মেহুলের স্কুলে আজ বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হল। বরাবরের ভালো ছেলে মেহুল। কারো সাহায্য ছাড়াই তরতর করে ওর পড়াশোনা এগিয়ে চলে। এবারও তাই। ফার্স্ট হয়েই ক্লাস সেভেনে উঠল ও। রিপোর্ট কার্ড দেখলো সব A+। কন্ডাক্ট, অ্যাটেনডেন্স সব-সব।
বাড়িতে ফিরে এল নটার মধ্যেই। এসে দেখল সাজ-সাজ রব। ছোটো বোন পিদিমের আজ স্কুলে এডমিশনের ইন্টারভিউ। ছোট্ট পাঁচ বছরের পিদিম। বাবা পর্যন্ত ব্যস্ত। ছোটুয়া খবর দিল পিদিম মেমসাহেব স্কুলে যাচ্ছে। পিদিমের জন্য বাবার অফিস কামাইটা অবশ্য নতুন কিছু নয়।
মনটা খুব বিষন্ন হয়ে গেল। তোশকের নিচে রিপোর্ট কার্ডটা লুকিয়ে রাখল মেহুল। ছোটুয়াকে ডাকল। ছোটুয়া এসে জানাল, পিদিমের ঘরে এখন অনেক কাজ। পরে আসবে। মেহুলের খুব খিদে পেয়েছে। কোন সকালে এক গ্লাস দুধ খেয়ে বেরিয়েছে। বাড়ি ফিরে কিছু খাবে ভেবেছিল। কিন্তু সবাই তো পিদিমের ঘরে।
সাত বছর বয়স পর্যন্ত উজাড় করা আদরে বড়ো হয়েছিল মেহুল। মায়ের নয়নের মণি। স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, নিয়ে আসা, নানারকম টিফিন বানিয়ে দেওয়া সব মা করতেন কত আনন্দের সঙ্গে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে মেহুলের। বাবাও অন্যরকম ছিলেন। সপ্তাহের শেষে ঘুরতে যাওয়া হত বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর কখনও বা গঙ্গার ঘাট। কী যে মজার দিনগুলো ছিল। সন্ধের সময় স্কুলের হোমওয়ার্ক মায়ের কাছে। যদিও তখনও মেহুল সব নিজে নিজেই করত। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া কখনই মায়ের কাছছাড়া হত না। রাতে বাবা আর মায়ের মাঝখানে শুত। পালা করে গল্প বলা হত। নানা রকম গা শিরশিরে ভূতের, দমফাটা হাসির, আবার কখনও রূপকথার।
কিন্তু একদিন সব অন্যরকম হয়ে গেল। মা হাসপাতালে গেলেন। ছোটুয়া বলল, মা নাকি মেহুলের জন্য ভাই বা বোন নিয়ে আসবেন।
যাওয়ার সময় মেহুলের হাত দুটো জড়িয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস সোনা। মায়ের কথায় মেহুলের চোখ জলে ভরে এল। মাকে ছেড়ে থাকা তো এই প্রথম।
রাতে বাবার কাছে শুল। কিন্তু গল্প হল না। দুদিন পরে বাবার কাছে মেহুল শুনল, ওর একটা বোন হয়েছে। কয়েকদিন পরে বাবা ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটা কাচের ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে একটা জাপানি ডল। ওটা নাকি ওর বোন! মেহুলি চিন্তাই করতে পারল না। এক মাথা কালো চুল। নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। অনেকেই দেখতে এসেছিল। মেহুল শুনল, মা বলছেন, একটা মেয়ের খুবই শখ ছিল বড়দি।
একটু পরেই মেহুলকে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতে হল। কই মা তো তাকে কাছে ডাকলেন না! আদর করলেন না! জিজ্ঞেস করলেন না, কেমন আছিস!
মেহুলের মন খারাপ। খুব। ছোটুয়া জানতে চাইলে গম্ভীর মুখে উত্তর দিল, খুব সুন্দর। আমার বোন।
মেহুলের ভালো নাম আত্রেয়। যখন ওর আর কিছু ভালো লাগে না তখন ও আত্রেয় সঙ্গে কথা বলে।-কি মেহুল মা তোমাকে চিনতেই পারলেন না। এবার তাহলে তোমার আদর কমে যাবে। কেন আমি কি মায়ের ছেলে নই। অবশ্যই। কিন্তু শুনলে না মেহুল মায়ের বড়ো শখ ছিল একটা মেয়ের। ধমক দিয়ে আত্রেয়কে চুপ করাল মেহুল। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যে নামছে। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। মনে মনে ভাবল ও যদি তারা হয়ে যায় তাহলে বেশ হয়। ওখানে গিয়ে দেখবে মায়ের মন খারাপ হয় কিনা! আমাকে সত্যি ভালোবাসে কিনা!
ছোটুয়া খেতে ডাকল। বাবাও একসঙ্গে খেলেন। বাবা যে কেন গম্ভীর বুঝল না। এত মিষ্টি একটা নতুন মানুষ এল তবুও!
অন্যদিন স্কুলের সময়টা বেশ কেটে যায়। শনি-রবিবার মেহুল একদম ভালোবাসে না। কম্পিউটার আর গল্পের বই বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। হোমওয়ার্ক মুহূর্তে শেষ। আর মাঝে মাঝে ছোটুয়ার সঙ্গে সাপলুডু খেলা। ও খুব মজা পায়। আর একদিন ও বোনকে দেখতে গিয়েছিল। সেদিন কাচের ঘরটা ছিল না। পিটপিট করে দেখছিল। মা হাসছিলেন।–মেহুল দেখ। দাদাইেক কেমন দেখছে। ওই একটা মাত্র কথা। শুনল মা কাল বাড়ি ফিরবেন। সকাল ন'টার মধ্যে।
সকালে উঠে মেহুল ইচ্ছে করেই শ্বাম্বর বাড়ি চলে গেল। বলে গেল ছোটুয়াকে বারোটার আগে ফিরবে না। কিছু মুখে না দিয়েই বেরিয়েছে। বাড়ি এসে শুনল কেউ তার খোঁজ করেনি।
আচ্ছা, এতদিন আগের কথা মেহুল কেন ভোলে না! কত বছর কেটে গেছে। সব মনে আছে মেহুলের। জাপানি পুতুলটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল সেদিন। টুক করে দেখে এল। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হল। একটু হাসলেন। সেদিন দুপুরের খাবার চুপ করে খেয়ে নিল। সারাদিন কেউ ওর খোঁজই নিল না। তবে কি বোন আসার পর ও আর মায়ের ছেলে নয়!
আত্রেয় বলল, ঠিকই তো খোঁজ না নেওয়ার মতো এমন কি ব্যস্ততা। মেহুল কি মস্ত বড়ো হয়ে গেছে!
তারপর! পাঁচ-পাঁচটা বছর কেটে গেল। একা একাই বড়ো হয়ে গেল। সাত থেকে বারো। বোন এখন বাবা-মায়ের মাঝখানে শোয়। ভারি মিষ্টি কথা ওর, দাদাই-এর সঙ্গে ভাবও আছে। মেহুলের খাট এখন ওর স্টাডিরুমে। মনে পড়ে পিদিমের অন্নপ্রাশনের ঘটা। সবাই চমকে গিয়েছিল। কে জানে! হয়তো মেহুলেরও ওইরকমই হয়েছিল। অত ছোটোবেলার কথা তো আর মনে নেই। মা ডাকেন, কথা বলেন, পড়ার খবর নেন, কিন্তু কোথায় যেন বেশ একটু ফাঁক।
সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। আজ তো বিশেষ করে মনে পড়ছে। পিদিম যাবে মেমসাহেবের স্কুলে। তার তোড়জোড়ে সবাই ব্যস্ত। মেহুলের যে আজ রিপোর্ট বেরল, কেউ কি জানে! তোশকের তলা থেকে বের করে ওটা টুকরো টুকরো করে ফেলে জানলা দিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল সব A+ গুলোকে। ও ঠিক করল পরের বছর একটুও পড়াশোনা করবে না। খুব খারাপ রেজাল্ট করবে। তাহলে হয়তো ও বকুনি খাবে। একটু নজর পাবে।
ছোট্ট মেহুল বড়ো বোকা। ও তো জানেই না, পিদিমের জন্ম থেকেই ওর হার্টে একটা গণ্ডগোল আছে তাই সব সময় ওকে চোখে চোখে রাখতে হয়। অনেক সাবধানে। আর তাইতো ওর নাম পিদিম।
অলংকরণ – অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
Topic : The story of experience for Children, ছোটোদের অনুভবের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ