কথা কাউকে বলল না। ঘটনার যে রহস্য আছে ও প্রথমটায় না বুঝলেও পরে বুঝেছে। আনন্দের বসে ছবিগুলো তুললেও বন্ধুদের দেখাল না। আসলে অনিশ আর সবাই-এর মতো নয়। ওর বুদ্ধিটা একটু অন্যরকমের, বলা যায় ইন্টেলিজেন্ট ছেলে।

মায়ের মুখে একটা খবর শুনে ও অবাক হয়ে গেল। পাশের পাড়ার রমাকান্তকাকুর মেয়েকে কে বা কারা কিডন্যাপ করেছে। ফোনে নাকি বলেছে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। ৪৮ ঘণ্টা সময়। এই সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে মেয়েকে ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না। মেয়েটার কান্নাও নাকি ওরা ফোনে শুনিয়েছে। বলেছে পুলিশকে জানালে ওরা মেয়েকে মেরে ফেলবে কোনরকম চালাকি যেন না করে। হোগলামাটি বলে গ্রামের প্রান্তে একটু ঘন জঙ্গল আছে। ওখানে কেউ যায় না। ওখানে গিয়ে টাকাটা জমা দিয়ে আসতে হবে। একজনই যাবে। টাকাটা পেয়ে গেলেই মেয়েকে ছেড়ে দেবে।

রমাকাকুর ব্যবসা আছে। কিন্তু ১০ লাখ টাকা আছে কিনা অনিশ জানে না। অনিশ এবার নিশ্চিত হয়ে গেল ওরা কারা ছিল। কিন্তু ও কাউকে কিছু বলল না। ওর মা বলল, ১০ লাখ টাকা দিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনাই ভালো। পুলিশে খবর দিলে হয়তো মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। আর তাছাড়া পুলিশ হদিশ পেতে পেতে ৪৮ ঘন্টা কেটে যাবে।

রমা কাকুর বউ নাকি সেই যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার এসেছে। রমাকাকু থানায় যাননি। খুবই ছোটাছুটি করছে টাকা জোগাড় করার জন্য। আজ ওর বাংলা ক্লাসের কথা মনে পড়ল আজ বাংলা স্যার ওদের একটা ভাব সম্প্রসারণ লিখতে দিয়েছিলেন- অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে

আনিশ ভাবতে লাগল কি করবে। থানায় গিয়ে পুলিশকে আইপডের ছবিগুলো দেখালে হত কিন্তু যদি কিছু খারাপ হয় তখন রমাকাকু, এমনকি সকলেই অনিশকে দোষ দেবে। দোটানায় পড়ে গেল।

সারারাত আনিশের চোখে ঘুম নেই। ২৪ঘন্টা কাটবে কাল সকালেই। নাকি টাকা যোগাড় করে উঠতে পারেননি এখনও। রাত দুটো বাজল। তিনটে বাজল। অনিশ আর শুয়ে থাকতে পারল না। আস্তে আস্তে ও বিছানা থেকে উঠল সদর দরজাটা নিঃশব্দে খুলল।

দরজা খুলে নিশিকান্তকাকু অনিশকে চিনতে পারলেন। বললেন, তুমি এত রাতে!অনিশ বলল, ভেতরে চলুন সব বলছি। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল আইপডটা।

সকালবেলা প্লেন ড্রেসে একজন পুলিশ অফিসার ও থানার একজন অফিসার ওর বাবার কাছে এসে কি সব বলল। বাবা তো প্রথমে হকচকিযয়ে গেছিল।অনিশকে ওরা নিয়ে গেল। ও পরে জেনেছিল প্লেন ড্রেসের পুলিশ অফিসারটি সিআইডি অফিসার। অনিশ দেখল সিআইডির কম্পিউটারে অনিশের আইপডের ছবিটা স্পষ্ট হযে উঠল। ওরা অনিশের খুব প্রশংসা করতে লাগল। ওরা বলল, তোমার কোনো ভয় নেই, আমরা পুরো গ্যাংটাকেই ধরে ফেলব। একটা অ্যাম্বাসেডারে করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিল। বলে দিল কাউকে কিছু যেন না বলে।

রমাকাকু ১০লাখ টাকা জোগাড় করতে পেরেছেন। আজ সন্ধ্যেবেলায় হোগলামাটি জঙ্গলে টাকাটা দেবেনো। ওরা নাকি বলেছে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকেও ফিরিয়ে দেবে। ফোনেতে ওরা কখন, কোথায় যেতে হবে বলে দিয়েছে।

রমাকাকু একাই জঙ্গলে গেলেন ১০ লাখ টাকা নিয়ে। সুটকেস ভর্তি টাকা। ধার-দেনা করে টাকা জোগাড় করলেও রমাকাকু ভাবলেন, আমার মেয়েটা তো বাঁচবে! তিনি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ালেন। আধ ঘন্টা হয়ে গেল কারোর দেখা নেই! সন্ধে হতেই হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে একজন সামনে এসে হাজির। আস্তে আস্তে বলল, টাকা সব ঠিক ঠিক আছে তো? রমাকাকু বললেন, গুনে দেখুন। আমার মেয়ে কই?

রমাকাকু দেখলেন, মুখ-হাত বাঁধা অবস্থায় আধমরা মেয়েকে। মেয়েকে দেখে ওঁর চোখ জলে ভিজে গেল। মেয়েটাও খুব কাঁদছে, কিন্তু কোনো শব্দ করতে পারছে না। লোকটা রমাকাকুর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলল, কোনো কথা নয়, আস্তে আস্তে চলে যান। নাহলে গুলি চালাব।

রিভলবারটা পকেটে ঢুকিয়ে টাকার স্যুটকেসটা নিয়ে পেছন ফিরতে গিয়েই লোকটা দেখল ৫-৬ জন তাকে নিঃশব্দে কখন ঘিরে ধরেছে। তাদের সকলের হাতে উদ্ধত রিভলবার। একটা পুলিশের লোক এসে লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

রমাকাকু হতবাক। ভাবলেন, পুলিশ কোথা থেকে এল! আমি তো খবর দিইনি! ডিএসপি নিশিকান্তবাবু বললেন, অনিশের জন্যই আজ আপনি মেয়েকে ফিরে পেলেন। এমন সাহসী ছেলেরাই তো আমাদের দেশের গর্ব।

 

অলংকরণ - অমর লাহা

প্রকাশিত - ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

 

Topic : রহস্য গল্প, গোয়েন্দা গল্প, অপহরণের গল্প, সাহসিকতাকার গল্প,  কিডন্যাপের গল্প,  Mystery Stories, Detective Stories, Abduction Stories, Adventure Stories, Story of the kidnapping, ছেলেবেলার গল্প, শারদীয়ার গল্প, বাংলা গল্প, Best Bengali story, Bangla golpo

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ