আজও শম্ভু মুচি কাকভোরে উঠে ধারালো ছুরি হাতে বেরিয়ে গেল। খালের ওপারে গো-ভাগাড়। সেই ছোট্টবেলা থেকে সে এই ভাগাড়টা দেখে আসছে। গরু-মোষ মরে গেলে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে এখানে এনে ফেলে দেওয়া হয়।
গামুইরা কিছুটা ঘাস ছিঁড়ে গরু-মোষের লেজ থেকে সারা শরীরে বুলিয়ে মুখে গুঁজে দিয়ে বলে, পর জন্মে মানুষ হয়ে ফিরে আসিস।
মুহূর্তের মধ্যে গন্ধর্বলোকের দূতেরা পাখা মেলে সাঁই-সাঁই করে নেমে আসে ভাগাড়ের মাঝে। গন্ধ পেয়ে আশেপাশের কুকুরগুলোও ছুটে আসে। লেগে যায় কুকুর-শকুনের লড়াই।
শকুনগুলোর গতিবিধি লক্ষ্য করে কিনারা বুঝে নিয়ে, যমদূত হয়ে হাজির হয় শম্ভু মুচি। কোমর থেকে ধারালো ছুরিটা বের করে এগিয়ে এলেই ক্ষুদার্থ কুকুর-শকুনের দল পালাতে পথ পায় না। ক্ষণিকের মধ্যে ছালটা ছাড়িয়ে সোজা পথ দিয়ে নয়, মাঠের উপর দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়, যাতে কোনো জাতভাইকে ভাগ দিতে না হয়।
পুজোর মাত্র আর কটা দিন বাকি। এমন সময়ে রোজগারের তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে শম্ভু মুচি। বাবার সঙ্গে ছেলে নকুলও যায় কাঁসি বাজাতে শহরের বড়ো প্যান্ডেলে। শহরের বাবুদের ছেলেদের দেখে নকুলের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। নিজের ছেঁড়া জামা প্যাণ্ডেলের গায়ে হেলান দিয়ে লজ্জা ঢাকে সে। এবার ঠিক করেই ফেলেছে বাবার কাছে একখানা নতুন জামা-প্যান্ট চাইবে।
সেদিন সন্ধায় শম্ভু মুচি দাওয়ায় বসে সময় কি যেন ভাবছিল। নকুল দুরুদুরু বুকে বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, বাপ ইবার কইলক্যাতায় যাবিনি। ইবার কিন্তু আমায় একখান লতুন জামা দিবি।
শম্ভু নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নকুলের দিকে। তার মন পড়ে রয়েছে ভাগাড়ে। ইদানিং গরু-মোষের সংখ্যা কমেছে। পুজো তো এসেই গেল। ঘরে একটাও ঠিক নেই। বর্ষা ঢাকগুলোর চামড়া সব নষ্ট হয়ে যায়। এর উপর এবছর দুই বিঘে জমি আগাম টাকা জমা নিয়ে চাষ করতে গিয়ে খরায় সর্বস্বান্ত। কি করে চলবে সামনের দিনগুলো! না খেতে পেয়ে যে মরতে হবে সবাইকে। ভাবনা ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে। চোখ লাল করে বলে উঠল, না যাবনি।
নকুল দু-চোখ ভরা জল নিয়ে কখন রান্নাঘরে মায়ের কাছে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা ঠাণ্ডা হতে শম্ভু ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, আমরা কি আর পাঁইচ জনের মতন! নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কইলক্যাতা থেকে ফিরে তুকে নতুন জামা কিইনা দিব বাপ।
আজ আর ছুরি হাতে কাকভোরে উঠে ভাগাড়ের পথ মাড়াল না শম্ভু মুচি। দাওয়ায় গুম হয়ে বসে বিড়িতে টান দিয়েই চলেছে এক নাগাড়ে। হঠাৎই গোয়াল ঘর থেকে নকুলের মা চিৎকার করে উঠল, হায়-হায়-হায় পোড়া কপাল আমার, ও নুকুলের বাপ- আমাদের গাইটা যে আর নাই...
শম্ভু মুচি ছুরিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের বুককে পাষাণ করে পোষা গাভিটার ছাল ছাড়িয়ে নিল।
ঢাক তৈরি। কাঠি পড়ল গাইয়ের চামড়ায়। গুরুগুরু শব্দ নকুলও ছুটে এলো কাঁসি হাতে। বাপ-ছেলের যুগল মহড়ায় সারা উঠান জুড়ে খুশির হাওয়া বয়ে গেল। নকুলের মা তুলসী তলায় দু-হাত তুলে দুগ্গা মাকে স্মরণ করল।
কেন্নোর মতো ট্রেনটা এগিয়ে আসছে প্ল্যাটফর্মের দিকে। নকুল তারই অপেক্ষায়। শম্ভু মুচি কী যেন এক ভাবনার সাগরে ডুবে আছে এখনো।
হঠাৎই লোকজনের কোলাহল আর ঠেলাঠেলিতে শম্ভু মুচির ঘোর কাটল। এদিক ওদিক তাকিয়ে নকুলকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল সে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রক্তাক্ত শরীরের গন্ধর্বলোকের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নকুল। শম্ভু মুচি নিমিষে ঝাঁপিয়ে পড়ল নকুলের ওপর। হাহাকার করে কাঁদতে থাকল পাগলের মতো। পেতিশোধ! পেতিশোধ নিলি হারামজাদি? আমার দুধের ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে তোর পেট ভইরবে তো? ইছাড়া আমার আর কি-ই বা করার ছিল! গাইটাকে তো আর ইচ্ছে করে মারিনি! পাইরলে নিজের গলাতেই ঢাইলতে পাইরতুম বিষটা। লকুল- লকুলরে- বাপ আমার...
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : সামাজিক গল্প, Social story, হৃদয় স্পর্শ করা গল্প Educational stories, Heart touching story, Stories for the little ones, ছোটোদের জন্য গল্প
1 মন্তব্যসমূহ
Play Blackjack at a Casino! - Microgaming - Microgaming
উত্তরমুছুনA classic card goyangfc game is a thrilling and engaging blackjack game at Microgaming. septcasino This fun game is now available wooricasinos.info for https://septcasino.com/review/merit-casino/ your https://septcasino.com/review/merit-casino/ device!