উত্তরবঙ্গের গরুমারা জঙ্গল। ভ্রমণ পিপাসুরা বেড়াতে আসে। ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে জন্তু-জানোয়ার দেখে। চলে যায়। আবার কেউ কেউ রাত্রিবাসও করতে চায় জঙ্গলে।
সরকার তাদের জন্য একটি কাঠের বাংলো তৈরি করল। অপূর্ব সুন্দর বাংলোটি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উদ্বোধনও হল। প্রথম দিন রাত্রিবাস করলেন। পরদিন তিনি ভূতের ভয়ে পালিয়ে গেলেন। কাঁপতে-কাঁপতে কিছুই বলতে পারলেন না কি হয়েছিল রাত্রে। মুখে কেবল ভুত-ভুত।
ভূত মানেন না এক সাহসী ভদ্রলোক বললেন, আমি থাকব। দেখব ভূত কি জিনিস। পরদিন ভোরে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। কোনো কথা নেই মুখে। শুধু গোঙানি, ভু-ত, ভু-ত।
কী ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারে না কর্তৃপক্ষ। অনেক অর্থ ব্যায়ে তৈরি। কেউ থাকতে না পারলে যে সরকারের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি। দিনেরবেলা ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখা হল, কোনো ত্রুটি নেই।
পরিতক্ত পড়ে রইল বাংলোটি। মুখে-মুখে রটে গেল 'ভূতের বাড়ি' বলে। ভাবনা হলে রাতে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায় আর অদ্ভুত শব্দ করে। চারিদিকে জঙ্গল জনবসতি নেই।
একদিন এক রুশ উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ এলেন কয়েকদিন নির্জনে বিশ্রামের জন্য। জঙ্গল ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। পরিত্যক্ত বাংলোটি দেখে মুগ্ধ হলেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। খুশি হলেন বাংলোটি দেখে। গাইড নিষেধ করল। বলল, এটা 'ভুতের বাড়ি'। রাতে থাকতে পারবেন না। ঘাড় মটকে দেব। বিশেষজ্ঞ মুচকি হাসলেন। বললেন, জিদ ধরলেন এখানেই থাকবেন বলে।
রাত আস্তে আস্তে গভীর হতে থাকল। জনমানবহীন জঙ্গল। হ্যারিকেনের অস্পষ্ট আলো। মাঝেমাঝেই জানোয়ারের ডাক। খানিক পর-পর এক অদ্ভুত শব্দ করে কেউ কাঁদছে। বিশেষজ্ঞ বুঝতে পারছেন না এ কোন জানোয়ার। গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড়। তবুও ভয় পেলেন না তিনি। ভাবলেন, কাল সকালে দেখতে হবে নিশ্চয়ই কোনো জানোয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েছে আশেপাশে। তাদেরি কান্না।
জানোয়ার কিছু করতে পারবে না। সঙ্গে অস্ত্র আছে। তাছাড়া বাংলোটি খুবই সুরক্ষিত। অনেক উঁচুতে। একে বলে 'লগ হাউজ'। ওদের পক্ষে ওপরে উঠে আসা সম্ভব নয়। হাতিও ফেলে দিতে পারবে না। মজবুত ভিত। হঠাৎই বাংলোটি যেন একটু দুলে উঠল। টর্চের আলোতেও কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকার নিকষ কালো অমাবস্যার রাত। এ রাতেই নাকি ভুত-প্রেত নেমে আসে। বিজ্ঞানসম্মত মন ভূত-প্রেত মানতে চাইল না। অথচ-
আবার শব্দ। তিনি লক্ষ্য করলেন অনেকটা ঘুন ধরা কাঠের শব্দের মত। কিন্তু ঘুন ধরার তো কথা নয়। নতুন বাড়ি। এত তাড়াতাড়ি কাঠে ঘুন ধরবে কেন!
আকাশে জ্বল-জ্বল করে নক্ষত্রগুলো হয়ে এল। বোধহয় হালকা মেঘ ঢেকে দিয়েছে তাদের। পরক্ষনেই আঁধার একটু হালকা হয়ে এল। আওয়াজ আর হচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
পাখির কলতানে ঘুম ভেঙে গেল। একটু চা-এর প্রয়োজন। পূব আকাশে সূর্যের নরম আলো। নিচে বনরক্ষীদের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। ওরা ভাবছে সাহেব বেঁচে আছে তো! সাহেব বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। সবাইকে সুপ্রভাত জানালেন। ওরা দুই চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে থাকল। ভাবটা এমন, যেন ভূত হয়ে গেছেন, এ নিশ্চয় সাহেবী ভূত।
বিজ্ঞানী চা পানের পর আবার উঠে গেলেন। সারাদিন আর বেরুলেন না। কী হতে পারে! সারাদিন ভাবলেন। বাড়ির কাঠ পরীক্ষা করতে করতেই রহস্যের সন্ধান পেয়ে গেলেন। বইপত্তর ঘাঁটতে থাকলেন।
রাতে আরাম করে ঘুমালেন। ভোরে উঠে নিচে নামলেন। গতকালের মতো কর্মীরা জড়ো হয়েছে। সাহেবকে দেখার জন্য। সাহেব ওদের মনের কথা বুঝতে পারলেন। ওদের একজনের কাঁধে হাত রাখলেন। ভয়ে সে যেন আধমরা। বললেন, ভয় নেই। আমি মরিনি, আমার ঘাড় মটকায়নি।
আমি ভূত নই। ভূত-ফুত বলে কিছু নেই এখানে। সামনে এই যে গাছগুলি দেখছ এর নাম টুন। এর বিশেষত্ব হল শব্দ করা। বিশেষ করে রাতেরবেলা। এই জাতের গাছ কেটে এই বাংলো তৈরি করা হয়েছে। এই শব্দ ওদের শোকের কান্না। একেই তোমরা ভুতের কান্না মনে করে ভয় পাচ্ছো।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউমল। ওখান থেকে অ্যাম্বাস্যাডার, টাটা সুমো বা যে কোনো গাড়ি ধরে গরুমারা যাওয়া যাবে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বর্ষা ১৪১৭
Topic : Bhoot Banglo, North Bengal Garumara forest ghost story, উত্তরবঙ্গ ভূত বাংলো, গা ছমছমে রহস্য-ভৌতিক গল্প, হাড় হীম করা ভৌতিক কাহিনি, ভূতের বাড়ি
0 মন্তব্যসমূহ