![]() |
সারাদিন বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বিরাম নেই। তা দেখে কৈলাসে মহাদেব পার্বতীকে ডেকে বললেন, আজকে তো তোমার বোধন। মর্তে এই অবস্থায় যাবে কী করে বলো তো? এই অবস্থায় কেউ বাড়ি থেকে বেরতে পারে?
পার্বতী বললেন, তুমি সে সবকিছু চিন্তা করো না। গেল বারে ডাকব্যাকের ও মহেন্দ্র গুপ্তের ভালো-ভালো ওয়াটারপ্রুফ আর ছাতা গিফট পেয়েছিলাম। ওগুলো সব সঙ্গে নেব। তোমার ছেলেমেয়েদের কোনো কষ্ট দেব না।
মহাদেব হেসে বললেন, তা বেশ। বাপের বাড়ি যাবার ব্যাপারে মেয়েদের বুদ্ধি প্রখর হয়ে ওঠে। ঠিক আছে এবার তাহলে তোমরা একটু সকাল-সকাল রওনা হয়ে যাও। যাতে একটু আগে-আগেই মর্তে পৌঁছতে পারো। কাগজে তো দেখলাম কলকাতা এখন জলের তলায়। শ্যামবাজার, বাগবাজার, কুমোরটুলি এসব জায়গায় নৌকা চলছে। সাবধান মতো যাবে।
পার্বতী খুব খুশি হয়ে বেশ আগে-আগেই রওনা হয়ে গেলেন।
বেলা একটার মধ্যেই মর্তে চলে এলেন। মা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ময়দানে খোলা মাঠে গিয়ে বসলেন। লক্ষ্মীকে বললেন, আয় মা আমরা এখানে বসি। সন্ধ্যার আগে তো আমাদের মণ্ডপে নেবে না। আর মণ্ডপে এই চারদিন গরমে যা কষ্ট পাব, না দেবে ফ্যান না দেবে এ.সি.। নিজেরা বেশ হাওয়ায় থাকবে আর আমাদের ওই গুমোট গরমে ফেলে রাখবে। আগে তাও বেশ বড়োসড়ো প্যান্ডেল হত, এখনতো প্যান্ডেল নয় যেন বিয়ে বাড়ি! প্রতিযোগিতার ছড়াছড়ি। পেরেক, শিশি, দড়ি, ছোবড়া এসব দিয়ে প্যান্ডেল আর লাইটের বাহার। নাম করা লোক দিয়ে ওপেনিং। বাইরের চটক নিয়েই সব ব্যস্ত, ভক্তি-শ্রদ্ধা কিছুই নেই। আর এ কদিন যা খেতে দেয় তা আর শ্বশুরবাড়িতে বলতেও পারি না কারও কাছে। বাতাবি-শসা-আখ চিরদিনই সেই একই ফল। অষ্টমীতে খিচুড়ি, তাও রেশনের মোটা গন্ধ চালের। আগে একটু মাংস-টাংস দিত, এখন সব সাধু -বৈষ্ণব হয়ে গেছে।
লক্ষ্মী বলল, মা, তুমি চারদিনে কি করবে বলো! মর্তের লোক দেখ না চাষের জমি বিক্রি করে গাড়ি বানানোর কারখানায় মেতেছে। আমি ভাবছি যখন তাড়াতাড়ি এলাম তখন সিঙ্গুরটা একবার ঘুরে আসি, দেখি ওদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ঝামেলাটা মেটাতে পারি কিনা! এই বলে লক্ষ্মী বেরিয়ে গেলেন।
কার্তিক মাকে বলে বড়ো রাস্তার মোড়ে এসে একটু দাঁড়ালেন। দেখলেন দোকান বাজারে কত লোক আর দোকানগুলো বেশ সাজানো। রাস্তায় লাইটের কারুকার্য আর হিন্দি গানের বহর। বেশ ভালো লাগল এইসব দেখতে। হঠাৎ একদল মেয়ে কার্তিককে ডেকে বলল- বাবা এ যে ময়ূর ছাড়া কার্তিক! তা বাবা তুমি কবে এলে?
কার্তিক বলল, এইতো একটু আগে।
-বাহঃ, বেশ তো সাজগোজ, তা এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে! চলো একটু ঘোরাঘুরি করি কিছু পকেট থেকে বার করো তো বাবু।
কার্তিক বলল, আমার কাছে পয়সা কড়ি থাকে না, দিদির কাছে আছে।
মেয়েরা হাসতে হাসতে গায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল, দিদির কাছে কেন? তোমার কাছে রাখার বয়স কি এখনো হয়নি? ওসব কথায় চলবে না, এত দামি পোশাক, দেখি এর মধ্যে কিছু আছে কিনা এই বলে তারা হাতড়াতে থাকল।
কার্তিক বেচারা চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচলো। মায়ের কাছে এসে হাঁপাতে থাকল।
এদিকে গণেশ অনেকক্ষণ মায়ের পাশেই বসেছিল। ভাবল যাই একটু মাঠের দিকে ঘুরে আসি। এক জায়গায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। সে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকল। দেখল, মাঠের একপাশে অল্প বয়সের একটি ছেলে বসে আছে। তার কাছে এসে বলল, ভাই তুমি একা একা বসে আছ কেন? তোমার বন্ধু-টন্ধু নেই?
সে বলল, তোমার কি হয়েছে ভাই? তুমিও তো একটা বন্ধু জোগাড় করতে পারতে? তুমিও তো একাই।
গণেশ বলল, হ্যাঁ, আমি তো এদিকে কাউকে চিনি না। চল না তোমায় নিয়ে একটু সামনের রাস্তাটায় ঘুরে আসি।
সে-মুখ খেঁচিয়ে বলল, তোমার এই চেহারায় তোমাকে নিয়ে যাব! দাঁড়াও এক্ষুনি আমার কয়েকটা বন্ধু আসবে তাদের নিয়ে তবে যাব।
গণেশ তার পাশে গিয়ে বসল। মিনিট দুই পরে কয়েকটা হ্যাংলাপানা ছেলে আসতেই সে বলল, এই যে দেখ এই পেট মোটা লোকটা আমায় নিয়ে ঘুরতে চাইছে। মনে হয় পাচারকারী! একে একটু কাটলেট করে দে তো। ওই ছেলেগুলো গণেশের কাছে এসে ঢুস-ঢাস কয়েক ঘা দিয়ে দিল। গণেশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর ওরা যেতে যেতে বলল, মেয়েদের নিয়ে ঘোরাঘুরি বার করে দেব। গণেশ মেয়েটির পোশাক পরা আর চুল কাটা দেখে বুঝতেই পারেনি যে ওটা মেয়ে! আজব কলকাতা আর তার মানুষগুলোকে দেখে গণেশ অবাক হয়ে গেল! ধুলো ঝেড়ে উঠে সে মায়ের কাছে চলে এলো।
এদিকে বেলা পড়ে এসেছে। মা বললেন, আয় আমরা একটু ফ্রেস হয়ে নিই। আর বেশি সময় নেই। কিন্তু সরস্বতী তো এখনো এলো না! সে যে বলে গেল, মা আজকে স্কুল-কলেজ ছুটি হয়ে যাবে তাই আমি একটু পরে যাব। এখন পড়াশোনার যা হাল হয়েছে! পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যোগ্যতা না থাকলেও তাকে ভুরিভুরি নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একজনের বদলে অন্য জন পরীক্ষায় বসে তার পরীক্ষা দিয়ে দিচ্ছে। এসব নিয়ে বিশেষ মিটিং করার আছে। আমি বেশি দেরী করব না। কিন্তু এখনো তো এলো না!
ইতিমধ্যে মায়ের মোবাইলটা, ''বাজলো তোমার আলোর বেণু''- এই সুরে বেজে উঠল। মা তাড়াতাড়ি সেটা কানে দিলেন। - হ্যালো!
ওদিক থেকে বলল, হ্যালো।
মা বললেন, কাকে চান?
- আপনাকে!
- কে আপনি? কি চান বলুন তো?
সে বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি বড়ো বাজারের কালু মস্তান। আপনার ছোটো মেয়ে এখন আমার হেফাজতে।
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, কেন? কি করেছে?
উনি আমাদের কিছু করেননি। তবে আপনি যদি মেয়েকে পেতে চান, তাহলে আপনার ওই সূর্য, চন্দ্র, ব্রহ্মা, বরুণ, শিব এদের কারখানায় তৈরি মহান অস্ত্রগুলো আমাকে দিতে হবে। আমাদের এখানকার ভেজাল অস্ত্রে ঠিক কাজ হচ্ছে না। তবেই মেয়েকে পাবেন।
মা তো খুব ভয় পেলেন। তাই কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, বাবা আমার মেয়েকে তোমরা ছেড়ে দাও, আমি কথা দিচ্ছি বিসর্জনের দিন বাবুঘাটের কাছে তোমরা থেকো, আমি আমার সব অস্ত্রগুলো তোমায় দিয়ে যাব।
যথাসময়ে শঙ্খ-ঘন্টা বেজে উঠল। মণ্ডপে মণ্ডপে উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠল। সকালে মায়ের বোধন পূজা আরম্ভ হল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । আশ্বিন-১৪১৫
Topic : The story of the gods and goddesses, funny story of children, ছোটোদের মজার গল্প, দেবদেবীর গল্ব, পুজোর গল্প
0 মন্তব্যসমূহ