হা-রে-রে-রে।হা-রে-রে-রে-রে।
কি ভয়ঙ্কর চিৎকার! বীভৎস সব মূর্তি। হাতে হাতে জ্বলন্ত মশাল। কপালে সিঁদুর টিপ। দল বেঁধে হা-রে-রে-রে করতে করতে ওই তারা ছুটে আসছে। দেখলেই ভয় লাগে। বুক ধড়ফড় শুরু হয়। শোনা যায় আর্তনাদ- ওরে বাপ, ডা-কা-ত বাঁ-চা-ও।
এমনই এক ডাকাত দলের সর্দারের হাত ধরে কোনো ছোট্ট ছেলে যদি স্কুলে যায়, ডাকাতের মুখে ডাকাতির নানান রোমাঞ্চকর গল্প শোনে, তবে আমারই বোধহয় কেউ তা বিশ্বাস করতে পারব না।
গল্প নয়, সত্যি। এই রকমই ঘটেছিল। তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ভগবানচন্দ্র বসু। ডাকাত ধরায় দারুণ পটু। কতবার যে তিনি ডাকাত ধরেছেন, ডাকাত কাত করেছেন তার হিসাব নেই। অসীম সাহসী, নির্ভীক ভগবানচন্দ্র নিজেই একবার ডাকাতদলকে ধরেছিলেন। বিচারে তাদের চার বছরের জেল হয়। জেলের ঘানি টানতে টানতে চারবছর কাবারও হয়ে যায়। ছাড়া পেয়েই ডাকাত সর্দার ছুটে আসে ভগবানের কাছে।
সেই কবেকার কথা। চার বছরে কত লোক এলো গেল, সাজা পেল। সব কী আর মনে থাকে। ডাকাত সর্দারই নিজের পরিচয় দিল। একটু ধরিয়ে দিতেই ভগবানচন্দ্রের সব মনে পড়ে যায়। ছবির পর ছবি। ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডাকাত সর্দার বেদনা-কাতর স্বরে বলে, হুজুর, আমার শাস্তি তো শেষ হল, খালাস হয়েছে। এখন খাব কি?
ভগবানচন্দ্র এক মুহূর্ত না ভেবেই বললেন, কাজ করো, আর চুরি-ডাকাতি নয়। খেটে খাও।
ডাকাত-সর্দারের মুখে করুণ হাসি। ম্লান মুখে বলে, কোথায় আমি কাজ পাব? কে আমায় কাজ দেবে? কে-ই বা আমার উপর বিশ্বাস করবে, আমি দাগি আসামি!
ডাকাত সর্দারের কন্ঠ আবেগে বুজে আসে। চোখে মুখে বেদনার ছাপ আরো স্পষ্ট হয়। পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলেন ভগবানচন্দ্র- কোনো ভয় নেই। আমি তো আছি। আমিই তোমায় কাজ দেব। আমার ছেলেকে প্রতিদিন পাঠশালায় নিয়ে যাবে, আর নিয়ে আসবে। এ কাজ পারবে তো?
ডাকাত সর্দারের সঙ্গে কদিনেই সেই ছেলেটার খুব ভাব জমে ওঠে। তাকে স্কুলে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। কত গল্প বলে। একটাও বানানো, মন-গড়া নয়। সত্যিকারের ডাকাতির গল্প, ডাকাতের গল্প।
জেল ফেরত ডাকাতকে ভগবানচন্দ্র নিজের ঘরে ঠাঁই দিয়েছিলেন। বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান, ভগবানচন্দ্রেরই পুত্র জগৎ-বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে জগদীশ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার বাড়িখার গ্রামে।
তাঁর মায়ের নাম বামাসুন্দরী দেবী। ভগবানচন্দ্র ছিলেন আপনভোলা, বেহিসেবী মানুষ। মা বামাসুন্দরী নিজের শেষ সম্বল গয়নাগাটি বেচে জগদীশচন্দ্রকে বিলেত পাঠিয়ে ছিলেন।
ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী হয়েও ভগবানচন্দ্র ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ দেশসেবক। হাজারো ঝড়ঝঞ্ঝা, বাধা-বিপত্তির মধ্যেও কখনও ভেঙে পড়েননি। ভগবানচন্দ্রের দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম বালক বয়সেই জগদীশচন্দ্রকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে বলে কথা! সবাই নিশ্চিত হয়েই ছিল জগদীশচন্দ্র ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হবে। ইংরেজি পড়বে, বিলিতি আদব-কায়দা শিখবে। সবার এই ধারণা কল্পনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে ভগবানচন্দ্র ছেলেকে ভর্তি করলেন গ্রামের পাঠশালায়। চাষীর ছেলে, জেলের ছেলে এমনকি ভগবানচন্দ্রের চাপরাশির ছেলেও এই পাঠশালায় পড়তো, জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে।
বালক বয়স থেকেই জগদীশচন্দ্রের কৌতুহলের শেষ ছিল না। সবকিছু ঘিরেই তাঁর মনে হাজারো প্রশ্ন, নানান জিজ্ঞাসা।
লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে দিলে নুয়ে পড়ে, আম-জাম-কাঁঠালগাছের তো হয় না, কেন বাবা?
ভগবানচন্দ্র সাধ্য মতো বুঝিয়ে দিতেন। কখনও বা বলতেন, প্রকৃতির সব রহস্য তো আমরা জানি না। বড়ো হয়ে এসব কিছুর উত্তর বের করতে হবে। কি পারবে তো?
জগদীশচন্দ্র ঘাড় নাড়তেন, পারব বাবা। খুশির আলোয় ভগবানচন্দ্রের মুখ ভরে যেত।
শুধু গাছপালা নয়, জীবজন্তু নিয়েও জগদীশচন্দ্রের কৌতুহল আর আগ্রহের শেষ ছিল না। ডোবা থেকে মাছ ধরার ফাঁকে লক্ষ করতেন মাছেদের সাঁতার কাটা, চলাফেরা। মনে প্রশ্ন জাগলে বাবার কাছে ছুটে যেতেন। বাবা একটুও বিরক্ত না হয়ে ছেলের কৌতূহল মেটাতেন।
প্রকৃতির প্রতি, জীবজগতের প্রতি জগদীশচন্দ্রের আকর্ষণ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ছেলেবেলা থেকে এই আকর্ষণ ছিল বলেই বড়ো হয়ে গাছপালা নিয়ে গবেষণা করে সাফল্য পেয়েছিলেন।
কেমব্রিজ থেকে বিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ.ও, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি পাস করে দেশে ফিরে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হন। পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, গাছ নিয়ে গবেষণা করেই জগৎসভার স্বীকৃতি পান। জগদীশচন্দ্রই দেখালেন, গাছও সাড়া দেয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জগদীশচন্দ্রের কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র। বইটির নাম 'অব্যক্ত'। 'বিজ্ঞানাচার্য' ও 'স্যার' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্র 'বসু বিজ্ঞান মন্দির' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অসুস্থ জগদীশচন্দ্র স্ত্রী অবলা দেবীকে নিয়ে গিরিডিতে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য উদ্ধারে। গিরিডির মনোরম পরিবেশ প্রকৃতির মাঝে কদিন থাকলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন, এমনই ভেবেছিলেন। না গিরিডি থেকে তাঁর আর ফেরা হয়নি। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩শে নভেম্বর মারা যান তিনি।
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুন ২০১১
Topic : The story of Jagadish Chandra Bose's childhood, জগদীশচন্দ্র বোসের ছোটোবেলা, Biography of Jagadish Chandra Bose
0 মন্তব্যসমূহ