আমাদের বাড়িতে কারা যেন এসেছে। আমরা যখন ঘুমাই তখন তারা হেঁটে বেড়ায়। মা-বাবা অঘোরে ঘুমোয় কিছু শুনতে পায় না, আমি কিন্তু সব শুনি।
পরদিন বাবা-মাকে বললাম, এই বাড়িতে আরো কেউ রয়েছে। আমি ঘুমের মধ্যে আওয়াজ শুনতে পেয়েছি।
মা-বাবা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। তারপর বললেন, তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
এর আগেও একবার তেনাদের উপদ্রব হয়েছিল। তখন মার্কাসকাকু কিভাবে জানি ওদের ভাগিয়েছিলেন। সেটা বেশ কিছুদিন আগের কথা, তাই ঠিক মনে নেই। আসলে বাড়িটা অনেক পুরনো আর বেশ বড়োসড়ো তাই মাঝে মাঝেই তেনাদের উপদ্রব হয় এখানে।
খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। গলাটা শুকিয়ে গেছে। এখন জল তেষ্টা পেলে আর মাকে বিরক্ত করি না। নিজেই উঠে নিয়ে নিই। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় দেখতে পেলাম আমারি বয়সি একটা ছেলে। পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে।
কে তুমি? আমাকে জিজ্ঞেস করল সে।
আমি পিকলু। এই বাড়িতেই থাকি।
ধ্যাৎ! এই বাড়িতে তো আমরা থাকি!
তোমার নাম কি? আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম।
রোহিতাশ্ব, তবে সবাই আমাকে গাবলু বলে ডাকে।
ওর নাম শুনে আমি, গাবলু হু-হু-হু করে হাসতে লাগলাম।
সেই থেকেই আমাদের দুজনের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। গাবলুর কথা আমি মা-বাবাকে বললাম না। ও তো শুধু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আসে তাই মা বাবা জানতে পারেন না ওর আসার কথা। কি দরকার! জানতে পারলে যদি আবার মার্কাসকাকুকে ধরে নিয়ে আসে! তাহলে তো আর গাবলুর সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখাই হবে না। গাবলু অবশ্য বলেছে সেও আমার কথা কাউকে বলেনি।
আমরা এখানে নতুন এসেছি তো তাই আমার এখানে কোনো বন্ধু নেই। গাবলু দুঃখ করে বলে।
কেন আমি তো আছি।
হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে কি জানো, আমরা আগে যেখানে থাকতাম সেখানেও আমার বন্ধু ছিল তা নয়। আমি নিজের মনে বকবক করতাম বলে সবাই হাসতো।
ও তাই নাকি! আমি আর ওকে বললাম না যে আমারও তেমন বন্ধু নেই। ও মনে হয় বুঝেছিল।
হ্যাঁ, তারপর আমার খুব শরীর খারাপ হল। কত ডাক্তার, কত ওষুধ। সে রোগ আর সারে না।
তারপর?
তারপর আর কি এখানে চলে এলাম। এখন ভালো আছি।
ও!
আর ওসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না, চলো খেলি। এই দেখো আমার খেলনা এনেছি।
আমিও নিজের খেলনা নিয়ে এসেছি। তাই দুজনে মিলে বেশ মজা করে খেলা করলাম। গাবলু ভারি মজার ছেলে আমাকে খালি হাসায়।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল এমন সময় একদিন মা দেখে ফেললেন। আমি আর গাবলু সেদিন টেবিলের তলায় ঢুকে গুহা গুহা খেলছিলাম। এমন সময় কিছু একটা করে পড়ে গেল। মনে হয় মার সেই শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কোণের ঘরে এসে আমাকে দেখতে পেলেন। গাবলুকে দেখেই মার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গাবলুও বুঝলো মা ওকে দেখেছেন, তাই স্যাৎ করে পালাল।
আমি মুখ গোমড়া করে মাকে বললাম, দিলে তো খেলাটা নষ্ট করে। গুহার গুপ্তধন প্রায় খুঁজে ফেলেছিলাম! আর একটু পরে আসতে পারলে না তুমি!
মা আর কিছু বললেন না। শুধু বললেন, চলো শোবে চলো।
পরে শুনলাম, মা-বাবাকে বলছেন, পিকলু আবার যাদের নাম করতে নেই তাদের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে! কি হয়েছে বল তো ছেলেটার, কেন এইরকম করে! এই বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে মনে হয়। তেনাদের বড্ড উপদ্রব বাড়ছে। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে।
বাবা বললেন, ভয়ের কিছু নেই, আবার মার্কাসকে ডাকতে হবে। সেই আসবে ঝাড়ু-ঝ্যাঁটা নিয়ে ওদের তাড়াতে। বাড়ি ছাড়ার দরকার হবে না।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, না না আমার বন্ধুকে তাড়িও না।
বাবা-মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। ভাবখানা এমন যেন ছেলেটাকে আর বাঁচানো যাবে না।
বাবা মার্কাসকাকুকে খুঁজতে চলে গেলেন। আমার মনে হয় ভাগ্যটা ভালো। কারণ একটু পরেই ফিরে এসে বললেন, না, মার্কাসকে এখন কিছুদিন পাওয়া যাবে না। রবার্ট সাহেবের বড়ো নাতনিরও পিকলুর রোগ হয়েছে। তাই সে রবার্ট সাহেবের বাংলাতে গেছে।
আমি তো সেটা শুনে আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিলাম।
মা বললেন, তাহলে উপায়?
কিছু করার নেই। রবার্ট সাহেবের নাতনির রোগ না সারা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
রবার্ট সাহেবের নাতনির রোগ মনে হয় বেশ প্যাঁচালো, কারণ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তাও মার্কাসকাকু এলেন না। এদিকে আমার আর গাবলুর খেলাধুলা ভালোই চলছিল।
তারপর একদিন গাবলু খেলতে এলো না। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, তারপরও যখন ও এলো না তখন আমার বেশ চিন্তা হল। গাবলুর মা-বাবা কি জেনে গেল নাকি- যে ও আমার সঙ্গে খেলে! নাকি মার্কাসকাকুর মতো কেউ ওর রোগ সারাবার জন্য এসেছে! আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। পা টিপে টিপে গাবলুর ঘরের দিকে চললাম। বাড়ির ওই দিকটায় আমি কখনো যাইনি। আমার ওদিকে যাওয়া নিষেধ, কারণ যাদের নাম করতে নেই তারা ওদিকেই থাকে। আর গাবলুও তো ওদেরই একজন। কিন্তু গাবলুর ঘর কোনটা আমি জানি। ওই আমাকে বলেছে। উফফ্ এদিকটা একেবারে অন্যরকম। এত বেশি আলো লাগিয়েছে এরা। যাইহোক গাবলুর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখলাম গাবলুকে। বিছানায় শুয়ে রয়েছে সে। আরো বেশ কয়েকজন বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। তাহলে কি আবার শরীর খারাপ হয়েছে, তাই খেলতে আসতে পারেনি! ভেতরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে লম্বা মতো একজন বাকিদের বলছে, আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিস্টার ব্যানার্জি। ওকে আর...
হঠাৎ পিঠে টোকা পড়তে ভয়ে চমকে ফিরে তাকালাম। দেখি গাবলু দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
কিরে এদিকে এসেছিস কেন? আর ঐ ঘরে উঁকি দিচ্ছিস কেন? ও বলল।
কিন্তু তুই তুই...
হ্যাঁ, আমার সঙ্গে খেলতে আর তোর কোনো ভয় নেই। আর ঘুম থেকে উঠে আসতে হবে না।
আমি আর গাবলু এখন খুব খেলি। এখন তো গাবলুও আমাদের মতোই একজন, তাই মা-বাবা আর আপত্তি করেন না। গাবলুর মা-বাবা বীড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িটাতে অনেকদিন আর কেউ আসেনি। তারপর একদিন আমরা খেলছি এমন সময় দেখি একটা পুচকে মেয়ে হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি গাবলুর দিকে তাকিয়ে বললাম, আবার কেউ এসেছে। বাড়িটাতে আবার ওদের উপদ্রব শুরু হবে।
শুনতে পেলাম কেউ একজন ডাকছে, কোথায় গেলে রিমি, চলে এসো। ওদিকটায় যেতে বারণ করেছি না।
রিমি আমাদের দিকে পিছন ফিরে যেতে যেতে উত্তর দিল, আসছি মা, এখানে দুটো বাচ্চা ভূত আছে তাদের দেখছিলাম।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত– চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩
Topic : ভূতের গল্প, Ghost stories for children, The story of friendship, শিশুদের সরলমনের সহজ গল্প, The story of kids
0 মন্তব্যসমূহ