Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

গল্প বলা ব্যাঙ ।। কণিকা পালমাজি

 



কোলাব্যাঙটা এতদিন কোথায় ছিল কে জানে। টুকাই তার টিকিটাও দেখেনি। সারাক্ষণ বৃষ্টিতে এই দুদিনে বাগানে জল জমেছে কত। খুঁড়ে রাখা গর্তটা চারপাশের মাটি ধুয়ে টইটুম্বুর। আর তাতেই এসে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে ব্যাঙটা। শুধু বসে থাকলেও নয় কথা ছিল। সারাদিন চলে ওর বকর-বকর, গ্যাঙর-গ্যাঙর, কটকট, ক্যাটক্যাট, কোঁককোঁক- কত রকম ডাক যে জানে।

বৃষ্টি থামতে তর সয় না টুকাইযের। বাগানে গিয়ে কোমড় ঝুঁকিয়ে ঘাড় নিচু করে কোলাব্যাঙকে খোঁজে। বলে- ও কোলাব্যাঙ, একটা গল্প বলো না।

উত্তরে কোলাব্যাঙ গ্যাঙর-গ্যাঙর করে যা বলে, দেখে মনে হয় টুকাই বুঝি সব কথাই বুঝল ওর।

সন্ধের অনেকটা আগে টুকাই নিজের ছোট্ট মোড়াটা নিয়ে এসে বসল বাগানে। এই সময়টা পাখিগুলো ঘরমুখো হয়। গাছের পাতার আড়ালে যে যার মতো জায়গা খুঁজে নেয়। একমাত্র কোলাব্যাঙটাই তখন ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে রইল টুকাইয়ের দিকে। ছোট্ট মেয়েটা কি ভালোই না বাসে ওকে। বড়োরা তো পাত্তাই দিতে চায় না। অথচ কোলাব্যাঙের সাতগুষ্টির পরিচয়টা যদি ওরা জানতো। কি রমরমা অবস্থাই না ছিল তখন। বটতলার পাশের পুকুরে নির্ভাবনায় দিন কাটে ব্যাঙেদের। কারো খাবার ভাবনা নেই। যত খুশি পোকা ধরো আর খাও। একপুকুর জলে ইচ্ছেমতো সাঁতার কাটো। বেশ কাটে। দিনগুলোয় আনন্দের ঘাটতি হয় না এতোটুকুও।

বেশ তো গল্পটা। টুকাই মন দিয়ে শুনছিল। এবার বলে, কিন্তু কোলাব্যাঙ তুমি সেই সুন্দর পুকুরটা ছেড়ে এখানে কেন এলে বল তো?

-ওমা! এলাম বলেই তো তোমার মতো এমন মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল।

-সেটা একটা কথা হল। থাক, এবার বাকিটা বল।

-বাবার মুখে শুনেছি, একদিন ব্যাঙধরা লোকেরা কি করে যেন জেনেছিল বটপুকুরের কথা। তারপর রোজ রাত্তিরে আলো জ্বেলে থলি নিয়ে গোটা পুকুরের পাড়ে ঘুরে বেড়াত। কত ব্যাঙ যে বন্দি হল ওদের থলিতে, তার ঠিক নেই। অনিশ্চিত জীবন কাটাত ভয়ে ভয়ে। এদিকে চারপাশে নোংরা পড়ে পুকুরের জল ঘুলিয়ে উঠেছে। সাঁতার দিতে ইচ্ছে করে না। খাবার জোটানো আরো সমস্যা। গাছে, ফসলের ক্ষেতে ছিটিয়ে দিয়েছে পোকামাকড়ের ওষুধ। বিষলাসা পোকা জিভে ফেলে সারা শরীরে অস্বস্তি আর জুলুনি হল কত ব্যাঙের। শেষ পর্যন্ত যারা ছিল তারা পালিয়ে বাঁচল। মাটি ফেলে বোজানো শুরু হল। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, চলে আসতে পেরে ভালো কাজ করেছে কি না।

-বেশ করেছ, থাকো না তবে। মুড়ি দেবো, ভাত দেবো। বিষলাসা পোকা তোমায় খেতে হবে না। আর দুষ্টু লোকেরা যদি আসে বাবাকে বলে তাদের তাড়িয়ে দেবো আমি।

-আহা-হা! মনটা তোমার বড্ড ভালো।

বলে কোলাব্যাঙ কোঁক-কোঁক করে খানিক ডাক ছেড়ে ডুব দেয় জলে।

রাত্রে খাবার টেবিলে মা-বাবাকে কোলাব্যাঙের গল্পটা বলার জন্য উসখুস করছিল টুকাই। যদিও জানে শোনার পরে বাবা মুচকি মুচকি হাসবে। আর মা বলবে, গল্পের রাজ্যেই থাকো রাতদিন। পড়াশোনা করতে হবে না।

তবুও না বলে থাকা গেল না। টুকাই বলে বেশ গুছিয়ে। মন দিয়ে শুনছিল সবাই। গল্প প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় টেবিলের তলায় একটা কিছু লাফিয়ে টুকাইয়ের পায়ের ওপর পড়ল। ও লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই, বাবা নিচু হয়ে দেখে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোর গল্প শুনে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করতে একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে।

টুকাই এঁটো হাতে উঠে এসে অবাক হয়ে যায়। এই রাত্তিরে কোলাব্যাঙ জল ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকেছে।

-আরে, ঘরের আলোতে যেসব পোকামাকড় আসে সেগুলো খাবে বলে এসেছে। বুঝেছিস।

বাবার কথা মানতে মন চায় না। টুকাই ভাবছিল কাল বরং কোলাব্যাঙের কাছে জেনে নেওয়া যাবে কারণটা। তবে এসেছে যখন, থাকুক না ঘরের ভেতরে। কিন্তু সে কথা শুনছে কে! মা ফুলঝাড়ু যার হাতে তাড়া দেয়। ব্যাঙ বড়ো বড়ো লাফে সারা ঘরময় এদিক থেকে ওদিক যায়। টেবিলের পায়ায়, শো-কেসের তলায়, জলের বালতির ঢাকায়, জানলার পাল্লায়- এমনি করে ঘরের প্রায় প্রতিটা জায়গায় তার ঘোরা হল। তবু দরজার দিক মাড়ায় না। কোলাব্যাঙ যাবে না কিছুতেই। টুকাইকে না বলা কথাটা যে জানাতেই হবে। জানাতে এসে যে এমন ফ্যাসাদ হবে তা কে জানতো! ধুর-ধুর টুকাইয়ের মা-টাও এমন। যেন পণ করেছে, কোলাব্যাঙ তাড়িয়ে তবে ছাড়বে। এবার জানলা থেকে লম্বা লাফে কোলাব্যাঙ টুকাইয়ের জামায় এসে পড়েছে। খপ করে জামাসুদ্ধু ধরে ব্যাঙটাকে মায়ের কথা মতো বাগানে ছেড়ে দিতে গেল টুকাই। এতক্ষণে সুযোগ এলো কোলাব্যাঙের। মা-বাবার সামনে যে কথাটা বলা যাচ্ছিল না, টুকাইকে এবার সেটা বলে দিল গাঁক-গাঁক করে।

-আমার গল্পটা ইচ্ছে হলে তোমার বন্ধুদের শুনিও। মা-বাবারা কিছু বোঝে না।

-এটা অবশ্য খাঁটি কথা। টুকাই এককথায় মানতে রাজি।

-খাঁটি কথা আরো আছে।

-বলো কি!

-সেটাই তো বলতে চাইছি।

বাবারে! কোলাব্যাঙ এবার জ্ঞানের কথা শোনাবে নাকি! এ পর্যন্ত যা বলছে, তাতে পুকুর বোঝানোর কথা আছে, জল খারাপ হওয়া, বাতাসে বিষ ছড়ানো- মিলিয়ে-মিশিয়ে বেশ বলেছে। এসব কথা টুকাই বইয়ে পড়েছে- বিজ্ঞান বইতে গাদা-গাদা, বাংলা বইয়ের কবিতা-গল্পে, এমনকি রচনাও লিখতে হয়েছে ক্লাসে। যেসব এবার একটা ব্যাঙের কাছে যদি শুনতে হয়! চিন্তিত টুকাইকে অবাক করে দিয়ে কোলাব্যাঙ হাসলো। ঠোঁট টানটান করা এক মুখ হাসি। সহজ-সরল কথাটা খুশির সঙ্গে বলে দিল টুকাইকে- আসল কথাটা হল, তোমার মতো কেউ কেউ আছে বলেই এখানে টিকে আছি।

-ধ্যুত কি যে বলো না। লজ্জা পেয়ে টুকাই আলতো করে ওকে ছেড়ে দিলে বাগানে। ঘুরে ফিরে বারকয়েক লাফ দিয়ে কোলাব্যাঙ ঘাসপাতার আড়ালে মিশে গেল।

 

অলংকরণ-­­ অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা। জানুয়ারি ২০১৯

 

Topic : সামাজিক গল্প, সহমর্মীতার গল্প, ব্যাঙ ও ছোট্ট মেয়ের গল্প, Social stories, stories of empathy, stories of frogs and little girls, Best story for Children

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ