Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ফসিল ।। সুমন মাইতি

 



ভদ্রলোকের চেহারা বেশ ভারিক্কি। কামানো মুখ এবং কাঁচাপাকা মোটা গোঁফ। পরণে কালো পুরনো আমলের দামী কোট-প্যান্ট। নামটা জানতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। এমন সময় ভদ্রলোক নিজেই মৃদু হেসে বললেন, আমার নাম রমোতেশ রায়চৌধুরী। তোমাদের নাম? ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর বেশ গম্ভীর।

আমি বিক্রম, আর ও হচ্ছে আমার বন্ধু সৌভিক। আমরা থাকি শ্যামপুরে।

তা এখানে কী মনে করে আসা?

আসলে আমরা দুজনে একই অফিসে কাজ করি, আর কাজের ফাঁকে এরকম নিরিবিলি জায়গায় ঘুরতে চলে আসি। এখন সামার ভ্যাকেশন চলছে, তাই-

আমিও একসময় তোমাদের মতোই ভবঘুরে ছিলাম। এখন অনেকটা থিতু হয়েছি। তাছাড়া বয়সও তো হচ্ছে। তা, তোমরা এখানে কোথায় উঠেছ?

ওই যে সামনের সুষমা গেস্টহাউসে।

যে ঘরে রমোতেশবাবু আমাদের এনে বসিয়েছিলেন, সেই ঘরটার চারিদিকে সৌভিক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। বাইরেটা পুরনো বলে মনে হলেও ভেতরটা বেশ পরিস্কার। আসবাব তেমন নেই। কয়েকটা পুরনো শক্ত কাঠের চেয়ার আর একটা খাটিয়া।

এবার সৌভিক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি কী এখানে একাই থাকেন?

উত্তরে রমোতেশবাবু বললেন, হ্যাঁ।

কী করেন আপনি?

আগে আমি ছিলাম ক্যালকাটা ইউনির্ভাসিটির অধ্যাপক। জুলজির। রিসার্চও করতাম। অধিকাংশ সময়ই আমি ল্যাবরেটরিতেই কাটাতাম।

রমোতেশবাবু গম্ভীর স্বরে বলছিলেন কথাগুলো।

ল্যাবরেটরিতে সাজানো থাকত নানান প্রাণীর ফসিল। বাংলায় যাকে বলে জীবাশ্ম। হাজার হাজার বছর আগে শিলার মধ্যে চাপা পড়ে যাওয়া মৃত প্রাণীদেহের ছাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। এক সময় আমার মাথায় এল ওই সব প্রাণীদের যদি পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় অর্থাৎ জীবাশ্ম থেকে যদি আবার প্রাণীগুলোকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে অনেক অবলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সেটা কীভাবে সম্ভব? জীবাশ্ম তো পাথরের ওপর মৃত জীবদের ছাপ ছাড়া কিছুই নয়, সৌভিক অবাক হয়ে বলল।

রমোতেশবাবু সৌভিকের এই কথা শুনে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। বললেন, এই কথাটা যখন আমি আমার কলিগদের বলেছিলাম, তারাও ঠিক তোমার মতোই বলেছিল। কেউ গুরুত্বই দেয়নি আমার কথার। তারপর থেকেই আমার জেদ চেপে বসল। আমি পদত্যাগ করলাম। ঘুরে বেড়াতে লাগলাম দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে, ফসিলের সন্ধানে। এতদূর বলার পর রমোতেশবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বসো, একটু আসছি। বলে বাইরে বেরিয়ে কাঠের সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন।

রমোতেশবাবুর কথা শুনতে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। দোতলা বাড়িটাকে ঘিরে চারিদিকে কাঠের ঝুল বারান্দা। আমরা বারান্দা ঘুরে বাড়িটার পিছনের দিকে এলাম। সৌভিক আমাকে আস্তে আস্তে বলল, লোকটাকে আমার যেন বড়ো অদ্ভুত ঠেকছে। এমন একটা ভুতুড়ে বাড়িতে উনি একাই থাকেন! তাছাড়া ফসিল থেকে জীবন্ত প্রাণী সৃষ্টি করা কখনোই সম্ভব কী?

ওর কথা শুনে আমি হাসলাম। বাড়িটাকে ভুতুড়ে বাড়িই বলতে হয়। এমন একটা গাছপালা ঘেরা স্থানে এই দোতলা বাড়িটা কেমন যেন নিঃসঙ্গরকমের। বাড়িটার সামনের দিকে কাঠের লজগজে সিড়ি। জানলার পাল্লার অবস্থাও একইরকম। দেওয়ালের প্লাস্টার চটে এখানে-ওখানে হাঁ হয়ে বেরিয়ে আছে ইঁট। ইঁটের ফাঁকে-ফাঁকে শ্যাওলা এবং বটের চারাও গজিয়ে উঠেছে।

ফসিলের ব্যাপারটাকে নেহাৎ আজগুবি বলা যায় না। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের দ্বারা কিইবা না করা সম্ভব! আমি বললাম সৌভিকের দিকে তাকিয়ে। দেখলাম, ও অন্যমনস্কভাবে দূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

বিকেলে রোদ কমতে শুরু করেছে। সেই অল্প আলো ছড়িয়ে পড়েছে গাছগাছালির মধ্যে। কিছু দূরে চিকচিক করছে ভাগীরথীর জল। এজায়গাটার নাম শিবগঞ্জ। শুনেছি শীতকালে এই নদীটার ধারেই গঙ্গা মেলাতে প্রচুর লোক সমাগম হয়। সে সময় জায়গাটা আর এত নিরিবিলি থাকে না। সামনের ওই ঝোপটার পাশ দিয়ে মাটির রাস্তাটা চোখে পড়ছে। ওই রাস্তাটা ধরেই আমরা দু'জনে হাঁটছিলাম কিছুক্ষণ আগে। আমাদের দেখতে পেয়ে রমোতেশবাবু নিজেই দোতলার ওই ঘরটার জানলা দিয়ে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন ওপরে উঠে আসতে।

কোথায় গেলে?

রমোতেশবাবুর গলা শুনতে পেলাম। আমরা আবার সেই ঘরে ফিরে এলাম। দেখলাম উনি চা নিয়ে এসেছেন।

আমাদের বললেন, চলো, চা খেতে-খেতে ল্যাবটা তোমাদের দেখিয়ে আনি।

যে ঘরে বসেছিলাম তার পাশেই ল্যাব। রমোতেশবাবু ল্যাবের তালা খুলে সুইচ টিপে ভেতরের আলো জ্বাললেন। আমরা ভেতরে ঢুকে যা দেখতে পেলাম, তা সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যাবার মতো। ঘরটা বেশ বড়ো। নানান ধরণের যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। বকযন্ত্র, জার, লিকুইডের বোতল, টেস্টটিউব ছাড়াও রয়েছে হাবিজাবি ইলেকট্রিক তার, বাল্ব ইত্যাদি।

ওদিকে একটার পর একটা বিভিন্ন আকৃতির কাঠের বাক্স থাকে-থাকে সাজানো। রমোতেশবাবু বাক্সগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। ওগুলো দেখিয়ে বললেন, বহু বছর ধরে সংগ্রহ করা যে সব ফসিলের কথা বলছিলাম, সেগুলো এইসব বাক্সে বন্দি করা রয়েছে।

যেদিকে কাঠের বাক্সগুলো সাজানো ঠিক তার উল্টোদিকে রয়েছে দরজাযুক্ত একটা বড়ো মাপের কাচের ঘর।

সৌভিক বলল, আচ্ছা, ফসিল থেকে তো নানান ধরণের জীবন্ত প্রাণী আপনি সৃষ্টি করলেন। সেই সব প্রাণী যদি আপনাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে? মানে অনেক হিংস্রপ্রাণীও তো থাকতে পারে!

রমোতেশবাবু উত্তরে বললেন, আমারও মাথায় সেই ভাবনাটা রয়েছে। তাই এতদিন একা কাজে হাত লাগাতে পারিনি। ফসিল থেকে জীবন্তপ্রাণী সৃষ্টি করতে যে সব ফর্মূলা দরকার তা সব প্রস্তুত। ওই কাচঘরটার মধ্যেই আমি পরীক্ষা শুরু করব।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি সৌভিক ও আমার দিকে তাকিয়ে অনেকটা অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন, তোমরা যদি আমাকে সাহায্য করো, তাহলে অনেক সুবিধে হয়।

ওনার কথা শুনে আমি ও সৌভিক দু'জনে পরস্পরের চোখাচোখি হলাম।

সৌভিক বলল, দেখুন আপনি যেটা করতে যাচ্ছেন, সেটা নিঃসন্দেহে একটা বড়ো আবিস্কার। সেখানে আমাদের সাহায্য করতে আপত্তি কিসের।

সৌভিকের কথা শুনে রমোতেশবাবুর চোখে-মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক আছে তাহলে কালই পরীক্ষা শুরু করতে চাই। তোমরা তাহলে কাল ঠিক এমন সময়ই এসো।

পরদিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা রমোতেশবাবুর বাড়িতে পৌঁছলাম। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে ল্যাবে এলাম। উনি ইলেকট্রিকের তার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন।

কিছুক্ষণ পর বললেন, এসো, এবার বাক্সগুলো খোলা যাক।

রমোতেশবাবু প্রথমে একটা ছোটো বাক্স খুললেন।

আমরা দেখতে পেলাম একটা কালো চ্যাপটা পাথরের ওপর একটা প্রাণীর ছাপ। কিন্তু প্রাণীটা যে কি তা আমরা বুঝতে পারলাম না।

উনি বললেন, এটা একটা মাকড়সা। নাম ব্রাউন স্পাইডার। দেখতে বাদামী রঙের। সাধারণ মাকড়সার থেকে আকারে বড়ো। মুখে বিষাক্ত লালা বয়ে বেড়াত এরা। এটাকে পেয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ার কিম্বলি মালভূমির জঙ্গল থেকে। এখন এরা অবলুপ্ত।

এরপর একেরপর এক বাক্স খুলে উনি অনেক প্রাণীর ফসিল দেখালেন। আর তাদের প্রত্যেকের বর্ণনা দিয়ে গেলেন। কোত্থেকে পেয়েছিলেন তাও বললেন। থাইলাসিন, কুয়াগ্গা, আইরিস হরিণ এবং সবশেষে যা দেখালেন তা হল একটা ডাইনেসোরাসের ফসিল। যার ছাপ দেখে চেনা সত্যিই দুস্কর। কিন্তু রমোতেশবাবু শুধু একটা লম্বাটে বাক্স খুললেন না। আমরা দেখতে চাইলে তিনি বললেন, না, ওটা থাক। সময় হলেই দেখতে পাবে। লক্ষ্য করলাম ওনার মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট।

রমোতেশবাবু বললেন, চটপট বাক্সগুলোকে কাচের ঘরের মধ্যে নিয়ে চলো।

কথা মতো আমরাও তাই করতে লাগলাম। অত্যন্তভারী বাক্সগুলোকে কাচঘরে ঢোকানোর পর উনি একটার পর একটা বাক্সে কীসব লিকুইড ঢালতে লাগলেন। প্রত্যেক বাক্সে বৈদ্যুতিক তার সংযোগ করলেন। তারপর বাক্সগুলো আবার বন্ধ করে দিলেন। আমরা এসব কিছু বুঝতে না পেরে স্রেফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, উনি শুধু লম্বাটে বাক্সটাতে কিছুই করলেন না। কাচঘরের ভেতরে দরজার সামনে কেবল আগের অবস্থাতেই রেখে দিলেন। তারপর কাচঘর থেকে বেরিয়ে এসে বোর্ডে বৈদ্যুতিক তার সংযোগ করলেন।

মিনিট কাটছে। ঘন্টা কাটছে। আমরা চাপা উত্তেজনায় সময়ের পথ পেরিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ। শব্দটা জোরেই হতো, যদি না কাচঘরের দরজা বন্ধ থাকত। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, মাঝের একটা বাক্সের ঢাকনা খুলে গেছে আর সেই বাক্স থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে একটা কালো রঙের প্রাণী। ক্রমশ বড়ো হচ্ছে প্রাণীটা।

রমোতেশবাবু কাচঘরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উত্তেজনায় তাঁর চিবুক শক্ত হয়ে গেছে আর চোখ দুটো হয়ে গেছে ভয়ঙ্কররকমের রগরগে লাল।

এবার প্রাণীটাকে আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। ধীরে-ধীরে বড়ো হতে-হতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে প্রাণীটা। গায়ের রঙটা যেন পাল্টে গেছে। কালো রঙটা বদলে গেছে খয়েরি রঙে। আর পেটের কাছটা হাল্কা ক্রিম। মুখটা কুকুরের মতো, আর শরীরের শেষভাগ থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্যাঙারুর মতো একটা লেজ। রমোতেশবাবুর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। চিনতে পারলাম, প্রাণীটা থাইলাসিন। যাকে তাসমানিয়ার বাঘও বলা হতো।

লক্ষ্য করিনি ওদিকের আরও একটা বাক্স খুলে গেছে এতক্ষণে। যেটা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা মাকড়সা। ব্রাউনস্পাইডার। সবচেয়ে বড়ো আকারের বাক্সটাও খুলে গেল। আর বেরিয়ে  এল একটা বড়ো ডাইনেসোরাস। যে কিনা বেরিয়ে এসেই পায়ের চাপে গুঁড়ো করে দিল বাক্সটা। আর মুখ দিয়ে বিকট শব্দে তর্জন-গর্জন করতে লাগল। দেখতে-দেখতে প্রায় সব কটা বাক্স খুলে গেছে। মাঝের একটা বাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কুয়াগ্গা। যার অর্ধেকটা দেখতে ঘোড়ার মতো আর অর্ধেকটা জেব্রার মতো।

ডাইনেসোরাসটির ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত খাঁজগুলোকে যেন ইস্পাতের ফলার মতো লাগছে। ক্রমশ বড়ো হচ্ছে সে। হঠাৎ মুখ বিকৃত করে সে এগিয়ে এল থাইলাসিনটার কাছে, আর বিশাল হাঁ করে গিলে ফেলল তাকে।

চোখের সামনে এরকম একটা দৃশ্য দেখে থরথর করে কেঁপে উঠল আমার সারা শরীর। পাশে দাঁড়ানো সৌভিক খপ্ করে ধরে ফেলল আমার হাত। অনুভব করলাম তার হাতটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ঠিক এমন সময় ল্যাবের আলো কেমন যেন ক্ষীণ হয়ে এল।

রমোতেশবাবু ছেলেমানুষী হাততালি দিতে-দিতে কাচঘরে চারিদিকে ছুটোছুটি করছেন। ম্যাড়ম্যাড়ে আলোয় ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ওঁর দাঁতগুলো যেন রূপোর মতো ঝকঝকে, আর চোখ দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে লাল রশ্মি।

কাচঘরের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি সমস্ত প্রাণীদের প্রায় তালগোল পাকানো অবস্থা। ডাইনেসোরাসটা বাড়ছে। সর্বনাশ! যদি এইভাবে বাড়তে থাকে তাহলে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ওর মাথাটা ঠেকে যাবে কাচঘরের সিলিং-এ। আর ফাটিয়ে দেবে কাচঘর। অজান্তেই আমার গলা থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল, রমোতেশবাবু-উ-উ!

ওঁর কাছ থেকে কোনো রেসপন্স পেলাম না। এমনকী আমাদের দিকে ফিরেও তাকালেন না। বুঝলাম, উনি একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। ওঁর ঘোর ভাঙাতে সৌভিক আর আমি ল্যাবের টেবিল থেকে দুটো বোতল তুলে নিয়ে ওঁর মাথায় সজোরে মারলাম। বোতল দুটো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আঘাত পেয়ে রমোতেশবাবু কেমন যেন সিঁটিয়ে যেতে লাগলেন। চোখ-মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীর কুঁচকাতে-কুঁচকাতে উনি ছোটো হয়ে যেতে লাগলেন। ওঁর দেহটা কেমন যেন পাথুরে হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হল না।

ঠিক এমন সময় দেখতে পেলাম কাচঘরের দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল। আর ওঁর ওই পাথুরে দেহটা বাতাসের মধ্যে দিয়ে উড়ে গিয়ে সেই লম্বাটে বাক্সটার ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর বাক্সের ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেল।

এমন একটা অলৌকিক দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে আমার হৃদস্পন্দন যেন থেমে যাচ্ছে। শরীরে প্রাণ নেই-নেই অবস্থা। ঘরের ভেতরে এতক্ষণ যে অল্প আলো ছিল সেটাও যেন কে জোর করে নিভিয়ে দিল। কাচঘরের ভেতরে বিচিত্র সব প্রাণীগুলোর চিৎকারও থেমে গেল। নীরেট নিস্তব্ধ অন্ধকারে আমার ও সৌভিকের দুটো অসাড় দেহ '' মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি সৌভিকের হাত ধরে পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখন কোথায় দরজা তা গুলিয়ে গেছে মাথার মধ্যে থেকে। কোনোক্রমে হাতড়ে, দরজা বের করে দু'জনে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর ভাঙাচোরা সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে দিলাম দৌড়। তারপর কীভাবে যে গেস্টহাউসে ফিরলাম তা আমি কিংবা সৌভিক কেউই বলতে পারব না।

পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন ঘড়িতে নটা। আমরা চা খেতে-খেতে গেস্টহাউসের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সকালের রোদ আমাদের চোখে-মুখে লাগছে। কালকের ওই ঘটনায় আমরা দুজনেই গুম মেরে গিয়েছি। সৌভিকের কপালে চিন্তার ছাপ পড়েছে।

আমি বললাম, রমোতেশবাবু তাহলে মানুষ নন! একটা ফসিল!

আমার কথা শুনে সৌভিক আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, ভদ্রলোক যে জীবিত অবস্থায় একজন অভিজ্ঞ জীববিদ ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একসময় উনি রিসার্চের কারণে পৃথিবীর নানা স্থানে ফসিলের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে থাকেন।  আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে, রমোতেশবাবু ফসিলের সন্ধানে কোনো পাহাড়ী এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে কোনো দুর্ঘটনার ফলে উনি পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে খাতের মধ্যে পড়ে মারা যান। তারপর নরম পললের মধ্যে ওঁর দেহটা চাপা পড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে যেটা ফসিলের রূপ নেয়।

সৌভিকের কথা শুনে আমি মাথা নাড়লাম। ওর অনুমানই সঠিক বলে মনে হল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২

 

Topic : জমজমাট ভৌতিক গল্প, গা ছমছমে ভূতের গল্প, ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প, Wonderful ghost story in Bengali, Best ghost story, সেরা ভূতের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ