Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পাকুড় পরিবার ।। শ্যামল সরকার

 



 

হঠাৎ চমকে উঠল বড়দা। -তোরা একটু চুপ কর। একটু শান্তিতে সারতে দে মধ্যাহ্নভোজটা।

তলা থেকে চিঁ-চিঁ করে উঠল দূর্বা। -আমাদের জন্য একটু-আধটু আলো-হাওয়া ছাড়ো বড়দা। একটু দানাপানি আমরাও মুখে তুলি।

পাশের আগাছার ঝাড় কিচির-মিচির জুড়েছে দূর্বার সঙ্গে-সঙ্গে। -হ্যাঁ বড়দা, আমাদের প্রতি সদয় হও খানিক। ক'দিন যে ছেলেগুলোসহ প্রায় অনাহারে আমরা।

বড়দা চুপ মেরে গেলেও ওর পরগাছারা অধৈর্য, -নাঃ, এদের জ্বালায় তো একটু ঘুমনোও যাবে না দেখছি। যতসব ছোটোলোক। হল্লা-চিল্লা করে ভাত ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল।

হই-হই করে উঠেছে সব- দেখো, আমাদের ছোটো বলতে পারো, কিন্তু লোক বলে গাল দেবে না কিছুতেই। আমাদের মধ্যে হিংসা, লোভ, জোচ্চুরি কিচ্ছু নেই।

দূর্বা ছিঃ ছিঃ করে বলেই যাচ্ছে, পরগাছাদের উদ্দেশ্য করে- লোক বরং তোমরাই। তোমাদের স্বার্থপরতা কেবল মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

ভরাট গলায় চিৎকার করে ওঠে বড়দা-পাকুড়, ঠিক বলেছিস ছোটো। নবাবপুত্ররা বেশ আছে। তারপর দাঁত কটমটিয়ে আবার বলে, দেদার বসে-বসে খাচ্ছে শেকড়ের ওপর শেকড় তুলে। হুঁ ভাতঘুম! ভাতঘুম তো হবেই তোদের, মানুষের পো যে! আমার শরীরে জন্মে আমাকেই চুষে খাচ্ছ জীবনভর। তোদের এই আরাম আমি বের করব একদিন।

মনে মনে ফন্দি খোঁজে পাকুড়। কি করে জব্দ করা যায় ওর শরীরে বাসা বাঁধা পরগাছাদের। শাখা-প্রশাখাগুলো নাড়তে চেষ্টা করে বৃক্ষরাজ। কিছুতেই নাড়তে পারে না। তবুও চেষ্টা করতে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে। হাঁফ ধরে যায় শরীরে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না সে।

পরগাছারা বুঝতে পারে পাকুড়ের নিষ্ফলা ক্রোধ। তাদের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসতে হাসতে ওরা তীক্ষ্ণ শোষক মূল দিয়ে বিদ্ধ করতে থাকে বৃদ্ধ পাকুড়ের দেহ আরও গভীরে ভাবে। আর্তনাদ করে ওঠে বিশাল বপু বৃক্ষরাজ।

নীলু ওদের স্কুলের অদূরে পাকুড় গাছের ছায়ায় বসে ঠিক শুনতে পায় গাছ-গাছালির সংলাপ। বৃদ্ধ পাকুড়কে নিজের দাদুর মতো মনে হয় তার। সবাইকে কেমন স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চায় দাদু। তবুও তার ভাগ্যে শুধুই উপেক্ষা। দাদুর জন্য মন খারাপ লাগে নীলুর। বৃদ্ধ একাকী তার ঘরে বসে থাকে দিনভর। নীলু ছাড়া আর কারও সময় নেই বাড়ির ওই প্রবীণতম সদস্যটির জন্য।

পাকুড় তার শাখা-প্রশাখার আড়াল দিয়ে আগলে রাখে নিজের স্নেহছায়ায় গাছ-গাছালিকে ঝড়-ঝঞ্জার দাপট থেকে। শত-শত পাখি, কীটপতঙ্গের সুখনিবাস ওই পাকুড়। নীলুর দাদু তার বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরারেও পরিবারের মানুষজনের প্রতি সমান আন্তরিক। বাড়িতে সর্বক্ষণ দাদুর গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছে করে ওর। মায়ের বকুনিতে তা হয় না। দাদু হাঁফ ছেড়ে বলে, যা ভাই পড়তে যা এবার।

স্কুলে সেদিন বন্ধুদের ফিসফাস। এবার একটা মাঠ হবে স্কুলের নিজস্ব। বড়ো খেলার মাঠ। ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস। নীলুরও শুনে ভালো লেগেছে বেশ। একটা মাঠ হলে মন্দ হয় না! বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে ফুটবল খেলার যে কি মজা! আর বড়োরা কি করে বুঝবে! চোখ বুজে যেন সে দেখতে পাচ্ছে, সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল এক সমভূমি স্কুলের সামনে। ওরা সব দৌড়চ্ছে ঘাসের উপর দিয়ে। নীলুর পায়ে সাদা-কালো বল। সে ছুটছে, ছুটছে, একটু দূরেই গোলপোস্ট।

এই, কি বিড়-বিড় করছিস, বাইরের দিকে চেয়ে? ইংরেজি স্যারের চোখ নীলুর চোখে। স্যার উঠে এসেছেন নীলুর পাশে। অনুসরণ করেছেন মনোযোগী ছাত্রটির চোখকে। সামনে কালচে জলভরা পুকুর। জলে ভাসমান একঝাঁক পাতিহাঁস, রোদে খেলা করছে পুকুরের জলে। কিচ্ছু তার চোখে গেল না গম্ভীর স্বরে বললেন, বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক বারান্দায়। মাস্টারমশাইয়ের আদেশ বুঝতে একটু সময় লাগল নীলুর। চোখে ফুটবলের ঘোর লেগে আছে তখনও।

বারান্দায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীলু। সামনের পুকুরের দক্ষিণের দিকে দেখতে পাচ্ছে বৃদ্ধ পাকুড়ের গেহস্থালি। শাস্তির যন্ত্রণা হারিয়ে গেল মুহূর্তের অন্যমনস্কতার আড়ালে। বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা ও পাতা-ঝোপের মধ্যে দেখতে পায় এক পারিবারিক ছবি। একটি সুখ-দুঃখ মিশেল ঘরকন্যা। সে নিজেকে ওই ঘরকন্যায় মিলিয়ে দিতে পারে নিমেষে।

পরদিন স্কুলে এসেই নীলু দেখল বিশাল আয়োজন পাকুড়তলায়। কাটা হবে পাকুড়গাছ। গুঁড়িয়ে যাবে ওর সংসার। ওই জমি সাফ করে মাঠ হবে ওদের স্কুলের। সেদিন স্কুল ছুটি হবে তাই রোলকলের পরই। এক সুতীব্র যন্ত্রণা ছেঁকে ধরেছে নীলুকে। বুকের ভেতর উথলে উঠছে কান্না। মাঠের ছবি আর সেই কল্পনায়, সে শুধু এক হিংস্র মৃত্যুর আয়োজন দেখতে পাচ্ছে। ঘাম হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। দাদুর শরীরটা গতরাত থেকে ঠিক নেই। নীলু আর দাঁড়াতে পারল না স্কুলে, ছুটছে বাড়ির পথে। প্রাণপণে ছুটছে একা। ছোটো-ছোটো পায়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটেই চলেছে নীলু।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ ১৪১৫ (জানুযারি ২০০৯)

 

Topic : সেরা অনুভবের গল্প, Wonderful feeling story, ছোটদের ভালো গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ