Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ঘুস ।। সঞ্জীবকুমার দে

 



 

নিশ্চিত হওয়া মাত্র চিৎকার করে উঠল- পকেটমার, পকেটমার!

ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ টাকাটা ফেলে দিল লোকটা, তারপর অদ্ভুত দক্ষতায় জায়গা করে নিয়ে কী দ্রুত নেমে গেল ভিড় বাস থেকে এবং তা কেউ  কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

বিভু লোকটার দিকে আর তেমন গুরুত্ব না দিয়ে পড়ে থাকা টাকাটার দিকে লক্ষ্য রাখল। সে জানে এরা দলবেঁধে কাজ করে। একজন সরে পড়লেও অন্য আরেকজন তুলে নিতে পারে টাকাটা।

ততক্ষণে শব্দ উঠেছে এক কিশোর কন্ঠের- আমার টাকা! আমার টাকা!

বিভু জানলার কাছে সিটে বসে। টাকাটা তার নাগালের বাইরে। তাই সে আঙুল নির্দেশ করল, ওই যে টাকা।

নিচু হয়ে ভাঁজ করা টাকাটা তুললেন এক মাঝবয়সের ভদ্রলোক।

আমার টাকা, পাঁচশো টাকা! আবার সেই কন্ঠের বিলাপ।

হ্যাঁ, আমি দেখেছি, টাকাটা ওরই। বিভু জানাল।

তবুও ভাঁজ খুলে দেখা হল, পাঁচটা একশো টাকার নোট। একটা  আবার লালচে রঙ মাখা। প্রত্যর্পিত হল নোট দুটি মালিকের হাতে। কিশোর চোখের কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল বিভুর ওপর।

স্তুতি ও প্রশংসায় ভেসে গেল সারা বাস- 'বাঃ ভাই, বাঃ খুব বাঁচিয়ে দিয়েছ আর একটু হলে গিয়েছিল আর কি!' এজাতীয় উক্তির লাগাতার বর্ষণ। তার মধ্যে আবার বিভুকে ঘাড় উঁচিয়ে দেখবারও উৎসাহ প্রবল।

সালকিয়া থেকে ৫৪/এ বাসে বি.বা.দী.বাগ যাচ্ছিল বিভু, বাবার অফিসে। হাওড়া থেকে বাসে প্রচণ্ডরকম ভীড় । হঠাৎ-ই লক্ষ্য পড়েছিল লোকটার দিকে। কেমন অদ্ভুত ভাব-সাব। ভ্রুক্ষেপহীনভাবে লোকটা কব্জা করার চেষ্টায় তার শিকারকে। শিকার আর কেউ নয়। অল্পবয়স্ক এক কিশোর। সম্ভবত বিভুরই সমবয়সী। তবে যাতায়াতে যে অনভ্যস্ত তা প্রকট, কারণ অসতর্ক।

বিভু তখন থেকেই ঘটনার গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য রাখতে শুরু করেছিল। গাড়ি যখন ফ্লাইওভার থেকে নেমে ব্রাভোন রোডে ঢোকার মুখে তখনই এই পরিণতি।

ক্যানিং স্ট্রীটে ভীড় অনেকটা কমে গেল। খালি হল বিভুর পাশের সিটটাও। অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে এসে বিভুর পাশে বসল ছেলেটি। বিভু একটু হাসল।

হাসি দেখে বোধহয় সাহস পেল সে- খুব বাঁচিয়েছ বন্ধু, নইলে বিপদে পড়ে যেতাম। এই টাকাটা অনেক কষ্টে জোগাড় করা।

কৌতুহলী দৃষ্টিতে বিভু ছেলেটাকে দেখল। করুণ, উদাস। মাথায় ছোটো-ছোটো চুল। যেমন বেড়ে ওঠে ন্যাড়া হওয়ার পর।

মাস দেড়েক হল আমার বাবা মারা গেছেন। বিষন্ন কন্ঠে বলে সে- তারই পি.এফ-এর টাকাটা তোলার ব্যাপারে যাচ্ছি পেনশন অফিসে। বাবু বলেছেন, পাঁচশো টাকা দিলে কাজটা তাড়াতাড়ি করে দেবেন। আমাদের এখন খুব কষ্ট যাচ্ছে, টাকাটা জলদি প্রয়োজন।

বিভু নিরুত্তর। কি বলবে সে! মানুষের দুঃখ তাকে ব্যথিত করে।

মিনিট খানেকের মধ্যেই বাস বি.বা.দী.বাগ-এ। বিভু উঠে পড়ে, ডাকে ছেলেটাকেও- পেনশন অফিসে যাবে তো? চলে এসো।

বাস থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করে ছেলেটা- তুমি পেনশন আফিস চেন ?

হ্যাঁ আমার বাবা সেখানেই কাজ করেন। আমি একটা কাজে তাঁর কাছেই যাচ্ছি।

ও!-ছেলেটা হাসল, নির্মল হাসি।

দুজনে হেঁটে চলেছে পাশাপাশি।

তোমার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হলে ভালো হত। বিভু বলে, তুমি যদি বল, তোমার কাজের বিষয়টা আমি এখনও বাবাকে বলতে পারি।

না-না আঁতকে ওঠে ছেলেটা।

-সেই বাবু বলেছেন, জানাজানি হয়ে গেলে কাজটা করা আর সম্ভব হবে না কোনোদিনই।

পরক্ষণেই সে দু'হাতে চেপে ধরল বিভুর হাত- তুমি যেন এটা তোমার বাবাকে বলো না।

বিভু কষ্টের  সঙ্গে মাথা নাড়ল- বেশ।

অফিসের গেটে এসে ছেলেটা থমকে দাঁড়াল- তুমি  এগোও, আমাকে  আবার একটা খাম কিনতে হবে। সেই বাবু বলেছেন, টাকাটা একটা খামে ভরে দিতে।

বিভু অপেক্ষা না করে লিফটের দিকে এগোয়।

বিভুর একজোড়া গ্লাভসের প্রয়োজন।  কাল ইডেনে স্কুল ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচ। আন্তঃরাজ্য নক-আউট ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ফাইনালে পৌঁছেছে তাদের স্কুল। সে দলের একজন অপরিহার্য ব্যাটসম্যান। গতকালের সেমিফাইনালে সে 'ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ' হয়েছে। বাবা কথা দিয়েছিলেন ফাইনালে পৌঁছলে একজোড়া নতুন গ্লাভস দেবেন। পুরনো দুটি দিয়ে কাজ চলছে বটে, তবে বেশিদিন চালানো দুষ্কর! তাই সে বাবাকে জানিয়ে রেখেছিল।

সেই গ্লাভস কিনতে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বিভু বাবার অফিসে এসেছে। বাবা আসতে বলেছেন। অফিস ফেরত পথে বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে যাবেন।

চার তলায় উঠে বিভু রিসেপশানে এল। এর আগেও সে কয়েকবার বাবার অফিসে এসেছে। সেই সুবাদে রিসিপশনের ভদ্রমহিলা তাকে চেনেন। মৃদু হেসে তিনি বিভুকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

একরাশ ফাইলের মধ্যে ডুবেছিলেন বাবা। বিভুকে মুখ তুলে দেখে বলে ওঠেন,- বোস,  একটা জরুরি কাজ রয়েছে। শেষ না হলে বেরোনো যাবে না। বলেই তিনি গম্ভীরমুখে আবার ফাইলে ডুব দিলেন। বাবাকে একটু চিন্তিত দেখল বিভু।

চেম্বারে তৃতীয় কেউ নেই যে কথা বলে সময় কাটাবে। অগত্যা জানলা পথে আকাশ দেখতে লাগল বিভু।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ইন্টার-কম বেজে উঠল। বাবা ওদিককার কথা শুনলেন, নিজে শুধু বললেন- না-না আমি আসছি। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ভিজিটর আছে তুই বোস আমি আসছি।

মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এলেন তিনি। চল এবার বেরিয়ে পড়ব।

এবার বাবাকে হাসিখুশি ও চিন্তামুক্ত দেখাল।

আধঘণ্টার মধ্যেই বিভু বাবার সঙ্গে এসে পৌঁছল কলেজস্ট্রীটের এক বিখ্যাত ক্রীড়া-সরঞ্জামের দোকানে।

বেশ কয়েক জোড়া ঘাটাঘাটির পর খুব লেটেস্ট ডিজাইনের একজোড়া গ্লাভস পছন্দ করল বিভু। তার হাতে ফিটও করল তা চমৎকার।

বাবা প্যাক করতে বললেন। বিল হল পাঁচশো ত্রিশ টাকার।

প্যাকেট ও বিল বিভুর হাতে ধরিয়ে মানিব্যাগ বের করলেন বাবা। সেখান থেকে বের করলেন একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। ব্যাগটা ব্যাক পকেটে রেখে এবার বুক পকেট থেকে একটা ছোট্ট সাদা খাম বের করলেন বাবা। ভীষণ আশঙ্কায় হাত-পা কাঁপতে লাগল বিভুর। শ্বাস রোধ হয়ে আসছে তার।

ঠিক সেই মুহূর্তেই খামের মধ্য থেকে বাবা বের করে আনলেন পাঁচটা একশো টাকার নোট। স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখল বিভু তার একটিতে লালচে রঙ মাখা।

 

অলংকরণ- রাহুল মজুমদার

প্রকাশিত চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১৪

 

Topic : অনুভবের গল্প, মরমি কৈশোরের গল্প, ছোটদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প,

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ