রতন একটা ভালো বুদ্ধি বের করেছে। ঠিক স্কুলে যাওয়ার আগে মাঠ থেকে ঘরে ফিরে আসে, স্নান করে, তারপরেই পেট ধরে বসে পড়ে। মা গো! বাবা গো! গেলাম গো! বলে চিৎকার করে।
মা হাতের কাজ ফেলে আসে। কি হল তোর?
পেটে ব্যথা করছে। মা গো! বলে, সে কাঁদার চেষ্টা করে কিন্তু চোখে জল আসে না।
এদিকে মায়ের চোখে জল চলে আসে ছেলের কষ্ট দেখে। মা লেবুর জল করে আনে, গ্যাসের ওষুধ আনে। মাত্র আধ ঘন্টা কসরতের পর মা যখন ভাবে ছেলে সুস্থ হয়ে উঠেছে তখন স্কুলে ঢোকার সময় পেরিয়ে গেছে।
বেচারা রতন সেজন্য আবার খেলতে চলে যায় মাঠে। খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে আবার ফিরে আসে দুপুরবেলা। খেয়ে দেয়ে আবার খেলতে বেরোয়।
রতন কাউকে ভয় পায় না। একমাত্র বাবাকেই সে ভয় পায়। বাবা একবার ধরলে সহজে ছাড়ে না। মারতে মারতে যতক্ষণ না পিঠের ছাল তুলে দিচ্ছে ততক্ষণ থামবে না।
ক্লাস ফাইভে সে ফেল করেছিল বলে মেরেছিল। সেই মার এখনও মনে আছে তার। এখন করে সে তাই বাবা ঘরে ঢোকার আগেই ফিরে আসে। আর সহজ-সহজ পড়াগুলো নিয়ে বসে এক-দেড় ঘন্টা। পরে মাকে বলে, ঘুম পাচ্ছে। খেতে দাও।
মা খেতে দিলেই হল। বইপত্র তুলে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেলেও সে চোখ খোলে না। বাবার সামনে ঘুম থেকে ওঠা মানে পড়তে বসা। সে জন্য সে অপেক্ষা করে, বাবা কখন বেরোবে ঘর থেকে।
বাবা একবার কাজে বেরিয়ে গেলে আর কাউকে পরোয়া করার থাকে না। বেরিয়ে যায় খেলতে।
সব ছেলেরাই তো আর সবসময় পড়ছে না। কেউ কেউ গুলি খেলে তাদের সঙ্গে ভিড়ে যায়। তার একটা কৌটো আছে। তাতে এক হাজারের মতো গুলি আছে। সে সবসময় যে গুলি খেলে এমন নয়। বাঁশ বাগানের পিছনে যে বড় পুকুর আছে তাতে ব্যাঙ্গাচিও খেলে। ইট পাটকেলের টুকরো নিয়ে কায়দা করে ছেড়ে দিলে জলের ওপর লাফাতে পারে ইট পাটকেলে। তাই নিয়েই প্রতিযোগিতা। কিংবা কোনো খেলা না খেলে বাদায় ঘুরে ঘুরে শামুক খোল জোগাড় করে কোনোদিন। তা দিয়ে বাঁশি বানায়। আমের আঁটিতো আর সবসময় পাওয়া যায় না।
রতনের মনে হয় স্কুল, পড়াশুনো এসব না থাকলেই ভালো হত। কোনো ঝামেলা থাকত না। রতনদের স্কুলের মাস্টারমশাই নৈনানে থাকে। খেয়া পার হয়ে আসে এপারে। রতনের বাবা শম্ভু পর্বতকে চেনে। সেদিন বলে গেল ছেলের দিকে একটু নজর দাও বন্ধু। ঠিক মতো পড়াশোনা করত না আগেও। এখন করে স্কুলেও আসছে না। এরকম চললে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ছোটো ছেলে বুঝতে পারছে না, কী যুগ পড়েছে। বেলা শেষে বুঝলেও কোন কূল খুঁজে পাবেনা।
ছেলে স্কুলে যাচ্ছে না, এ কথা জানত না শম্ভু। শোনার পর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন কাজে মন বসাতে পারল না। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, রতন কদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না শুনলাম। ব্যাপার কি? রতনের মা বলল, স্কুলে যাবে কি করে? সকালে ওর পেটে খুব ব্যথা হয়।
রাগে গজরাতে গজরাতে শম্ভু বললো, ব্যথা না ছাই। পেটে ব্যথা নিয়ে সারাদিন করে খেলতে পারছে, আর স্কুলে যেতে পারছেনা? ব্যাথায় মরে মরুক। এবার থেকে জোর করে স্কুলে পাঠাবে ওকে।
শম্ভু তার স্ত্রীর ওপর আরো বেশি তর্জন গর্জন করে। কোনো কিছুতেই কোনো ফল হয় না। রতন শুধু ফাঁকি দিয়ে খেলে বেড়ায়।
শম্ভুর বন্ধু খালেদ কদিন লক্ষ্য করছে শম্ভুর মোটেও কাজের দিকে মন নেই। কাজে হাজিরা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালাই পালাই করে ডাক্ ছাড়ে।
দামোদরের চরে রোদ পড়েছে। পিঠ পুড়িয়ে দেওয়া রোদ। নদ খুবই সংকীর্ণ। এখন ভাটা। সূর্যের আলো পড়ে সেই নদ থেকেই চোখ ধাঁধানো আলো ঠিকরাচ্ছে।
মাটি কাটার কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমের। খালেদ জানে একবার কাটার ছন্দটা ধরে ফেললে টানা দু-তিন ঘন্টা একমনে কাটা কোনো ব্যাপার নয়। কোদালে মাটি তুলে ঝুরিতে ভরতে গিয়ে সে দেখল, শম্ভুর ঝুড়িটা দু-হাত দুরে বসানো। অন্য কেউ হলে সে এতক্ষণে গাল পেরে উদ্ধার করে দিত। শম্ভু বলেই সে কোদালটা নামিয়ে রাখল। তারপর শম্ভুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর? কি ভাবছিস?
শম্ভু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না না, কিছু ভাবছি না। খালেদ বলল, আমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। সত্যি করে বলতো ঘরে ঝগড়া করেছিস?
শম্ভু জিভ কেটে বলল, না না, ও কিছু না। শম্ভু এড়িয়ে যেতে চাইলেও খালেদ তাকে ছাড়লনা। শেষে শম্ভু মুখ খুলল। আমার ছেলেটাকে নিয়েই যত অশান্তি। মোটে পড়তে বসে না। সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়, লেকের আদারে বাদারে। স্কুলে যাচ্ছে না আজকাল। খালেদ বলল, তুমি ছেলেকে ধরে রাখতে পারো না?
আমিতো সারাদিন এখানেই থাকি। ছেলেকে আটকাবো কি করে? বলে শম্ভু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
খালেদ জিজ্ঞেস বৌদি কী করে?
শম্ভু বলল, তার এককথা। ছেলে কখন, কোন ফাঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তা টের পায় না সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইচ্ছে হয় ঘা-কতক দিতে। এমন বেয়াড়া ছেলে, আটটা-নটা পর্যন্ত ঘুমোয়। ঘুমন্ত ছেলেকে মারতে মন সায় দেয় না।
খালেদ বলল, কোনো চিন্তা করিস না আর ওসব নিয়ে। সব ঠিক হয়ে যাবে। শম্ভু অবাক। সব ঠিক হয়ে যাবে!
খালেদ বলল, হ্যাঁ। কাল তোর ছেলেকে নিয়ে আসবি এখানে। আমি তাকে বুঝিয়ে বলব।
শম্ভু তবুও ভরসা পায় না। বলে, বুঝিয়ে বলে কোনো লাভ নেই রে ভাই। অনেক বুঝিয়েছি আমি। বোঝানোর কিছু বাকি রাখিনি। ও ছেলে কিছুই শোনো না। আর কাল যে ওকে নিয়ে আসতে বলছিস, আমার সঙ্গে আসতে হবে জানতে পারলে সে হয়তো ভোররাতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে।
ঠিকাদার ওদের অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতে দেখে হাঁক দিল, ঘরে গিয়ে গল্প করবি, এখন কাজ কর।
ওরা আবার যে যার কাজে মন দিল। কাজে মন দিলেও শম্ভুর চিন্তাটা খালেদের মাথা থেকে গেল না। দুপুরবেলা খেতে বসে খালেদের মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। বলল, শোন শম্ভু তুই তো প্রতিদিন ঘর থেকে খাবার বেঁধে আনিস কাল আনবি না। বৌদিকে বলবি ছেলের হাত দিয়ে খাবার পাঠাতে।
শম্ভুর মনে সন্দেহ, ছেলে আসবে!
-আসবে, আসবে। খাবার না পৌঁছলে বাবা খেতে পারবে না জেনে সব ছেলেই রাজি হবে আসতে।
পরেরদিন কাজে বেরোবার সময় শম্ভু খাবার নিল না। খাবার বলতে- পান্তা ভাত, পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, পান্তা বেঁধে নিলে না কেন? শম্ভু বলল, দুপুরবেলা পান্তা খেয়ে আলসেমি চলে আসে শরীরে। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাজ করতে মন সায় দেয় না। মনে হয় শিবগঞ্জের ঘাটে গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকি। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। তুমি বরং রতনের হাত দিয়ে গরম গরম চারটি ভাত পাঠিয়ে দিও।
রতন প্রতিদিনের মতো সারা পাড়া ঘুরে খেতে এল দুপুরবেলা। তাকে খেতে দিয়ে মা বলল, তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। খেয়ে নিয়ে তোর বাবাকে ভাত দিতে যাবি।
রতন আঁতকে উঠল, বাবা ভাত নিয়ে যায়নি?
মা বলল, না এদিকে বেলাও অনেক হল। তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আজ রতনের আঁতকে ওঠার একটা বিশেষ কারণ আছে। তিনটে থেকে শ্যামপুরে কামদেবপুরের সঙ্গে গড়চুমুকের একটা টিমের ফাইনাল ফুটবল ম্যাচ। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে তার খেলা দেখতে যাবার কথা আছে। একটু গড়িয়ে নিয়ে সে দেখতে যাবে ভেবেছিল।
বাবার জন্য খাবার নিয়ে সে ভাবল, বাবাকে খাবারটা পৌছে দিয়েই পালাবে। বাতাসে যেন আগুনের হল্কা। একটুও হেঁটেই হাঁপিয়ে উঠল সে। ইঁটখোলার বটগাছের ছায়ায় এসে সে দেখল কাজ চলছে পুরোদমে। কেউ বসে নেই। চর থেকে একজন পলি তুলে তার বাবার ঝুড়িতে তুলে দিচ্ছে। বাঁক কাঁধে নিয়ে তার বাবা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে সেই পলি পৌঁছে দিয়ে আসছে মিস্ত্রিদের কাছে। সেখানে চলছে আবার ইঁট তৈরীর কাজ। মাটি ঠেসে ছাঁচে ফেলে পরপর সাজিয়ে যাচ্ছে কয়েক জন।
এইরোদে বাবাকে এ রকম পরিশ্রম করতে দেখে রতনের খুব কষ্ট হল। তার বাবা ঘামে ভিজে গেছে তবুও থামার কথা ভাবছে না। খালেদ কোদাল ফেলে রতনের কাছে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, স্কুলে যাওনি? রতন বলল, না, যাইনি। বাবার জন্য খাবার এনেছি।
খালেদ হেসে বলল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কেমন লাগছে আমাদের কাজ দেখতে? রতন বলল, ভালো লাগছে না। এই রোদে বাবা এত খাটছে। খালেদ তার পিঠে চাপড় মেরে বলল, এ আর নতুন কি রতন! তোমার বাবা তোমাদের জন্য এ রকমই পরিশ্রম করছে চিরকাল। তোমাদের যাতে খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়। তুমি যাতে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারো। এসব কথা ছাড়ো। এবার বল তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
রতন কিছুই বলল না। মাথা নিচু করে নিল।
পরের দিন ভোরবেলা শম্ভুর ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হল, শীতের সকালের মিষ্টি রোদ খেলে বেড়াচ্ছে তার ঘরে। সে দেখল হারিকেনের আলোয় রতন এক মনে পড়ছে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ-১৪১৫
Topic : ছোটোদের শিক্ষামূলক সামাজিক গল্প, দুষ্টু ছেলের বদলে যাওয়ার গল্প, Educational social stories for children, The story of naughty boy's change. Children's best story.
0 মন্তব্যসমূহ