![]() |
নারদমুনি যখন ঢেঁকি বাহনে কৈলাসে এসে উপস্থিত হলেন মা দুর্গা তখন রান্না-বান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। কাজকর্ম তাঁর সারাদিনে কম নয়- খামখেয়ালী চার ছেলেমেয়ে। সরস্বতী পাহাড়ে হেলান দিয়ে বীণা বাজিয়েই চলেছে, লক্ষ্মী তো কোণায় বসে সর্বদা ঝাঁপি গোছায়। কার্তিকের শুধু তীর-ধনুক নিয়ে কসরত। গণেশ অবশ্য সর্বদা মায়ের কাছে কাছেই থাকতে চায়। কিন্তু মা তার বাহন ইঁদুরকে দেখলে খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসেন। তাই বেচারা বড়ো মনমরা হয়ে থাকে। আবার ভাই-বোনেরা একসঙ্গে থাকলেও ঝগড়াঝাটি খুনসুটির শেষ নেই। হংসরাজ আর পেঁচাকে নিয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতীর চিরকালের ঝগড়া। কে বেশি সুন্দর তাই নিয়ে তর্কাতর্কি। দুই ভাইয়ের অভিযোগও ওই বাহনদের নিয়ে। ময়ুর সর্বদা ইঁদুরকে তাড়া করে আর ইঁদুরও সুযোগ পেলে ময়ূরের পেখম কেটে দেয়। শুনতে শুনতে মায়ের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। নারদকে দেখে খুশি হলেন তিনি। নিজেও জগৎসংসারের খবর বিস্তারিত জানতে পারবেন আর ছেলেমেয়েরাও নানা রকম গল্প-গুজব শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। ছেলেমেয়েরা নারদকে ঘিরে বসল। মা-ও সেই সুযোগে হাতের কাজ সারতে লাগলেন।
মামা বাড়ির গল্প শুনতেই সবাই আগ্রহী দেখে নারদ শুরু করলেন, সেখানে যে এখন কি চোখ জুড়ানো মন ভোলানো শোভা সে কি আর মুখে বর্ণনা করা যায়! চারিদিকে সবুজ ধানক্ষেত, উপরে নীল আকাশ, আকাশের গায়ে সাদা মেঘের ভেলা। কখনো বা সাদা বকের সারি। কখনো বা ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফাঁকে সাত-রঙা রামধনু। ভরভরন্ত নদীর ধারে বনের কিনারায় রাশি রাশি কাশফুল ফুটে আছে। তার উপরে সোনা রোদের ঝিকিমিকি। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের কথা কি আর বলব! তারা সব ছুটির আনন্দে মশগুল। সবুজ ঘাসের উপর ঝরে পড়া শিউলি, মালতিতে আঁচল ভরে নিয়ে কখনো সাজিয়ে রাখছে, কখনো মালা গাঁথছে। কত ফুল ফুটে আছে চারিদিকে। জুঁই, টগর, গুলঞ্চ, পদ্ম। গন্ধে ম-ম করছে চারিদিক।
গল্প বলতে বলতে নারদঠাকুর গণেশকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করলেন। তারপর কানে কানে কি যেন বলে উঠতে যাবেন, তখনই মা এসে পড়লেন। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো চলে গেল। মা জানতে চাইলেন মর্ত্যলোকের খবর। বিস্তারিত বর্ণনার পর নারদ বললেন, মা, সেখানে তো এখন একটাই গান- ''যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী''। তোমার জন্যই সবাই অর্ঘ্য সাজিয়ে বসে আছে মা। মা দুর্গা গম্ভীর হলেন, যেতে তো আমারও সাধ হয় তবে দেবাদিদেবের অনুমতি পাওয়া কঠিন আর ওই ভোলানাথকে একলা রেখে যেতে মনও চায় না। দেখি কি করা যায়।
নারদ বিদায় নেবার পর মামাবাড়ি যাবার বায়না নিয়ে চার ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরল মাকে। গণেশ অভিমানী গলায় বলল, আমাদের এখানে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, বরফ আর বরফ। ভাল্লাগে না একদম। মামাবাড়িটা কত সুন্দর! কতদিন যাইনি। এবার না গেলে কথা বলব না। মা তাকে শান্ত করে বাবার অনুমতির কথা বললেন।
তারপর সকলে মিলে পড়ন্ত বেলায় কৈলাস শিখরে পৌঁছলেন। ধ্যানযোগে ততক্ষণে মহাদেবের সব জানা হয়ে গেছে। তিনি হাসিমুখে অনুমতি দিলেন। তবে কড়া শর্তে। তিন রাত্রির বেশি থাকা যাবে না। চতুর্থ দিন সকালেই তিনি তাঁদের আনতে যাবেন। মা নন্দি-ভৃঙ্গীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তারপর দেবাদিদেবকে প্রণাম জানিয়ে যাত্রার তোড়জোড় শুরু করলেন।
মর্তের বোধন মন্ত্রে মায়ের মন ক্রমশ উচাটন, আনমনা হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মী-সরস্বতী তাঁকে আগুন-রঙা বসন, স্বর্ণ মুকুট, রত্ন অলংকারে রাজ-রাজেস্বরী সাজিয়ে দিলেন। সরস্বতী শুভ্রা বসনে অপরূপা হলেন। লক্ষ্মী রক্ত বসন আর বিবিধ অলংকারে হলেন কল্যাণময়ী। কার্তিক সেনাপতির পোশাকই সবসময় পরে থাকতে চান। গনেশ তাঁর নাদুস-নুদুস চেহারায় ধূতি চাদরই পছন্দ করলেন। সাজগোজেই রাত্রি শেষ হয়ে এল। ঊষার আলো ফোটার অনেক আগেই রওনা হলেন তাঁরা মন পবনের যানে। ঠিক ব্রাম্ভ মুহুর্ত্যে পৌঁছানো চাই।
স্বর্গসীমা পার হওয়ার সময় আধা চাঁদ আর শুকতারাটি মিটিমিটি হেসে প্রণাম করে তাঁদের বিদায় জানালো। এই সময় গণেশ একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ অনেক শঙ্খ-ঘন্টা আর মন্ত্র ধ্বনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল। নদীতীরে কত লোকজন জোড় হাত করে তাঁদেরই জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মা বললেন, আমরা এসে গেছি। দেখছো বাছা, সবাই কেমন আকুল হয়ে আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। আমাদের নিয়ে যাবার জন্য কত সুন্দর সুন্দর দোলা এনেছে।
সোনালী রোদের ঝলকে আনন্দময়ীর আগমন বার্তা ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। গমগমিয়ে বেজে উঠল ঢাকের বাদ্যি। সকলেই আনন্দিত। মাকে জড়িয়ে ধরে গণেশের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, তিনটে দিন কি মজাতেই না কাটবে।
অলংকরণ – অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : Children's Funny Story, মজার গল্প, পুজোর গল্প, দেবদবীর গল্প, The story of the gods and goddesses
0 মন্তব্যসমূহ