তাঁতী আর তার বউ থাকে এক রাজ্যের একটি গ্রামে। তাঁতি তাঁত বোনে। তাদের বোনা কাপড় রাজা-রানীর খুব পছন্দ। তাঁতী বউ ঝুড়িতে কাপড় সাজিয়ে নিয়ে গিয়ে রানীকে দেখায়। রানী পছন্দ মতো কাপড় বেছে নেয়। তাঁতী ও তাঁতী বউ খুব সৎ, সহজ-সরল। ঈশ্বরের নাম না নিয়ে সকালে জল পর্যন্ত খায় না। মিথ্যে কথা বলে না, কাউকে ঠকায় না।
কিন্তু তাদের মনে সুখ নেই। ঠাকুরকে ডেকে চলেছে একটি সন্তানের আশায়। তাদের ডাক মিথ্যে যায়নি। অনেক বছর পরে ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তান জন্মালো। গ্রামের সবাই বলল, আহা, কি সুন্দর দেখতে, ঠিক যেন রাজপুত্তুর। বাবা-মা আদর করে ছেলের নাম রাখল মানিক কুমার।
মানিক কুমার ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। এখন সে তরুণ। সে হাসলে যেন মণি-মুক্ত ঝরে পড়ে। কালো কোঁকড়ানো মাথার চুল, খাড়া নাক, ফর্সা গায়ের রঙ। মানিক কুমারকে যে দেখে সেই বলে তাঁতীর ঘরে একে মানায় না।
মানিক কুমারের তাঁত বুনতে ভালো লাগে না। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। তার ভালো লাগে নৌকায় চেপে নদীতে একা একা ঘুরে বেড়াতে। নদীর অন্যপ্রান্ত যেন তুলির টানে ফুটে ওঠার ছবি। সবুজ রেখায় মিশে গেছে আকাশ। ঢেউয়ের সাথে কুস্তি করে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক অন্য অনুভূতি মানিক কুমারের কাছে।
একদিন সে তার মাকে বলল, বিশাল কাপড়ের বোঝা নিয়ে যেতে তোমার খুব কষ্ট হয়। আমার বন্ধুর একটা ঘোড়া আছে। তুমি তো ঘোড়ায় চড়তে পারো না। কাপড়ের বোঝা আর তোমাকে আমি ঘোড়ায় করে পৌঁছে দেব। বন্ধু বলেছে, আমার যখনই ঘোড়ার দরকার হবে আমাকে দেবে।
এখন থেকে মানিক কুমার মাকে আর কাপড়ের বোঝা পৌঁছে দেয় রাজবাড়ীতে। তবে মানিক কুমার রাজবাড়ির ভেতরে যায় না। তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে।
একদিন মানিক কুমারের মার শরীরটা খারাপ তাই সে নিজেই কাপড়ের বোঝা নিয়ে গেল রাজবাড়ীতে। কিন্তু দারোয়ান ঢুকতে দিল না। তবুও মানিক কুমার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিল যদি এবার ঢুকতে দেয়। তখনই রাজকন্যা মালতি সখীদের নিয়ে স্নান করতে যাচ্ছে নদীতে। মানিক কুমারকে তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল রাজকন্যা। একজন সখীকে বলল, তাকে ডেকে আনতে।
মানিক কুমার কাছে এলে রাজকন্যা জিজ্ঞেস করল, ঘোড়ার পিঠে কিসের বোঝা। তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছো কেন?
মানিক কুমার সব কথা খুলে বলল। শুনে রাজকন্যা রাজকর্মচারী মারফৎ এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে সব কাপড় কিনে নিল।
মানিক কুমার বলল, রাজকন্যা এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিলেন, অথচ দেখলেন না কাপড় পছন্দ হয়েছে কিনা। রাজকন্যা মালতি মুচকি হেসে বলল, যা দেখার ঠিকই দেখেছি। আমার শরীরে বইছে রাজরক্ত। সওদা করে ঠকি না কখনও। মানিক কুমার আনন্দে বাড়ি ফিরে গেল।
এরপর মানিক কুমার রোজ তোরণের সামনে অপেক্ষা করতো, যতক্ষণ না মা ফিরে আসতো রাজবাড়ী থেকে। রাজকন্যা রাজপ্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো তোরণের দিকে।
রাজা একদিন রথে চেপে বেরিয়েছেন সান্ধ্য ভ্রমণে। রাস্তার দু'ধারে ঝোপঝাড় এত ছিল যে বুঝতেই পারেনি কখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝোপের আড়াল থেকে তীর এসে আঘাত করল রথের ঘোড়াকে। রাজার দেহরক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন দস্যু রাজার মাথায় মুকুট কেড়ে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রাজা ভাবতে পারেনি এরূপ ঘটনা তার রাজ্যে ঘটবে। হতাশায় তিনি ভেঙ্গে পড়লেন এই ভেবে যে, রাজার মুকুট রাজার গর্ব, রাজার সম্মান। তাছাড়া তার মুকুটে সোনা, রুপো, হীরে, জহরত ছাড়াও ছিল একটি মানিক। তার সাত রাজার ধনের সমান।
দিনের পর দিন রাজা চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজবৈদ্যরা বহু চেষ্টা করেও রাজাকে সুস্থ করতে পারছেন না। রাজার পুত্র নেই। একমাত্র কন্যা মালতি। রাজার চিন্তা মালতির বিয়ে দিয়ে যেতে পারবেন কিনা! নাকি তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে!
রাজকন্যার মনেও সুখ নেই। সারা রাজ্যে যেন নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ঢ্যারা পিটিয়ে রাজকন্যার নির্দেশে ঘোষণা করা হল যে মানিক উদ্ধার করে দিতে পারবে তার হাতে রাজকন্যা নিজের হাতে উপযুক্ত পুরস্কার তুলে দেবেন।
রাজবাড়ীতে কাপড় দিতে যাওয়া বন্ধ। দুঃখের দিনে কেই বা আর কাপড় কিনবে! রাজকন্যা মালতি রাজপ্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে মানিক কুমারকে দেখে। সে দেখাও বন্ধ।
একদিন মানিক কুমার নৌকায় চেপে এগিয়ে চলে। সামনে বালুর বাঁধ, সেন্ড হেড নদীর জলের তলায়। তাতে ধাক্কা লেগে অনেক নৌকাও জাহাজ এখানে ডুবে গেছে। তাই সাবধানে নৌকা চালাচ্ছে সে। ডানদিকে হিজলির মসনদ-ই-আলা, বাঁয়ে সাগরদ্বীপ। ভগীরথ গঙ্গাকে ডেকে এনেছিল এখানে। ঢেউয়ের মাথায় জেগে উঠছে আলোর ফুলকি। সহস্র হীরক দ্যুতি যেন। আকাশের দ্বিতীয়ার চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। সে এক মনোরম দৃশ্য। দেখলো উজ্জ্বল একটা আলোর রশ্মি ঢেউয়ের তালে মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে। মানিক কুমার ভাবল জলপরী হবে। নয়তো বা আলেয়া! সেদিন বাড়ি ফিরে এলো মানিক কুমার।
কিছুদিন পর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে মানিক কুমার। নদীর চরে ঘুরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। গরুগুলো হঠাৎ খুব ছোটাছুটি শুরু করল। মানিক কুমার তাড়াতাড়ি সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল, লম্বা দড়ির একপ্রান্তে একটা বলদের গলায় বাঁধা। অপরপ্রান্ত বাঁধা বাঁশের ছোট একটা খুঁটির সঙ্গে। নদীর থেকে একটা বিশাল কুমির ডাঙায় উঠে এসে দাঁত দিয়ে খুঁটি ধরে জলের দিকে টানছিল। কুমির একবার হাঁ বন্ধ করলে সহজে খোলে না। তার দাঁতের ফাঁকে আটকে গেছে বাঁশের খুঁটি। ভয় পেয়ে বলদটি দৌড়চ্ছে। খুঁটির সঙ্গে কুমিরকেও টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে আর অন্য গরুগুলোও দৌড়চ্ছে।
মানিক কুমার তাড়াতাড়ি গ্রামের লোকেদের জড়ো করল। আর মেরে ফেলল কুমীরটাকে।
তারা বলাবলি করতে থাকল, এটা কোনো জল দেবতা বা দানব হতে পারে! তা না হলে তার পেটের ভেতর থেকে আলোর রশ্মি বেরিয়ে আসবে কেন? মৃত কুমীরের পেটের দিকে তাকিয়ে লোকেরা এমন ঘাবড়ে গেল যে, তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেল।
মানিক কুমার ছুরি দিয়ে মৃত কুমিরের পেটে কেটে যা দেখলো তাতে হতবাক হওয়ারই কথা! আনন্দে ও বিস্ময়ে তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না। সে ঘোড়ায় চেপে রাজবাড়ীর তোরণের সামনে উপস্থিত হয়ে প্রহরীকে বলল, আমি রাজকন্যার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
- তোমার সাহস তো কম নয়! রাজকন্যার সঙ্গে দেখা করতে চাও! তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।
- আমি এখান থেকে যদি চলে যাই, তাহলে রাজকন্যার বিপদ হতে পারে।
- মানে?
- মহারাজ অসুস্থ। আমি এমন ওষুধ নিয়ে এসেছি যার সাহায্যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। রাজকন্যাকে এই খবরটা জানিয়ে দাও। আমি তোরণের সামনে অপেক্ষা করছি।
খবরটা জেনে মানিক কুমারকে ডেকে পাঠাল রাজকন্যা। রাজা শুয়ে আছেন পালঙ্কে। পাশে রয়েছেন রানী ও মালতি। মানিক কুমার পালঙ্কের কাছে গিয়ে রাজাকে প্রণাম জানিয়ে বলল, মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।
রাণী বলল, আর বাবা উনি এখন তো মৃত্যু পথযাত্রী। দীর্ঘজীবী হবেন কিভাবে!
- রানিমা আমি মহারাজের জিয়নকাঠি এনেছি। এই নিন।
সে রানীমার হাতে দিল একটি উজ্জ্বল বস্তু। তার ছটায় সারাঘর আলোয় ভরে গেল। অসুস্থ রাজা চিৎকার করে বলে উঠল, পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি।
সারা রাজপ্রাসাদ হতভম্ব হয়ে গেল। কি পেয়েছে তাদের মহারাজ! রাজকন্যা মালতি শান্ত গলায় বলল, বাবা তার হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে। মহারাজ তার সম্মান, তার সাত রাজার ধন মানিক ফিরে পেয়েছেন।
ছুটে এল মন্ত্রি পরিষদবর্গ। তারা বলাবলি করতে লাগল. দস্যু রাজমুকুট ছিনতাই করেছিল। মানিকটা সেই মুকুট এই শোভা পেত। তাহলে তাঁতীর ছেলে সেই মানিক পেল কোথায়?
মানিক কুমার বলল, দস্যু রাজমুকুট চুরি করে নৌকোয় করে পালিয়ে যাচ্ছিল। সেই নৌকা নদীতে ডুবে যায়। মানিকটা দস্যুর কাছে ছিল। কুমির দস্যুকে খেয়ে ফেলে। মানিকও কুমিরের পেটে চলে যায়। কুমির ধরা পড়লে তার পেট থেকে পাওয়া যায় এই মানিক।
রাজা উঠে বসলেন। বললেন, তোমার পুরস্কার হল আমার কন্যা মালতির সঙ্গে তোমার বিবাহ আর এই রাজ্য।
রাজপ্রাসাদ মেতে উঠল আনন্দে। চারিদিকে সাজে-সাজো রব।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : রূপকথার গল্প, Fairy tales, Children's favorite story, The story of Tanti's son and princess
0 মন্তব্যসমূহ