Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আনন্দনগর ।। নিত্যরঞ্জন দেবনাথ

 



আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। দিয়া এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কী করে সম্ভব!

হয়েছে কি, দিয়া স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা রেখে ড্রেস চেঞ্জ করে একটু ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আধঘন্টা পরেই বন্ধুরা আসবে, তখন খেলতে বেরোবে। বাড়ির পাশে একটু ফাঁকা জায়গা আছে, ওখানে ওরা খেলে। খেলা বলতে চু-কিত-কিত, চোর-পুলিশ, কানামাছি এইসব। সবাই ওরা বন্ধু, এক ক্লাসে পড়ে। ক্লাস থ্রি। কিন্তু এক ঘন্টা কাবার হয়ে গেল, বন্ধুরা কেউ আসছে না কেন? এত দেরি তো করে না! দিয়া চিন্তায় পড়ে গেল। আজ সবাই কি একসঙ্গে কামাই করে দিল? এক-একদিন এক-দুজন অফ হয়ে যায়। সবাই ডুব দেবে এমনটা তো হয়নি কোনোদিন! একমাত্র রবিবারে ওদের খেলা বন্ধ। সেদিন বাবা-মায়ের ছুটি থাকে বলে কাছাকাছি এদিক-ওদিক বেড়াতে যায়। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি করবে সে এখন? বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে। ফিরবেন সেই সন্ধের পর। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করল। নাঃ, ভালো লাগছে না। বন্ধুদের প্রতি হঠাৎ রাগ উঠে গেল, আসবে না যে আগে থেকে বললেই হতো।

সন্ধ্যা হব-হব। তখনই দিয়ার মনে হল, এমনটা হয়নি তো? ওকে না ডেকেই বন্ধুরা খেলতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও এমন কোনোদিন হয়নি, তবু সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। ঠিক তাই, ওরা ওকে না ডেকেই খেলতে শুরু করে দিয়েছে। দিয়ার খুব রাগ হল। বলল, কিরে আমাকে তোরা ডাকিসনি কেন?

তনিকা বলল, আয় চলে আয়। আমাদেরই দেরি হয়ে গেছিল। তাই তোকে আর ডাকা হয়নি। আয়-আয়।

দিয়া বলল, না, তোদের সঙ্গে আর খেলব না। আমি চললাম, বলে ছুটে ফিরে আসছিল। তখনই কাণ্ডটা ঘটল। ছুটতে গিয়ে বুঝতে পারল, শরীরটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেছে। সে পাখির মতো উড়তে পারছে। বাহঃ কি আরাম। সে উড়ে উড়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। নিচ থেকে বন্ধুরা চিৎকার করছে, দিয়া অত উঁচুতে যাস না, নেমে আয় শিগগির।

কে শোনে কার কথা। সে হাত নাড়িয়ে বন্ধুদের বিদায় জানালো, তোরা চলে যা, আমি এখন অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছি। টা-টা বাই...

পৃথিবীতে তখন অন্ধকার। দিয়া যখন বেরিয়ে ছিল তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে দিয়া দেখছে দিনের মতো ঝলমলে আলো। মেঘের ভেতর দিয়ে যখন উড়ছিল, তখন সামান্য অন্ধকার ভাবছিল। মেঘ থেকে বেরোতেই দেখে মিষ্টি সকালের মতো আলো। এখানে প্রচুর সতেজ গাছপালা। নানা বিচিত্র ফুল ফুটে আছে। গাছগুলো এতটাই প্রাণবন্ত যেন মনে হচ্ছে প্রতিটা গাছ খুশিতে ডগোমগো। এখানকার মানুষগুলো তার মতো ছোটো ছোটো, কেউ দৌড়চ্ছে, কেউ খেলছে, কেউ কেউ আবার নেচে নেচে গান গাইছে। জায়গাটা তো বেশ!

দিয়া একজনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাই, এই জায়গাটার নাম কী? ছেলেটি বলল, ওমা! তুমি ভিনদেশী? এই জায়গার নাম হচ্ছে আনন্দনগর। কদিন থাকো, সব জেনে যাবে।

- আনন্দনগর? বাঃ বেশ নাম তো!

- হ্যাঁ গো, এখানে সবার মনে আনন্দ।

খুব খুশিতে থাকে। কারো মনে দুঃখ নেই। শুধু মানুষ নয় গো, পশু-পাখি জন্তু-জানোয়ার সব খুশিতে থাকে। এমনকি গাছগুলোকেও দেখছ না? হেসে হেসে এক ডাল থেকে আরেক ডালে গড়িয়ে পড়ছে।

দিয়া বলল, বাহঃ ভালো জায়গায় এসে পড়েছি তো! কিন্তু ভাই আমার খুব খিদে পেয়েছে। কোথায় খাবার পাওয়া যায় বলতে পারো?

- সে কি কথা! খিদে পেলে বলবে তো? ওই যে বড়ো আপেল গাছটা দেখছ, ওই গাছটার পাশে দেখবে একটা কুটির আছে, ওখানে গিয়ে বল, আমি ভিনদেশী। আমাকে খেতে দাও।

দিয়া চলে গেল সেখানে গিয়ে দেখে অনেক মানুষ বসে বসে খাচ্ছে। দিয়া বলতেই, হাত দিয়ে ইশারা করল। অর্থাৎ বসে পড়। বসতেই এক প্লেট খাবার দিল। কিছু ফলমূল আছে বুঝতে পারছে, কিন্তু বাকিগুলো ভাতের থেকে অনেক বড়ো বড়ো দানা। ঠিক বুঝতে পারল না জিনিসটা কি!

মুখে দিতেই মিলিয়ে গেল। হেবি টেস্ট। এমন সুস্বাদু খাবার সে কোনোদিন খায়নি। দিয়া গপাগপ খেয়ে প্লেট শেষ করে ফেলল। কিন্তু বাড়িতে কখনো এত দ্রুত খেতে পারে না। খাবার শেষ হতে দুহাতা খিচুড়ি দিয়ে গেল। ওমা! এটা খিচুড়ি নয়, পায়েশও নয়, তবে কি এটা! দিয়া নাম জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা পাচ্ছে। হয়তো ভাববে, মেয়েটা কি বোকারে, খাবার নামই জানে না। মুখে দিতেই- আঃ যেন অমৃত। দিয়ার পেট ভরে গেল।

একজন এসে বলল, ওই দেখো ওখানে দলের কল আছে, প্লেটটা নিয়ে যাও, ভালো করে ধুয়ে টেবিলে রেখে দাও। এদেশে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়।

দিয়া যদিও কোনোদিন এটো থালা-বাসন কখনো ধোয়নি। তবুও তার খারাপ লাগল না। যে দেশের যা নিয়ম তা তো করতেই হবে।

প্রথম যে ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেই ছেলেটি এসে হাজির। বলল, এসো তোমাকে আমাদের দেশটা ঘুরে দেখাই। আমি অফিসে গিয়ে অনুমতি নিয়ে এসেছি।

দিয়া বলল, আমাকে না দেখেই তোমাকে অনুমতি দিয়ে দিল? ছেলেটি বলল, কে বলল তোমাকে দেখেনি? তুমি যখন আমাদের দেশে পা দিয়েছ, তখনই তোমার সমস্ত জানা হয়ে গেছে। এই দেখো, তোমার আইডেন্টিটি কার্ডও নিয়ে এসেছি।

দিয়া বলল, ওরে বাবাঃ আমার ছবি কি করে পেল?

- বলছি কি তবে, তুমি আমাদের দেশে যখনই পা দিয়েছ তখনই কম্পিউটার ছবি তুলে নিয়েছে। চলো আর দেরি করো না। আমাকে আমার স্কুলে যেতে হবে।

কিন্তু বুদ্ধিতে এরা আমাদের থেকে অনেক প্রখর। বাস চলছে। কিন্তু আশ্চর্য বাসের কোন ড্রাইভার নেই। বাসে ওঠার সময় ছেলেটি একটি মেশিনের সুইচ টিপে সিটে বসে পড়ল। গন্তব্যস্থান এসে গেলেই সিটের কোণে একটি লাল আলো জ্বলে উঠছে, আর বারবার বলছে তোমার গন্তব্যস্থান আসছে। তুমি ধীরে ধীরে দরজার সম্মুখে চলে যাও।

বাস থেকে নেমে ওরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকল। বিশাল বিল্ডিং, কুলাস রুম, টিচার্স রুম সব ঝকঝকে তকতকে। ক্লাসগুলো ঘুরে দেখাল। এখানে বইয়ের পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পেয়ে যায়। একটা ঘরে নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে। প্রতিমাসেই ছাত্রছাত্রীরা নাটক করে।

দিয়া বলল, তোমাদের দেশটা খুবই ভালো।

ছেলেটি বলল, আমাদের দেশ কেন ভালো, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি- আমাদের এখানে কোনোদিন চুরি হয় না, ডাকাতি হয় না। কেউ কোনোদিন মিথ্যে বলে না। সকলে মন দিয়ে কাজ করে। কাজে কেউ কোনোদিন ফাঁকি দেয় না। আমাদের এখানে প্রত্যেকটি পড়াশোনা করে। এমন একজনকেও পাবে না যে, সে লেখাপড়া শেখেনি। পড়ালেখাটা সবাইকে শিখতেই হবে। খেলাধুলা ও প্রত্যেক করে। ছেলে মেয়ে বলে এখানে ভেদাভেদ নেই। সবার সমান অধিকার।

এবার চলো তোমাকে একটা শপিং মল ঘুরে দেখাই।বিশাল এলাকা নিয়ে শপিং মল। অথচ সেলসম্যান নেই। জিনিস পছন্দ করে মেশিন টিপে দাম জেনে পয়সা দিয়ে দিচ্ছে। এত সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়া জীবনে দেখেনি। এতো ভালো লাগছে কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

ছেলেটি বলল, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল, অথচ তুমি আমার নামই জানো না। আমার নাম হর্ষ। তোমার নাম দিয়া আমি জানি। আজ থেকে আমরা বন্ধু কেমন? আমাকে হর্ষ বলেই ডাকবে, বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল।

দিয়াও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। তারপর বলল, আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

হর্ষ বলল, আমি ফোর।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গেল, সেখানে সব ছোটোদের খেলনা। প্রত্যেকটা খেলনাই অসাধারণ। যা দিয়া কোনোদিন চোখেই দেখেনি। ভাবছে ও যদি একটা কিনে নিয়ে যেতে পারতো, বন্ধুরা দেখলে অবাক হয়ে যেত। কিন্তু তার কাছে তো পয়সা নেই। তখনই হর্ষ বলল, আজ আমরা দু'জনে একে অপরের বন্ধু হলাম। বলো তোমাকে কি উপহার দেব?

দিয়া লজ্জা পেয়ে গেল। কেউ কিছু দিলে, বিনিময় তাকেও কিছু দেওয়া উচিত। এটাই আমাদের দেশের ভদ্রতা। তাই চুপ করে রইল।

হর্ষ বলল, বুঝতে পারছি তুমি কি ভাবছো। আমাদের দেশে কিন্তু ভালোবেসে কেউ কিছু উপহার দিলে তার বিনিময় কিছু দিতে নেই। তাতে ভালোবাসাকে অপমান করা হয়। তাছাড়া তুমি আমাদের দেশে এসেছ, আমারই কর্তব্য তোমাকে আপ্যায়ন করা। উপহার দিয়ে সম্মান জানানো। আমি যখন তোমার দেশে যাব তখন তুমি যা ভালোবেসে দেবে আমি সাদরে গ্রহণ করব। আজ আমি এমন একটা পুতুল কিনে দিচ্ছি, তাকে যা জিজ্ঞাসা করবে সে তার সঠিক উত্তর বলে দেবে।

দিয়া অবাক! হর্ষ যে পুতুলটা হাতে দিল, তাকে যা প্রশ্ন করছে সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে কয়েকটা প্রশ্ন করল, বল তো আমার নাম কি? আমার জন্ম তারিখ কত? আমার বাবা মায়ের নাম কি? আমার স্কুলের নাম কি?

গড় গড় করে সব সঠিক উত্তর দিয়ে দিল। ভাবা যায়!

হর্ষ বলল, রেখে দাও, এটা তোমাকে অনেক আনন্দ দেবে। যখন যা ইচ্ছে গান শুনতে চাইলে, গল্প শুনতে চাইলে, সব তোমাকে তোমার মনের মতো শুনিয়ে দেবে।

চল আমরা ওইদিকটায় যাই। ওখানে একজন ম্যাজিক দেখাচ্ছে, চল দেখবে দারুণ ম্যাজিক।

ম্যাজিক দেখে দিয়ার আনন্দ আর ধরে না। সবাই হাততালি দিয়ে বাহবা জানাচ্ছে। তখনই ম্যাজিসিয়ান দিয়াকে হাত নেড়ে ডাকছে, এসো, তুমি মঞ্চে এসো। তাড়াতাড়ি এসো। পরক্ষণেই একটি পরিচিত গলার স্বর কানে এল- কিরে দিয়া সন্ধের সময় ঘুমাচ্ছিস? আর খেলতে যাসনি?

দিয়া হতবাক! এখানে মা এলেন কী করে! তার ঘোর এখনো কাটছে না।

 

অলংকরণ- বিনীতা ভাদুড়ী

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।।  মে ২০১৯

 

Topic : Children's  Fairy Tales,  ছোটোদের মজার রূপকথার গল্প,  আজব দেশের কথা, Strange Country

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ