Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বন্ধু ।। ধীরেন্দ্র মোহন সাহা




সকাল থেকে বৃষ্টি। বিরাম নেই। মা চড়াই ছানাদুটোকে নিয়ে তিনতলা বাড়ির ঘুলঘুলিতে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ছানারা খিদেয় চিঁ চিঁ করে ডাকছে। মা চড়াই তাদের থামাবার চেষ্টা করে বলল, সোনারা চুপ কর, তোমাদের বাবা তো ভোর হতে না হতেই খাবার আনতে বেরিয়েছে। হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হল। খাবার নিয়ে ফিরবে কি করে বল? ছানারা ভালো করে কথা শেখেনি। তারা মার কথা বুঝল না। থেকে থেকে মুখ হাঁ করছে আর চিচি করছে। মা চড়াই ওদের গায়ে মাথায় ঠোঁট বুলিয়ে দিয়ে বলল, আর একটু সবুর কর বাছা! বৃষ্টিটা ধরল বলে। কে কার কথা শোনে! ছানারা আরো জোরে জোরে এবার চিঁ চিঁ করে কাঁদতে লাগল।

পাশের ঘুলঘুলিতে দলে দলে পিঁপড়েরা সব জড়ো হয়েছে। আজ তাদের জলসা। নাচ-গান করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু চড়াই ছানাদের কান্নার আওয়াজে জলসা মাটি হবার উপক্রম। জলসার সেক্রেটারি বিরক্ত হয়ে বলল, কে অমন চেঁচাচ্ছে রে! গিয়ে বারণ করে আয়।

চিনি আর মিনি পিঁপড়েদের দুজন ভলেন্টিয়ার ঘুলঘুলির ওপারে গেল। দেখল অন্য ঘুলঘুলির বাইরের দিকে চড়াই পাখি বাসা বেঁধেছে। চড়াইছানাদের চিঁ চিঁ করতে দেখে চিনি মা চড়াইকে বলল, ওদের থামাও। একটু বাদেই আমাদের জলসা শুরু হবে।

মা চড়াই কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, ওদের খুব খিদে পেয়েছে। বাড়িতে কিছু নেই যে ওদের মুখে দেব। ওদের বাবা খাবার আনতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। কি যে করি! মা চড়াইকে অসহায় দেখাল। তারপর একটু থেমে সে চিনিকে বলল, তোমরাও তো বৃষ্টির জন্য খাবারের খোঁজে যেতে পারোনি। তোমাদের খিদে পায়নি। চিনি বলল, রসদ ঘরে খাবার আছে। জলসার পর সবাই মিলে ভাগ করে খাব।

- রসদ ঘর! সেটা আবার কি! মা চড়াই অবাক হয়ে জানতে চাইল।

- আরে রসদ ঘর হল খাবার মজুত করার ঘর। প্রতিদিন আমরা যা যা খাবার জোগাড় করি, তার চার ভাগের এক ভাগ সেখানে জমা রাখি। বৃষ্টি বা কোনো কারণে খাবার সংগ্রহ করতে না পারলে রসদ ঘরের জমানো খাবার খাই।

- বাঃ, তোমরা তো বেশ আছো! খাওয়ার জন্য কোনো চিন্তা নেই।

- তা বটে। তবে সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন কাজের জন্য দল ভাগ করা আছে। বাসা বানাবার দল, খাবার খোঁজার দল, খাবার বওযার দল, লড়াই করার দল কোনো ছাড় নেই।

- বুড়োদেরও কাজ করতে হয়? কৌতূহল বশত মা চড়াই জিজ্ঞেস করল।

- একমাত্র অসুস্থ ছাড়া সব্বাইকে কাজ করতে হয়। যাদের বয়স হয়েছে, তাদের বসে থাকা ডিউটি।

- বসে থাকা আবার ডিউটি হয় নাকি!

- কেন হবে না? অশক্ত, অক্ষমরা রসদ ঘরের দোরে বসে পাহাড়া দেয়। কেউ খাবার চুরি করতে এলে মাপা শব্দতরঙ্গ পাঠিয়ে আমাদের জানান দেয়। সে আওয়াজ আমরা ছাড়া কেউ শুনতে পায় না। জানো তো এই বাড়ির টিকটিকিটা খুব হ্যাংলা। রসদ ঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। ফড়িং দেখলে আর রক্ষে নেই। একবার লড়াইয়ের দল এমন কামড়ে ধরেছিল... বাছাধন পালাবার পথ পায় না।

এসব কথা শুনতে শুনতে মা চড়াই ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছিল। কথা না বুঝলেও ছানাদুটো কান্না থামিয়ে আগন্তুকদের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। ভেবেছি এরা বোধহয় খাবার-দাবার এনেছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর, খাবার না পেয়ে চিঁ চিঁ করে আবার কাঁদতে শুরু করল।

মিনি এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার মুখ খুলল, বলল, তোমার ছানারা তো বড্ড ছিঁচকাঁদুনে! আজকে বৃষ্টি বলে খাবার খোঁজার কাজ নেই। সেজন্য জলসা। তোমার ছানাদের জন্য দেখছি সব বরবাদ হয়ে যাবে।

আঃ, চুপ কর না। চিনি তার সঙ্গীকে মৃদু ধমক দিল, বাচ্চারা কী এত সব বোঝে? ওদের খিদে পেয়েছে। চল সর্দারকে বলি।

পিঁপড়ে দলের সর্দারকে সব জানাতে সর্দার বলল, আমাদের প্রতিবেশী খিদের জ্বালায় ছটফট করবে, আর আমরা নাচ-গান করব? এই, শ্রমিকদলের কারা আছো এদিকে এসো। সর্দার গলা চড়াতেই এক ঝাঁক তাগড়াই পিঁপড়ে হাজির হল।

সর্দার তাদের বলল, তোমরা এক্ষুনি রসদ ঘর থেকে খাবার নিয়ে চিনি-মিনির সঙ্গে যাও। চড়াই ছানারা সকাল থেকে কিছু খাইনি বলে কান্নাকাটি করছে। একটু বেশি করে খাবার নিও যাতে ওদের মা-বাবারও হয়ে যায়।

দেওয়ালের বড়ো একটা ফুটোতে রসদ ঘর। শ্রমিক দলের পিঁপড়েরা রসদ ঘরে ঢুকল। সেখান থেকে ছোটো ছোটো তিন-চার টুকরো পাঁউরুটি টেনে হিঁচড়ে বার করল। কিন্তু সেগুলো ঘুলঘুলির ওপারে টেনে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর। মুহূর্তে তারা এক একটা পাঁউরুটি টুকরোর চারদিকে মুখ লাগিয়ে ঘিরে ধরল। সামনের পিঁপড়েরা 'হেইও মারো হেইও মারো' বলে টানতে লাগল। পিছনের পিঁপড়েরা ঠেলতে লাগল। চিনি-মিনিও হাত মানে মুখ লাগাল।

এক দল পিঁপড়েকে তার বাসায় এগিয়ে আসতে দেখে মা চড়াই ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, তার ছানাদের বোধহয় মারধর করবে। মা চড়াই ডানা দিয়ে ছানাদের আগলে রাখল, ফিসফিস করে বলল, বাছারা, একদম আওয়াজ করো না কিন্তু।

চড়াইয়ের বাসার কাছে এসে চিনি-মিনি হাঁক-ডাক শুরু করল, কই গো, ছানারা কোথায়? দেখ কী এনেছি।

মা চড়াই ভালো করে তাকাতে দেখতে পেল, এক ঝাঁক পিঁপড়ে তাদের থেকেও বড়ো এক টুকরো পাঁউরুটির মুখে করে টেনে নিয়ে আসছে। পিছন পিছন আরও পিঁপড়ে তাদের মুখেও পাউরুটির টুকরো। মা চড়াই জিজ্ঞেস করল, তোমাদের সাথীরা এত বোঝা নিয়ে কোথায় চলল?

কোথায় আবার? এই তোমার ছানা আর তোমাদের জন্য আমাদের সর্দার পাঠিযেছে গো, চিনি বলল।

চড়াই ছানার ডানার আড়াল থেকে মুখ বাড়াল। পিঁপড়ের দল পাউরুটির টুকরো চড়াইয়ের বাসার সামনে জড়ো করতে চড়াই ছানারা খাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু পাঁউরুটির টুকরোর কাছে এগিয়ে যাবার মতো তাদের এখনো পায়ের জোর হয়নি। তাদের ছটফটানি দেখেই পিঁপড়েরা মা চড়াইকে বলল, নাও ছানাদের এবার খাওয়াও। খুব খিদে পেয়েছে।

পিঁপড়েদের ক্ষমতা দেখে মা চড়াই হতবাক। অন্য অনেকের মতো সেও পিঁপড়েদের তুচ্ছ ক্ষুদ্র পিঁপড়েদের জীবনযাত্রার শৃঙ্খলা এবং প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মিতা দেখে সে বিস্মিত হল।

ছানাদের ক্রমাগত চিঁ চিঁ আওয়াজে মা চড়াইয়ের সম্বিত ফিরল, দাঁড়াও বাছা এক্ষুনি দিচ্ছি। বলেই, মুখ বাড়িয়ে এক টুকরো পাঁউরুটির ঠোঁটে তুলে নিল। তারপর সেটাকে ঠুকরে ঠুকরে নরম করে ছানাদের মুখে তুলে দিতে লাগল। ছানাদের তখন মনে আনন্দ আর ধরে না। খেতে খেতে মায়ের গায়ে লেপ্টে খুনসুটি করছে। ছানাদের খুশি দেখে মা চড়াই পিঁপড়েদের বলল, তোমাদের জন্য বাছারা আমার রক্ষা পেল। বিপদে বন্ধু হয়ে যে উপকার করলে, চিরকাল মনে রাখব, এর প্রতিদান কী যে দেব..., কৃতজ্ঞতায় গলা ভারী হয়ে গেল।

আমাদের কিছু চাই না। তোমার ছানাদের মুখের হাসি আমাদের কাছে বড়ো প্রতিদান। মুমূর্ষু চড়াই ছানাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে পিঁপড়েদের চোখে মুখে তখন এক তৃপ্তির ছাপ।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা।। জুলাই ২০১৯

 

Topic : পশুপাখির গল্প, চড়াই ও পিঁপড়ের গল্প,  Story of Animals,  Best story for kids, Story of ants and sparrows

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ