মা নতুন পাজামা আর পাঞ্জাবি পরিয়ে দিতেই বড়ো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রন্টি। এবারে টম আর জেরিকে ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে ও। টম আর জেরি আছে বলেই, এই পাঞ্জাবীটা এত পছন্দ হয়েছে। মাসুন নিজে পাঞ্জাবিটার বুকে রঙ-বেরঙের সুতো দিয়ে বড়ো বড়ো করে এঁকে দিয়েছে ওদের ছবি। মুসুন তো জানে, ওরা রন্টির কত্ত প্রিয় বন্ধু।
রন্টিকে রেডি করিয়ে মা সাজুগুজু করবে। তারপর দুজনে মিলে যাবে পাড়ার পুজোমণ্ডপে। আজ দুর্গাপূজার অষ্টমী। মন্ডপে গিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে মা দুর্গাকে অঞ্জলি দেবে রন্টি। অঞ্জলি দিতে ওর খুব ভালো লাগে। যদিও ঠাকুরমশাই-এর অং-বং-ইকির-মিকির মন্তর ও কিছুই বুঝতে পারে না। কেবল ওর ছোট্ট হাতের মুঠোয় ফুল আর বেল পাতা নিয়ে মায়ের দেখাদেখি চোখ বুজে চুপ্টি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মা বললেই চোখ খুলে হাতের ফুল ছুঁড়ে দেয় মা দুগ্গার দিকে। সেইফুল অবশ্য দুগ্গা মায়ের পা পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবুও ওর খুব আনন্দ হয়
মাকে তাড়া লাগিয়ে বাইরের ঘরে চলে এলো রন্টি। আর এসেই দেখতে পেল চুপচাপ ঘরের কোণে বসে খবরের কাগজ পড়ছে লালুদাদা। টম আর জেরির পরেই রন্টির বেস্ট ফ্রেন্ড লালুদাদা। স্কুল ছুটি থাকলেই গীতামাসির সঙ্গে এবাড়িতে চলে আসে লালুদাদা। গীতামাসি যতক্ষণ কাজ করে, ততক্ষণ খেলা করে দুজনে। রন্টির তো অনেক খেলনা। কত রকমের গাড়ি আছে, দোতলা বাস, রেলগাড়ি, বন্দুক-টন্দুক আরো অনেক কিছু। সেসব নিয়ে খেলা করে ওরা। কখনো আবার খেলনা টেলনা ফেলে, লুকোচুরি বা কুমিরডাঙাও খেলে। রিন্টর সব ইচ্ছে, সব বায়না মেনে চলে লালুদাদা। আবার কত গল্পও শোনায় রিন্টকে। মোট কথা রন্টির কাছে লালুদাদা হল খুশির রং মশাল।
কিন্তু এখন ওকে দেখে একটুও খুশি হল না রন্টি। হবেই বা কি করে? সেই বিচ্ছিরি, এখানে-ওখানে সেলাই করা পুরনো জামা-প্যান্ট পরে এসেছে ও। দেখে কার না রাগ হয়? রন্টি চিৎকার করে ডেকে উঠল, লালুদাদা! চমকে ওর দিকে তাকাল লালুদাদা। অবাক হয়ে ভাবে, অন্য দিন তো ওকে দেখেই আনন্দে জড়িয়ে ধরে রন্টি। ওর হাত ধরে ঝুলে পড়ে কিংবা লাফিয়ে কোলে উঠে পড়ে। আজ হলটা কি?
চোখ পাকিয়ে রন্টি বলে, আজকে যে দুর্গাপূজার অষ্টমী, তা তুই জানিস না? ঠাম্মা বলে, সবচেয়ে ভালো ড্রেসটা আজকে পরতে হয়। না হলে মাদুগ্গা রাগ করে। এই বুঝি তোর বেস্ট ড্রেস?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে লালুদাদা। মুখে কোনো কথা নেই। আর রাগ সামলে রাখতে পারল না। কাছে এসে লালুদাদার হাত দুটো ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কি হল? আমার কথাগুলো বুঝি কানে ঢুকছে না?
লালুদাদা জানে, উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না। এরকমভাবে চেঁচিয়েই যাবে। উত্তর পেতে দেরি হলে হয়তো বেড়েও যেতে পারে রাগটা। তাই মিনমিন করে ও বলল, আমার তো নতুন ড্রেস কেনা হয়নি।
- কেন হয়নি? আমার তো সেই কবেই সব হয়ে গেছে। তোরটা কেন হয়নি? পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলি নাকি?
লালুদাদা বোঝে রন্টির রাগ বাড়ছে। খুব রাগ হলেই ও বড়োদের ভাষায় কথা বলতে থাকে। আর ওকে রাগাতে একটুও ভালো লাগে না লালুদাদার। মাথাটা না তুলেই ও বলল, আমার বাবা যে কতদিন কাজে যায় না। সারাদিন শুধু শুয়ে থাকে আর খকখক করে কাশে।
রন্টি কোমরে হাত দিয়ে, চোখ পাকিয়ে বলে, এই আমাকে বোকা পেয়েছিস না? জামা-প্যান্ট কিনতে বুঝি কাজে যেতে হয়? সুন্দর সুন্দর দোকানে ড্রেস কিনতে পাওয়া যায়, আমি জানি না?
এ কথার কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না লালুদাদা। কিন্তু রিন্টও ছাড়বার পাত্র নয়। বাধ্য হয়ে লালুদাদা বলে, কিন্তু দোকানে গেলেই তো আর এমনি এমনি জামা কাপড় পাওয়া যায় না। ওগুলো কিনতে টাকা লাগে। কাজে না গেলে বাবা টাকা কোথায় পাবে? আর মা তোমাদের মতো দু'তিনটে বাড়িতে কাজ করে যা টাকা পায়, আমাদের তিনজনের খেতে আর বাবার ওষুধ কিনতেই সব ফুরিয়ে যায়।
ঝপ করে রাগ পড়ে গেল রন্টির। ও যে লালুদাদার কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারল তা নয়। তবুও ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। লালুদাদার হাত ধরে নরম গলায় বলল, ও ড্রেস কেনার টাকা নেই বুঝি? সেটা আগে বলিসনি কেন? তুই একটু দাঁড়া, আমি এক্ষুনি আসছি। বলেই পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। একটু পরে ফিরল এক সেট নতুন জামা প্যান্ট নিয়ে। ওগুলো লালুদাদার হাতে দিয়ে বলল, এইগুলো আমার গায়ে খুব বড়ো হচ্ছে। কাকানি দিল্লি থেকে পাঠিয়েছে তো! ঠিক করে কিনতে পারেনি। ভালোই হল, তোর গায়ে হয়ে যাবে।
লালুদাদা দুই হাত নেড়ে আপত্তি জানাল, না-না তোমার ড্রেস আমি পরব কেন?
আবার রাগ ফিরে এল রন্টির গলায়, নে বলছি। শিগগির স্নান করে এগুলো পরে আয়। বলছি না, অষ্টমীর দিন নতুন ড্রেস না পরলে মা দুগ্গার খুব দুঃখ হয়।
হঠাৎ কোথা থেকে গীতামাসি ছুটে এসে জামা প্যান্টগুলো রন্টিকে ফিরিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলল, যাও এক্ষুনি এগুলোর জায়গা মতো রেখে এসো। না হলে মা খুব রাগ করবে।
এমন সময় দরজার আড়াল থেকে মা বেরিয়ে এসে ওদের মাঝখানে দাঁড়াল। তারপর শান্ত গলায় বলল, না গীতা, ওগুলো রন্টি লালুকে দিয়েছে, লালুই পরবে। তুমি এর মধ্যে কথা বলো না।
গীতামাসি ভয়ে ভয়ে বলে, বৌদি, রন্টি তো ছেলেমানুষ। ঠিক ভুল বোঝার বুদ্ধি হয়নি। তুমি কিছু মনে করো না।
মা হেসে বলে, জানো তো গীতা, ছোটেরা অনেক সময় না বুঝে এমন ঠিকঠাক কাজ করে ফেলে, আমরা এত বুঝেও সেটা করতে পারি না। তুমিতো লালুর জামা-প্যান্ট কেনার টাকাটাও আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে গেলে ওর বাবার ওষুধ কিনবে বলে। আমি তাতেও রাজি হয়ে গেলাম। তুমি-আমি কেউ ভাবলাম না, পুজোর দিনে লালু কি পরবে। রন্টি যখন ওর নতুন জামা-প্যান্টগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে ওই সেটটা নিয়ে ঘর থেকে বেরল, আমি আড়াল থেকে দেখেছিলাম ও কি করে! পুজোর দিন এত ভালো একটা কাজ করল ও, দেখে আমার মনটা ভরে গেল। এই বয়সেই ছেলেটা বুঝে গেছে ভাগ করে জিনিস নেওয়ার কত আনন্দ।
মায়ের কথাগুলো ওর কাছে কানে ঢুকছে না। শুধু মাকে দেখছে আর ভাবছে, ইস সাজুগুজু করে মাকে কি সুন্দর দেখতে লাগছে! রন্টি কালার পেন্সিল দিয়ে ড্রইং কপিতে মা দুগগার যেমন ছবি আঁকে, ঠিক তেমনটা। কপালে শুধু আর একটা চোখের জায়গায় এত বড়ো একটা লাল টকটকে টিপ পরেছে মা। কথা বলতে বলতেই মায়ের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। কিন্তু রন্টি জানে ওটাকে বলে খুশির কান্না। চোখের জল মুছে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা লালু তাড়াতাড়ি স্নান করে নতুন জামা-প্যান্টগুলো পরে আয়। তুই এলে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে অঞ্জলি দিতে যাব। মায়ের কান্না দেখে রন্টির চোখে জল এসে গিয়েছিল। মায়ের কথাগুলো শুনে জোরে জোরে হাততালি দিয়ে উঠল। জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে গীতামাসি বিড়বিড় করে, জয় মা দূর্গা। সঙ্গে সঙ্গে রন্টিও বলে উঠল, জয় মা দূর্গা।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
Topic : সামাজিক গল্প, ছোটোদের অনুভবের গল্প, Social stories, stories of children's feelings, পুজোর গল্প
0 মন্তব্যসমূহ