Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আয় বৃষ্টি ।। সুকুমার মণ্ডল

 

 



গরমের ছুটি নীলুর অসহ্য লাগে। ইস্কুলে গেলে রোজ কত রকম মজা, স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, হুটোপাটি, ফলসা গাছে চড়া, এমনকি মাস্টারমশাইয়ের হাতে পিটুনি পর্যন্ত বেশ লাগে ওর। ভালো লাগে না বাড়িতে বসে থাকতে। তখন মা যত রাজ্যের কাজের ফরমায়েশ করে। মাঠে গিয়ে বাবাকে মুড়ি আলুভাজা আর  জলের ঘটি দিয়ে আসতে হবে। গরুগুলোর জন্যে খড় কুঁচিয়ে রাখতে হবে, নয়তো ভেঙে পড়া বেড়া বাঁধতে সাহায্য করতে হবে। আহ্ এর চেয়ে ইস্কুলে যাওয়ার ঢের আরামের।

এবছর আবার নতুন ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে- বৃষ্টির দেখা নেই। বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে কবে। মাঠ চষা প্রায় শেষ। সবুজ মখমলের মতো ধানের বীজতলায় অপেক্ষা করছে। দেখা নেই কেবল জলের। বৃষ্টির উপর ভরসা না রেখে বীজতলার লাগোয়া বিঘা খানেক জমিতে সেচ দেওয়া সাব্যস্ত করেছে নীলুর বাবা পরাণ। পাশের নয়ানজুলিতে এখনো কিছুটা জল আছে। ডোঙায় করে তা সেচ দিলে কিছুটা ধানের চারা হয়তো রক্ষে হবে। বলা বাহুল্য, ডোঙা দিয়ে সেচের ঝক্কি নীলু ঘাড়ে এেস পড়েছে। ঘরের কাজে ছেলেপিলেরা না লাগলে চলে। অতএব ভোর থেকে নিলু ডোঙা ডোবায় আর ওঠায়। কি বিরক্তিকর কাজ! কেন যে এবছর বৃষ্টির দেখা নেই। হে ভগবান, তুমি কি পারো না বৃষ্টি নামিয়ে আমায় মুক্তি দিতে। নীলুর ডাকে সাড়া দিতে বর্ষারানীর আগ্রহ দেখা গেল না।

গত কয়েকদিন ধরে নিলু এরকম সব সুখ-দুঃখের কথা বলাবলি করছিল ওর বন্ধু কেঁদোর সঙ্গে। কেঁদো থাকে ওদের উঠোনের শেষ প্রান্তে একটা বড়োসড়ো গর্তে। ইয়া বড়ো এই কোলা ব্যাঙটাকে এই নামে ডাকে নীলু। ব্যাঙটা বুড়ো হয়েছে, বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। মাঝে মধ্যে দু-একটা মশা কিংবা পোকা-মাকড় মেরে ওর মুখের সামনে ফেলে দেয় নীলু। এতে একটা ব্যাপার হয়েছে যে নীলুকে কাছে আসতে দেখলেও কেঁদো পালায় না। বড়ো বড়ো ফোলা চোখ মেলে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক। কখনো-সখনো অল্প মাথা ঝাঁকায়, যেন নীলুর কথার মানে ওর মাথায় ঢুকেছে। আজ ভোরে দাঁত মাজতে মাজতে নীলু ওর বন্ধু কেঁদোকে বলল, রথতলার মা শেতলার থানে পূজো করা হল, পাঁঠাবলি হল, তবু জলের দেখা নেই। আমাদের বীজতলার ধান না রুইলেই নয়। জল ছেঁচটে ছেঁচতে হাতে কড়া পড়ে গেল। আকাশের কি যে চাই হয়েছে!

ব্যাঙ বন্ধু বিজ্ঞের মতো শুনল, ওপর নিচে মাথা দোলালো, কট্ কট্ করে একরকম আওয়াজ করল। ব্যাঙের কথা নীলু আজকাল বুঝতে পারে। কেঁদোর মাথা ঝাঁকানি লক্ষ্য করে সে বলল, জানি জানি তুমি এসবে বিশ্বাস করো না। কিন্তু ঠাকুরমা বলে, আমাদের গাঁয়ের শীতলা ঠাকুর খুব জাগ্রত। ...কি বললে, বৃষ্টি নামানোর উপায় তোমার জানা আছে।

আবার মাথা দোলায় কেঁদো।

বুঝেছি, গ্যাঙোর গ্যাঙোর ডাক, এই তো। সত্যি ওতে কি বৃষ্টি নামে!

আবার মাথা দোলায়।

তাহলে আজই ডাকো দেখি বৃষ্টিকে। ডোবার জল যে তলানিতে ঠেকেছে। ডাকবে কিন্তু!

সেদিন সন্ধ্যার মুখে গ্যাঙোর গ্যাঙোর ডাক শোনা গেল। থমথমে গাছগুলোর আড়ালে কোন ফাঁকে আকাশের ঈশান কোণে মেঘ জড়ো হতে শুরু করে দিয়েছিল। এত জোরে জোরে ডাক নির্ঘাত কেঁদোর। নীলুর মনে মনে আশার ঘুড়িটা আকাশে উড়তে শুরু করে দেয় বুঝি। বিদ্যুতের ঝলক দু-একবার চোখ ঝলসে দিল। আবছা আঁধারে দাওয়ার প্রান্তে এসে উঠোনের ওধারে ঠাহর করার চেষ্টা করল নীলু। হঠাৎ ঝড় উঠল। কেঁদোর ডাক ছাপিয়ে শোঁ-শোঁ গর্জন, বড়ো বড়ো গাছগুলো উন্মাদের মতো মাথা ঝাঁকায়। বৃষ্টি নামলো অঝোর ধারায়। কেঁদোর ডাক হঠাৎ কেন যে থেমে গেল! জলের মিষ্টি শব্দের মধ্যে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে নীলু। এমন সময় আবহাওয়া ব্যাঙ-এর আওয়াজ পাওয়া গেল, আর সেটা কানে যেতেই নীলুর শরীরে শিহরণ খেলে গেল! এটা যে খুব চেনা শব্দ! সাপে ব্যাংক ধরেছে! নির্ঘাত কেঁদো। লাফিয়ে উঠোনে নামে নীলু। বন্ধু বিপদে পড়েছে। একটা লাঠি পেলে সাপটাকে...। নীলুর মা পিছন থেকে ডাক দেন, যাস নে নীলু, এ সময় বাধা দিতে নেই। শিগগির উঠে আয়, ডালপালা উড়ে পড়ছে, মাথায় ভেঙে পড়তে কতক্ষণ! মেঘ ভরা কালো আকাশটার দিকে চেয়ে নীলুর গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, চাই না, চাই না এমন বৃষ্টি। দোহাই ভগবান, আমার কেঁদোকে ফিরিয়ে দাও।

 

অলংকরণ - অমর লাহা

প্রকাশিত - ছেলেবেলা । শ্রাবণ ১৪১৫

 

Topic : The story of the environment, পরিবেশের গল্প, The story of friendship for Children

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ