হাড় কিপটে। তাই সবাই তাকে ডাকে কিপটেচরণ নামে। তার বাপ-মায়ের দেওয়া আসল নাম সে নিজেও আজকাল আর মনে করতে পারে না।
কিপটেচরণের অন্য কোনো শখ নেই। তার একটাই শুধু শখ টাকা জমানো। সেই টাকা জমতে জমতে পাহাড় না হলেও ছোটখাটো একটা ঢিপি যেন হয়।
টাকা থাকলেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং চোর-বাটপারদের নজর পড়বেই। তাই সব টাকা বস্তায় ভরে ঘরের চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছে সে। তাতেও তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই! চোরের ভয়ে রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারে না। ঘরের মধ্যে ইঁদুর ছোটাছুটি করে, খুট খাট শব্দ হয়, আরশোলা ওড়াউড়ি করে, ফরফর শব্দ হয়। সামান্য শব্দেও ঘুম ভেঙে উঠে বসে কিপটেচরণ। কেবলই তার মনে হয়, এই বুঝি কেউ দেয়ালে সিঁদ কাটছে, এই বুঝি চোর ঘরে ঢুকল, এই বুঝি চোর পা টিপে টিপে চোরা কুঠুরির দিকে যাচ্ছে।
মাঝরাতে কেরোসিনের লম্প জেলে ঘরের চারপাশে খোঁজাখুঁজি করে। হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলাটাও তন্ন্ তন্ন করে দ্যাখে। চোরের দেখা না পেলেও নিশ্চিত হতে পারে না। টাকার বস্তা খুলে জমানো টাকা একটা একটা করে গুনতে বসে।
সব ঠিক থাকলে– আবার ঘুমোতে যায়। কিন্তু দুশ্চিন্তায় তার ঘুম আসে না। বাকি রাতটুকু জেগেই কাটায়।
কিপটে চরণ লোকটা মোটেই বোকা নয়। অনেক ভাবনা চিন্তা করে সে একটা ফন্দি আঁটল। জমানো টাকার বিনিময়ে সে একটা সোনার বাট কিনল। টাকার বস্তার তুলনায় সোনার বাটের আয়তন অনেক কম। তাই লুকিয়ে রাখার পক্ষে খুব সুবিধে।
চোর, বাটপার সবার নজর তার ঘরের দিকে। তাই তাদের নজর এড়াতে সে সোনার বাটটা লাল শালু কাপড়ে মুড়ে পুঁতে রাখল বাগানের সবচেয়ে বুড়ো আমগাছটার নিচে।
কিপটেচরণ এই ভেবে নিশ্চিন্ত হল যে ব্যাপারটা কেউ আঁচ করতেও পারবে না। সোনার বাট থাকবে নিরাপদে।
বাইরে আম গাছের নীচে সোনার বাট আর ঘরে কিপটেচরণ। সে নিজে নিশ্চিন্ত হতে পারছে কই! সারাক্ষণ সে উসখুস করে। সব ঠিকঠাক আছে তো? কেউ নিয়ে পালায়নি তো? বারবার সে ছুটে যায় আম গাছের নীচে। চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করছে কিনা। দিনেরবেলা তো বটেই, রাতের বেলায়ও সে বারকয়েক গিয়ে আমগাছের তলাটা ভালো করে দেখে আসে।
একদিন কিপটেচরণ সকালে উঠে দেখল, আমগাছের নিচে কেউ শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ছে। গর্তের মধ্যে লাল শালুটা পড়ে আছে কিন্তু সোনার বাট উধাও। সারা জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে সে হায় হায় করতে লাগল। বুক চাপড়ালো, মাথার চুল ছিঁড়ল।
কিপটেচরণের দুরবস্থা দেখে পাড়াপড়শির মনে মনে খুব খুশি হলেও বাইরে লোক দেখানো সহানুভূতি জানাতে লাগল। অনেক মন্দ লোকের মাঝে দু-একজন ভালো লোকও থাকে। তাদের একজন তাকে পরামর্শ দিল থানার বড়োবাবুর কাছে যেতে। একমাত্র তিনি পারলেও পারতে পারেন চুরি যাওয়া সোনার বাট উদ্ধার করে দিতে।
কিপটেচরণ কেঁদে-কেটে গিয়ে পড়ল থানার বড়োবাবুর পায়ে, আমাকে বাঁচান বড়োবাবু। আমার সারা জীবনের জমানো টাকায় কেনা সোনার বাট চুরি হয়ে গেছে। আপনি উদ্ধার করে দিন, নইলে শোকে-দুঃখে আমি মরে যাব।
বড়োবাবু মন দিয়ে শুনলেন চুরির বৃত্তান্ত। তারপর সোনার বাটের চেয়েও বেশি ওজনের একটা পাথর খণ্ড কিপটেচরণকে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার সোনার বাট।
- এ তো সামান্য একটা পাথরের খণ্ড।
- খরচ না করলে টাকার কোনো মূল্য নেই। ব্যবহার না করলে সোনারও কোনো দাম নেই। তাই তোমার কাছে সোনার বাটও যা এই পাথরের খণ্ডও তাই।
- বড়োবাবু, আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
- রসিকতা নয়, কিপটেচরণ। তুমি যদি মনেপ্রাণে এই পাথরের খণ্ডটাকে সোনার বাট বলে ভাবতে পারো এবং সোনার বাটের মতো আগলে রাখতে পারো, তাহলে এই পাথরের খণ্ড একদিন সোনার বাটে পরিণত হবে।
- সত্যি হবে?
- হবেই হবে। আর যদি না হয়, তখন তুমি আবার আমার কাছে এসো।
কিপটেচরণ সযত্নে পাথরখণ্ডটা নিয়ে বাড়ি এল। নিজেকে বোঝাল, এটা নিশ্চয়ই সাধারণ পাথর নয়, মন্ত্রপূত পাথর।
সোনারবাটের মতো এবার আর আমগাছের নীচে নয়। লাল শালুতে মুড়ে পাথরের খণ্ডটা বাগানের সবচেয়ে বুড়ো কাঁঠালগাছের নীচে পুঁতে রাখল সে।
ভবিষ্যতের সোনার বাট বাগানের কাঁঠালগাছের নীচে আর কিপটেচরণ বাড়িতে। নিশ্চিন্তে সে থাকে কি করে! সারাক্ষণ তার মন উসখুস করে। সব ঠিক আছে কিনা বারবার সে কাঁঠালগাছের নীচে গিয়ে দেখে আসে। দিনেরবেলা তো বটেই, রাতের বেলাতেও।
সপ্তাখানেক কেটেছে কি কাটেনি। একদিন ভোররাতে কিপটেচরণ পা টিপে টিপে এসে হাজির হল কাঁঠালগাছে নীচে। এসে দেখল, একজন লোক কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁঠালগাছের নীচে শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ছে। তারপর গর্ত থেকে টেনে তুলল সোনার বাট ভেবে লাল শালুতে মোড়া পাথরের খণ্ডটি।
কিপটেচরণ চোর-চোর-চোর বলে চেঁচাতে যাবে, তার আগেই অন্য একজন লোক এসে লাফিয়ে পড়ল চোরের উপরে। ঘাড় ধরে তাকে টেনে তুলল, তুমি চোর সাধুচরণ না?
- বড়বাবু আপনি?
- তুমি যেমন তক্কে তক্কে ছিলে, আমিও তেমনি তক্কে তক্কে ছিলাম। তা সাধুচরণ, তুমি কি করে বুঝলে যে কাঁঠালগাছের নীচে সোনার বাট লুকোনো আছে?
- এজ্ঞে হুজুর, বারবার কাঁঠালগাছের নীচে ঘোরাঘুরি এবং উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমগাছের মতো কাঁঠালগাছের নীচেও কোনো মূল্যবান জিনিস পুঁতে রেখেছে।
- তারমানে, আমগাছের নিচে পুঁতে রাখা সোনার বাটও তুমিই চুরি করেছ।
প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। বড়োবাবু চাপ দিতেই অবশেষে চুরি কবুল করল সাধুচরণ। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার হল সোনার বাট। যেটা যথাসময়ে ফেরত পেল কিপটেচরণ।
তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। শোনা যায়, কিপটেচরণ নাকি আমূল বদলে গেছে। সে এখন অনেক দান-ধ্যান করে, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তার বাপ -মায়ের দেওয়া নামটাও মনে পড়েছে। তাকে এখন আর কেউ কিপটেচরণ নামে ডাকে না। সবাই ডাকে কৃপাচরণ নামে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২০
Topic : Funny stories for little ones, ছোটোদের মজার গল্প, Children's Best Story
0 মন্তব্যসমূহ