সবাই তাকে ফুটফুটি বলেই ডাকে। লালচে চুল, টকটকে গায়ের রঙ, আর কটা দুটো চোখ। দেখতে অনেকটা সাগরপারের মেয়ের মতো। কিন্তু না, নেহাতই বাড়ি-বাড়ি বাসন মেজে আর টুকটাক ফাইফরমাশ খেটেই তার দিন কাটে। হাসিমুখেই এসব করে। বিনিময়ে কখনো কিছু পয়সা, কখনও বা কিছু খাবার।
মাথার রুক্ষ চুল, ছেঁড়া ময়লা ফ্রক পরা মেয়েটিকে পাড়ার সবাই স্নেহ করে। তবে কোনো কোনো গিন্নি এই ফুটফুটির ওপর আবার ভীষণ চটা। মেয়েটার জ্বালায় গাছের ফুল-ফল কিছু রাখার জো নেই। কোন কাকভোরে উঠে এর গাছের ফুল, ওর গাছের ফল পেড়ে নিয়ে উধাও। সবাই বলে মেয়েটা আগের জন্মে বোধহয় কাঠবেড়ালি ছিল। তরতর করে উঁচু ডালে ওঠে, তরতর করে নেমেও আসে। গাছের সুন্দর সুন্দর ফুল আর ফলগুলো যেন ওর হাতের মোচর খাওয়ার জন্যই ফুটে থাকে। কোঁচর ভরা ফুল বা ফল নিয়ে ও যখন দাঁড়ায়, তখন ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর হাসি।
গিন্নিদের কাছে এই সাগরপারের মেয়েটির প্রয়োজনও অপরিহার্য। সময়ে ফাইফরমাশ খেটে দেওয়ার জন্য ওর জুড়ি মেলা ভার।
হঠাৎই পাড়াতে এক চিত্রশিল্পী এল। নিজের আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবিতে সাজানো তার ঘর।একদিন তার নজর পড়ল পাশের বিরাট দিঘীতে। স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল, চারিপাশে সারিবদ্ধ নারকেল গাছ। আর দিঘীর মাঝখানে প্রস্ফুটিত পদ্মের মেলা। চোখজুড়ানো এই দৃশ্য তাকে পাগল করে তুলল। সুন্দরকে ছবিতে ধরে রাখাই তার নেশা। কদিন পরে এই সুন্দর দৃশ্যই স্খান পেল তার ঘরের দেওয়ালে।
শিল্পীর ঘরেও একদিন ফুটফুটে আবির্ভাব ঘটল। সব বাড়িতেই তার গতিবিধি অবাধ। শিল্পের ঘরেও প্রবেশ করতে তার কোনো কুণ্ঠা রইল না। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, কি সুন্দর! দিঘীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, অতদুর থেকে পদ্ম দেখে তুমি কি করে আঁকলে গো ছবি বাবু? শিল্পীকে ছবি বাবু বলে ডাকা শুরু করল।
সস্নেহে ছবি বাবু বলে, দূর থেকে না আঁকলে জলের পদ্মকে কাছে পাবো কি করে?
ময়লা ফ্রকটাকে দুলিয়ে, রুক্ষ চুল ঝাঁকিয়ে ফুটফুটি বলে, কেন, আমায় বললেই তো আমি এনে দিতাম।
শিল্পী অবাক হয়ে বলে, ওই গভীর জল থেকে পদ্ম আনবি? ভারি দস্যি মেয়ে তো তুই! ডুবে যাবি যে?
ফুটফুটি সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলে, আমি সাঁতার জানি গো বাবু। শীর্ণ ধপধপে হাতে আনন্দে তালি দিয়ে বলে ওঠে ফুটফুটি, আমাকেও ওরকম ছবি এঁকে দেবে?
শিল্পী বলে, বেশ, তুই পদ্ম এনে দিস, আমি আসল পদ্ম সামনে রেখে পদ্মর সঙ্গে তোর ছবিও এঁকে দেব।
পরদিন সকাল হয়। সময় গড়িয়ে দুপুরও। হঠাৎ শিল্পী জানলা দিয়ে দেখে ঘাটের কাছে বেশ কিছু লোকের জটলা। কৌতুহলী শিল্পী পা বাড়ায় পদ্ম দীঘির দিকে। ঘাটের কাছে এসে চমকে ওঠে!
ভোর হতেই ফুটফুটি বাড়ি বাড়ি ফাইফরমাস খেটে দিঘিতে নামে পদ্ম তোলার জন্য। সাঁতার কেটে মাঝ দিঘীতে গিয়ে বেশ ক'টা পদ্ম তোলে। এমন সময়েই বিষাক্ত কেউটের ছোবলে তীব্র যন্ত্রণায় ফুটফুটির আর ফিরে আসা হয় না। তলিয়ে যায় পদ্ম দীঘির গভীর জলে।
শিল্পী অবাক চোখে ফুটফুটির নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে তার শ্বেত পদ্মের গোছা। যা শিল্পীকেই দেবে বলে তুলেছিল।
কথা দিয়েছিল শিল্পী। পদ্মের সঙ্গে ওর ছবিও আঁকবে। ফুটফুটির কথাগুলো মনে পড়ে যেতেই বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। হাতে তুলি তুলে নিয়ে ব্যথাতুর শিল্পী ক্যানভাসের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কি আঁকবে, ছটফটে ফুটফুটির ছবি নাকি নিথর হয়ে পদ্ম হাতে পড়ে থাকা মেয়েটিকে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : Social story, সামাজিক গল্প, The story of a little girl, ছোট্ট একটি মেয়ের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ