![]() |
সেদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি মেয়েরা চুপচাপ বসে আছে। কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতেই শতরূপা মুখ খুলল। আজ ওরা কি একটা হানাবাড়ির ছবি দেখেছে, আর ঘটনাটাও পড়েছে কাগজে। তাই সকলেই কম বেশি চিন্তিত ও ভীত। কেউ কেউ ভূত সম্বন্ধে নানারকম আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শতরূপা ক্লাসের মধ্যে বেশ বুদ্ধিমতী, কিন্তু ওকে দেখলাম বেশ আনমনা। ও হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, মিস আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন? কখনো হানাবাড়ি দেখেছেন?
আমি বললাম, যা চোখে দেখিনি সেটা আছে কি নেই, কী করে বলি! এই যেমন ভাইরাস, খালি চোখে দেখা যায় না। তাই বলে কি ভাইরাস এর অস্তিত্ব নেই? আছে। আর সেটা বিজ্ঞানীরা প্রমাণও করতে পেরেছেন। অন্যগুলো হয়তো পারেনি। আসলে এসব জিনিস উপলব্ধির ব্যাপার। হানাবাড়ি বলতে কী বোঝায় জানি না। তবে একটা বাড়িতে গিয়ে আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটা স্বীকার না করে পারছি না।
আমার কথায় সকলে হই-হই করে উঠল। দিদি বলুন, বলুন না দিদি, আজ আর পড়ব না। অগত্যা আমিও বলতে শুরু করলাম।
তখন আমি খুব ছোটো। ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবা বদলি হলেন চন্দননগরে। কিন্তু বাবাকে যে কোয়াটারটা দেওয়া হল তা দেখে এসে বাবা ওই বাড়ি নাকচ করে দিলেন। বললেন, সবাই বলছে ওটা নাকি ভূতের বাড়ি। ফরাসি ভূতের আখড়া। সাত তলা বাড়িটার নাম লালকুঠি। বিরাট বাগানও আছে। নিচে একতলার একটা ঘরে বউ নিয়ে থাকত কেয়ারটেকার বিজয়। আমরা ভদ্রেশ্বরে একটা ভারি ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করলাম।
দেখতে-দেখতে জগদ্ধাত্রী পুজো এসে গেল। জানোই তো চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো খুব বিখ্যাত। তাই বাবা ঠিক করল, আমাদের ওই কোয়াটারে গিয়ে আমরা বিসর্জন দেখব। সঙ্গে থাকবে বাবার অফিসের পাঁচটা পরিবার। তা সব মিলিয়ে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন। জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের দিন আমাদের তিন বোন, দুই ভাই, আর মা'কে ওই কোয়াটারে পৌঁছে দিয়ে বাবা বাজার করতে বেরিয়ে গেলেন।
বিশাল বাড়িটাতে আমরা ছ'জন। তবুও কেমন গা ছমছম করতে লাগল। উঁচু-উঁচু সিলিং। কথা বললে ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। আমাদের ঘরটা বিরাট। ঘরের মধ্যে আর একটা ঘর, তালা বন্ধ। একে-একে সবাই আসতে থাকল। ভয়টাও আস্তে-আস্তে কমে গেল।
কেয়ারটেকার বিজয়দার সঙ্গে আমাদের আলাপ হল। দাদারা বিজয়দাকে ঠাট্টা করে বলতে থাকল, কি বিজয়দা ভূত কোথায় গো? বিজয়দা দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, বলোনি গো দাদারা, তেনারা এখনো আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করে এখানে থাকো? তোমার ভয় করে না?
বিজয়দা বলল, আমি? আমি তো আমার ঘরের চারধারে মন্ত্র পড়ে দেই। আর যখন বেরিয়ে যাই বউটা একা-একাই থাকে, তখন আমি একটা গণ্ডি কেটে, মন্ত্র পড়ে দিয়ে যাই। আমার ঘরটা তো একেবারে রাস্তার ধারে, আর ওদিক পানে আমি দিনের বেলা ছাড়া যাই না।
আস্তে আস্তে সন্ধে হতে আরম্ভ করল। বিজয়দা সকলের ঘরে-ঘরে বড়ো মোটা-মোটা মোমবাতি দিয়ে এল। কারণ জিজ্ঞাসা করতে বলল, এখানকার এক-একটা প্রতিমা তো পাঁচতলা, ছ' তলা সমান উঁচু। তাই, সব ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিয়ে গেছে। নইলে ঠাকুরের মাথা আটকাবে যে।
প্রতিমা আসতে দেরি। ছাদে সকলের ডাক পড়ল, রাতের খাওয়া সেরে নেওয়ার জন্য। ছ' তলা, সাত তলা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই মিলে দলবেঁধে উপরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আমি একটু পিছিয়ে পড়লাম। তাড়াতাড়ি ওদের ধরার জন্য উঠতে গিয়ে দেখি, একটা আড়াই-তিন বছরের বাচ্চা টলমল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। সারাদিন এই বাড়িতে আছি এত ছোটো বাচ্চা তো দেখিনি! যাইহোক বাচ্চাটা অন্ধকারে পড়ে যাবে ভেবে ধরতে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারলাম না। খুব জোরে উপরে উঠছে। হঠাৎ আর দেখতে পেলাম না। উপরে গিয়ে সবাইকে বলতে কেউ-কেউ হাসাহাসি করল। কেউ বলল, 'হ্যালুসিনেইশন'। তখন আমি এই শব্দটার মানে বুঝতাম না।
খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই একসঙ্গে পাঁচ তলার বারান্দায় বসে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে কোনো-কোনো ঠাকুরের মুখটাও ছুঁতে পারলাম। তারপর যে যার ঘরে শুতে চলে গেলাম। আমি বাবা-মায়ের মাঝখানে, তারপরে দিদিরা। দাদারা একটা বন্ধ ঘরের দরজার সামনে শুয়ে সবাই ঘুমে কুপোকাৎ। ঠং করে একটা কাচের গ্লাস পড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আর ক্যাচ-ক্যাচ করে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। ভাবলাম বিড়াল হয়তো। কিন্তু ওই ঘরের দরজা তালা বন্ধ! তাছাড়া দাদারাও ওখানেই শুয়ে আছে! তাহলে বিড়াল দরজা খুলছে কি করে! সারা শরীর ঘেমে গেছে ভয়ে। বাবাকে-মা'কে ডাকব সেটাও পারছি না। শক্ত হয়ে শুয়ে আছি। জোর করে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোমবাতির আলোয় দেওয়ালে বিরাট একটা লম্বা ছায়া। তারপর কোলে বাচ্চা নিয়ে আর একটা ছায়া দেখতে পেলাম। তড়িৎ গতিতে ছায়া দুটো বেরিয়ে গেল ঘর থেকে বারান্দায়। প্রতিমা যাওয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রাস্তা তখন নিঃঝুম। ঘড়িতে ক'টা বাজে বুঝতে পারছি না। দেখলাম, বাচ্চা কোলে ছায়ামূর্তিটা বারান্দা টপকে নিচে লাফ মারল। আর তারপরেই অন্য ছায়ামূর্তিটাও। চিৎকার করতে গেলাম, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে বাবার পৈতেটা চেপে ধরলাম। আর রাম নাম জপ করতে থাকলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি, সবাই যে যার রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলছে। শ্যামকাকু বলল, ওই মেয়েটা কালকে ঠিকই বলেছিল, আমরা বিশ্বাস করিনি। আমিও আমার অভিজ্ঞতার কথা দিদিদের বললাম। সবাই বলল, কই আমরা তো কিছুই টের পেলাম না। দেখলাম, দরজাটা সেই একইরকম বন্ধ।
এবার যে যার বাড়ি ফিরব। নিচে নেমেছি, বিজয়দার বউয়ের সঙ্গে দেখা। এক গলা ঘোমটা। দিদিদের কাছে আমার রাতে দেখা ঘটনার কথা শুনে বলল, ওই ঘরে এক ফরাসি সাহেব আর তার বউ-বাচ্চা থাকত। ঝগড়া করে ওই বারান্দা থেকে বউটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল। আফসোসে, সঙ্গে-সঙ্গে সাহেবও ঝাঁপ দিয়েছিল।
অন্য ঘরে কি ঘটেছে তা আমি জানি না। কিন্তু বিজয়দার বউয়ের গল্পের সঙ্গে আমার দেখা ঘটনা মিলে গেল। এর ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাই না। শুধু বিজয়দার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, ''তেনারা এখনও আছেন''।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শ্রাবণ ১৪১৭ জুলাই ২০১০
Topic : ছোটদের গা ছমছমে ভূতের গল্প, Ghost story in Bengali, ছোটদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প, কোয়াটারে ভূত, মেম সাহেব ভূত
0 মন্তব্যসমূহ