Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

চাঁদে সূর্যমুখী ।। তৃষ্ণা বসাক




এদিকে চারজন, ওদিকেও চারজন। মাঝখানে যে ফ্লাইং সসারের মতো জিনিসটা তির-তির করে কাঁপছে, সেটা আসলে একটা স্পেসক্রাফট। চাঁদমারি- ২০১২ নামের রকেটটা অনেকক্ষণ এটাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। এতক্ষণে চাঁদুর (স্পেসক্রাফটটার নাম) কাজ শুরু করে দেওয়ার কথা। কাজ কী কম! চাঁদের মাটি কোপাবে, কোপানো মাটি ঝুরোঝুরো করবে, জল ঢেলে নরম করবে, তারপর সূর্যমুখীর বীজগুলো ছড়িয়ে দেবে. এইটুকু করতেই মেলা সময় লাগবে।

বাড়িতে আবহাওয়ার খবর শোনার জন্য বাবা মুখিয়ে থাকে। ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা শুনলেই তেতো মুখ করে বলে, 'কি বিচ্ছিরি, কি বিচ্ছিরি! এখানে মানুষ থাকে?' ফিরে গিয়ে বাবাকে চাঁদে এনে ছেড়ে দিতে হবে। দুপুরে ১০০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড গরমে মাটি কোপাতে হলে বিচ্ছিরি বলা বেরিয়ে যাবে। চুনমুনের অংকের নম্বর দেখে 'বিচ্ছিরি' বলাও। চুনমুন বাবা লোকটাকে বুঝতে পারে না। একই লোক এদিকে টেম্পারেচার বাড়লে রেগে যায়, অন্যদিকে নম্বর কমলে রেগে যায়! দুটোই তো স্রেফ দুটো সংখ্যা। সেই যে বিখ্যাত একটা লোক বলেছিল না, 'সংখ্যায় কি-ই বা এসে যায়?' কে বলেছিল? চুনমুনের এক্ষুনি সেটা মনে পড়ছে না বলে, সে তো আর এত বড়ো লোকের কথাটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।

যাইহোক চুনমুনের আপাতত কাজ হচ্ছে, চাঁদে সূর্যমুখীর চাষটা ঠিকঠাক শুরু করে দিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। কিন্তু চাঁদুকে যে ওরা চাঁদে নামতেই দিচ্ছে না। চুনমুনরা যতই চাঁদকে গড়িয়ে গড়িয়ে চাঁদের পিঠে চাপাবার চেষ্টা করছে, ওরা অদিক দিয়ে ততই টেনে ধরছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ভাবছো, ইয়ার্কি না কি? স্পেইসক্রাফটকে টেনে ধরা! মহাভারতের ভীম কিংবা ঘটৎকচ হলে বুঝতাম। আর এক যদি মনোহর আইচ আসেতন। কিন্তু ১০০ বছর পেরিয়ে ফালতু ঝক্কি ঝামেলার মধ্যে তিনি যান না। তাহলে ওরা কারা? আর একবার প্রথম লাইনটা পরও। এদিকে চার, ওদিকেও চার।

এদিকে তো আছে চুনমুন, বুকাই, জোজো আর তিন্নি। 'চাঁদে সূর্যমুখী চাষ প্রকল্প'-র পৃথিবীর চার জন ছাত্র প্রতিনিধি পাঁচ-পাঁচ ধাপ পরীক্ষা দিয়ে হাজার-হাজার স্কুলের লক্ষ-লক্ষ ছেলেমেয়েদের টপকে ওরা এই সুযোগ পেয়েছে।

আর ওদিকে চার? ওরা হচ্ছে চিরকালের হিংসুটের দল। সেই যে একটা কবিতা আছে না- 'তোমরা কিছুই পাও না বলে তাও তোমাদের সয় না।' এরা তেমনি চারজন, যারা অনেক কেঁদে কঁকিয়ে, টুকলি করে, অনেককে ধরাধরি করেও চান্স পায়নি। তারপর? তারপর আর কি? চাঁদমারির পেটে চাঁদুর, আর চাঁদুর পেটে চুনমুনরা যখন যাত্রা শুরু করেছে তখন, কোন ফাঁকে ঠিক সিনেমার মতো এরা লুকিয়ে চড়ে বসেছে। কাক-পক্ষীতেও টের পায়নি। আর টের যখন পাওয়া গেল তখন চাঁদমারি ২০১২ পৃথিবীর আওতার বাইরে চলে এসেছে। তখন কি এদের ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়? যদিও সে রকম একটা ইচ্ছে সবার মনেই ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু ঠেলতে গেলে উল্টে ওরাই ঠেলে ফেলে দেবে। গায়ে যা জোর এক একজনের। নইলে কি আর কেউ চাঁদুকে টেনে রাখতে পারে?

পিংকি, তানি, বুজু আর দোয়েল নামগুলো এরকম মিষ্টি-মিষ্টি হলে কি হবে, মানুষগুলো কি তেতো কি তেতো! চাঁদের এরকম একটা দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চার ওদের জন্য বিচ্ছিরি তিতকুটে হয়ে গেছে।

গোড়া থেকেই ওদের দলকে খালি দুয়ো দিয়ে যাচ্ছে পিংকিরা। ভীতু, ডরপোক, ভালোমানুষ সেজে থাকে বলেই নাকি চুনমুনরা এই কাজটায় সুযোগ পেয়েছে।

চুনমুনরা নিজেদের মধ্যে ইশারায় কথা বলে নিল একটু।

- বেশ বাবা, আমরা ভীতু, ডরপোক। তোরা খুব সাহসী। তাই একটু বাইরে ঘুরে টুরে আয় না। অ্যাস্ট্রোনটদের পোশাক-টোশাক সবই পরে আছিস দেখছি।

গোল জানলা দিয়ে নিকষ কালো বাইরেটা এক ঝলক দেখে নিয়ে, 'যেতেই পারি, কিন্তু তোরা আবার ভয় পাবি। 'মা যাব, মা যাব' করে কাঁদতে না শুরু করে দিস।'

এ অপমানটা হজম করল চুনমুনরা। মা বলে দিয়েছে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই। অবিশ্যি মা জানতো না এই উৎপাতগুলো তাদের সঙ্গে যাবে। কিন্তু যখন ওরা তাদের সূর্যমুখী ফোটানোর ব্যাপারটাকে নিয়েই হাসিঠাট্টা করতে শুরু করল, তখন চুনমুনরা আর সহ্য করতে পারল না।

শুরুটা করল দোয়েল। ওর চশমা পরা দুই বিনুনী ঝোলানো গোলগাল মুখটা দেখলে কেউ বলবে, কি সাংঘাতিক বিচ্ছু মেয়েটা!

- আহা কি আইডিয়া! চাঁদের সূর্যমুখী ফোটাবে! ওই পাথুরে মাটি, একটু বরফ পাওয়া গেছে কি যায়নি, তার মধ্যে ফুল ফোটাবে!

অমনি বুজু পোঁ ধরল- এই সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল তৈরি হয় না? আচ্ছা, এখানে এত তেল তৈরি করে কি হবে? লুচি ভাজবে বুঝি? আমরা তো ওঠা থেকে গাদাগুচ্ছের বড়িই খেয়ে যাচ্ছি।

তিন্নিটা একেবারে যা তা। লুচির নাম শুনে কেঁদে দিল। বলে কিনা, আমার মা সানফ্লাওয়ার অয়েল দিয়ে কি সুন্দর ফুলকো ফুলকো লুচি ভাজে।

চুনমুন ভেবেছিল তিন্নির কান্না দেখে ওরা আওয়াজ দেবার আরো সুযোগ পাবে। কিন্তু লুচির নাম শুনে সবাই এত মুষড়ে পড়ল যে ঝগড়াটা সে যাত্রায় নেতিয়ে গেল। কিন্তু মনে মনে যে ওরা তাল ঠুকিছল, তা তো আজ বোঝা যাচ্ছে। ঠিক ১০টা ৩১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে চাঁদুর চাঁদে ল্যান্ড করার কথা, ক-মিনিটই বা বাকি আছে, আর এদিকে এরা চাঁদুর বাঁ দিকের চাকাগুলো ধরে ঝুলে আছে। কিছুতেই তাকে চাঁদে নামতে দেবে না।

চুনমুন যেহেতু টিম লিডার, তাই সে মাথা গরম না করে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে চাইল।

- তোরা কি চাইছিস খুলে বল তো।

- আমরা চাঁদে নামব না।

- ভালো কথা, নামিস না। চারপাশটা বেড়িয়ে আয় বরং। আমরা ততক্ষণে...

- তোরা যতক্ষণে চাঁদে সূর্যমুখী ফোটাবি, ততক্ষণে যে আমাদের চোখে সর্ষে ফুল ফুটে যাবে। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ে দোয়েল।

- বা তোরা নামতে না দিলে যে আমাদের মিশন ইনকমপ্লিট থেকে যাবে।

- আর আমাদের মিশনটা বুঝি কিছু নয়?

- তোদের! তোদের আবার কি মিশন? আকাশ থুড়ি একেবারে মহাকাশ থেকে পড়ে চুনমুন ও তার সঙ্গীরা।

- কেন, আমাদের মিশন প্লুটো।

- মিশন প্লুটো অবাক হতেও ভুলে যায় চুনমুন।

- হুঁ-হুঁ বাবা, আমরা হচ্ছি মূর্তিমান জাস্টিস। এত বছর ধরে গ্রহ হিসেবে মান ইজ্জত পেয়ে এল বেচারা, হঠাৎ তাকে কান ধরে বের করে বামন বানিয়ে দেওয়া হল কেন? সেটাই আমরা তদন্ত করতে এসেছি। ভাবিস না, নিজেরা যেচে এসেছি। প্লুটো ন্যায়বিচার কমিটি থেকে আমাদের রীতিমতো ইনভেস্টিগেট করতে পাঠানো হয়েছে।

চুনমুন এবার শেষ চেষ্টা করে- সে পাঠানো হতেই পারে। ন্যায়বিচার কমিটি, মঙ্গল মহোৎসব, ইউরেনাসে ইউনিয়াম, যা খুশি, য়ে কোনো কমিটি থেকে তোদের শুধু এখানে কেন, অন্য কোন গ্যালাক্সিতেও পাঠানো হতে পারে, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই আমাদের ঘাড়ে চড়ে নয়। এই চাঁদু স্পেসক্রাফট শুধু চাঁদে সূর্যমুখী চাষ প্রকল্পের জন্য তৈরি। আমাদের সেই কাজেই পাঠানো হয়েছে এবং পরোপকার করার কোন ইচ্ছেও আমাদের আপাতত নেই। তোদের কমিটির পদের জন্য স্পেসক্রাফট তৈরি করে দিক। তাতে চড়ে তোরা যেখানে ইচ্ছে যা না।

অমনি দোয়েল বলে কি, আমাদের স্পেসক্রাফট বানাতে আরো দশ বছর লাগবে। ততদিন কি প্লুটো ওপর এই অবিচার চলতে থাকবে? দেখলাম তোরা ফালতু একটা ব্যাপারে দেশের কোটি কোটি টাকা উড়াতে চলেছিস তাই চেপে বসলুম।

রাগে চুনমুনের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরল না। জোজো উত্তেজিত মুখে বলল, এত দস্তুরমতো হাইজ্যাক।

- ঠিক বলেছিস একেই বলে হাইটেক হাইজ্যাক। তোদের গোদা মাথায় এ বুদ্ধি খেলত? বলে, দুলে দুলে হাসতে থাকে। দোয়েল আর সবাই মিলে চাঁদুর বাঁদিকের চাকা ধরে ঝুলে পড়ে।

চুনমুন দেখে ১০টা ৩১ হয়ে ১৫ সেকেন্ড। মানে আর মাত্র ৩০ সেকেন্ড বাকি। ও প্রানপনে চাঁদুকে ঠেলে ঠেলে নামাতে চেষ্টা করে। বাকিরাও হাত লাগায়। হাজার হাজার সূর্যমুখী ওদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর ১৪ সেকেন্ড আরেকটু ১৩ সেকেন্ড আর একটু গেলেই... আর ১২ সেকেন্ড কপালে ঠান্ডা একটা ছোঁয়া লাগে হঠাৎ। চাঁদের পিঠে উঠে পড়েছে নাকি!

চুনমুন চেঁচিয়ে ওঠে, পৌঁছে গেছি, চাঁদে পৌঁছে গেছি।

- কি পাগলামি করছিস? উঠে পড়। আর দেরি করলে বাস মিস করবি।

মার গলা কানে যেতেই অবাক হয়ে য়ায চুনমুন। মাও এসেছে নাকি চাঁদুতে চড়ে? কিন্তু স্কুলবাস!

- কিরে চোখ খোল। এবার জোরে ঠেলা দেয় মা। অমনি ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে চুনমুন। আজও স্বপ্ন দেখছিলে নির্ঘাত।

সদ্য স্নান সারা মায়ের চুলে জলের ফোঁটা লেগে। চুনমুন বেজার মুখে বললে, পুজোর ছুটি আর কদিন আছে গো?

- জানলা দিয়ে দেখ, তাহলেই বুঝবি কদিন আছে।

জানলা ঘেঁষেই খাট। বালিশটা বুকে করে ঘুম চোখে জানলার ধারে গিয়ে বসে চুনমুন। একচিলতে বাগানে একটা পেয়ারা আর দু-চারটে ফুলের গাছ। ঠাকুমার পুজোর ফুল সব। টগর, জবা আর একটি শিউলি। সেই শিউলি গাছের নীচে কয়েকটা ফুল পড়ে আছে। এ বছরের প্রথম ফুল! কদিন পর গাছের তলা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যাবে। এখন অল্প কয়েকটা ফুল পড়ে আছে। তার ওপর শরতের সোনা রোদ্দুর এসে পড়েছে। চাঁদে সূর্যমুখী ফুটলে ঠিক এমনটাই দেখাত না?

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯

 

Topic : Children's Funny story,  Science fiction stories, ছোটোদের মজার গল্প, কল্পবিজ্ঞানের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ