Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভাঙ্গা গড়ার গল্প ।। রুমা সিনহা




শরৎকাল এসে গেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘ দলবেঁধে এদেশ থেকে ও বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে-মাঝে আবার একখণ্ড কালো মেঘ একটু সময় নিয়ে বৃষ্টি দিয়ে যায়। দূরে বনে কাশ ফুল ফুটতে শুরু করেছে।

একটা উঁচু ঢিবির ওপর বসে শ্যামল এসব দেখতে থাকে। কাছের ওই বস্তিতে থাকে ওরা। শ্যামলের বয়স এখন নয় কি দশ হবে। রোজ সকালে একটা বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়োতে বের হয়। ওর মা লোকের বাড়িতে কাজ করে। মা কাজের থেকে এসে শ্যামল বস্তায় যা জড়ো করে সেগুলো  বেচতে যায়। যা পয়সা পায় তা দিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে। শ্যামল তো স্কুলে পড়ে না, তাই দুপুরবেলা এই  ঢিবিতে বসে এসব দেখে।

বস্তির পাশে ওই বড়ো বাড়িটাতে প্রীতমরা থাকে। ফেলে দেওয়া জিনিস বাড়ির এক কোণায় ফেলে রাখে। শ্যামল রোজ ওগুলো বস্তায় ভরে নেয়। প্রীতমের বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে। প্রীতম স্কুলের সময় ছাড়া সারাদিন কাজের লোকের কাছে থাকে। দুজনের বয়স প্রায় একই। রোজ ওদের বাড়িতে যেতে-যেতে শ্যামলের সঙ্গে প্রীতমের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওদের গল্প করা প্রীতমের মা-বাবা পছন্দ করে না। ওরা বলে, ও বস্তির ছেলে, ওর সঙ্গে কথা বলবে না।

কিন্তু প্রীতম কি করবে? ওর তো একটা বন্ধু দরকার। সেটা ওর বাবা-মা'কে ও বোঝাতে পারে না।

একদিন শ্যামল উঁচু ঢিবির ওপর বসে ছিল। প্রীতম লুকিয়ে বাড়ি থেকে এসে শ্যামলের পাশে বসল। দু'জনে গল্প করল।

প্রীতম বলল, দেখতে দেখতে পুজো এসেই গেল। আমার খুব মজা হবে, কত জামা হবে।

শ্যামল বলল, আমার সব বছর জামা হয় না। মায়ের হাতে পয়সা থাকলে তবে একটা জামা কিনে দেয়। প্রীতম বলে, কী করব বল। আমার খুব খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে ভাবি তোকে লুকিয়ে একটা জামা দেব। কিন্তু যদি মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাই, মা-বাবা দুজনেই খুব বকবে-মারবে।

শ্যামল বলল, না-না ওসব করবি না। পুজোতে আমার জামা হল, না হল, ওতে আমার মন খারাপ হয় না। আমি  খবর রাখি পুজোর ক'টা দিন, কোন প্যান্ডেলে কি খাওয়াবে। সেখানে খেতে যাই।

আমারও খুব ইচ্ছে করে, তোর সঙ্গে হই-হই করে পুজোর প্যান্ডেলে খেতে যাই, ঘুরে বেড়াই। কিন্তু মা তো রাজি হবে না।

না-না, তোর মা বকলে আমার সঙ্গে কথা বলিস না।

বকে বকুক। আমরা লুকিয়ে কথা বলব।

তুই এখন যা প্রীতম। তোর কাজের পিসি দেখতে পেলে, তোর মা'কে বলে দেবে।

প্রীতম বাড়ি ফিরে আসে।

শ্যামল আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে আসে।

একদিন শ্যামলের মা খেতে বসে তাকে বলল, শুনলাম পুজোর আগে আমাদের বস্তিটা তুলে দেবে। এখানে বড়ো বড়ো বাড়ি, দোকান হবে।

শ্যামল মা'কে বলে, মা তাহলে আমরা কোথায় যাব?

মা উত্তর দিতে পারে না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

সেদিন দুপুরে ওই ঢিবিটার উপর বসে শ্যামল কত কি ভাবছে। ওদের তুলে দিলে ওরা থাকবে। কি করবে। মা কোথায় আবার কাজ পাবে। এমন সময় একটা কেটে যাওয়া ঘুড়ি চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখল। কিন্তু উঠে গিয়ে ঘুড়িটা ধরতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ দেখল প্রীতম জানলা থেকে চেঁচাচ্ছে, শ্যামল ঘুড়িটা ধর। শ্যামল আনন্দে লাফিয়ে উঠে দিল ছুট ঘুড়ির পিছন-পিছন।

প্রীতম জানলা থেকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। ওর ইচ্ছে থাকলেও যাবার উপায় তো নেই।

শ্যামল ঘুড়ির পেছনে ছুটতে-ছুটতে কাশবনের মধ্যে ঢুকল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে কাটা ঘুড়িটা নিয়ে ফিরে এল।

ওর হাঁটা দেখে প্রীতমের কেমন যেন সন্দেহ হল। শ্যামল জানলা দিয়ে ঘুড়িটা দিতে যেতে প্রীতম ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল শ্যামলের পা কেটে রক্ত বেরচ্ছে।

প্রীতম বলল, ইস তোর পা কেটে তো রক্ত বেরুচ্ছে। দাঁড়া, আমি একটা মলম দিচ্ছি। লাগিয়ে দিলে, তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

শ্যামল বলল, ও কিছু হবে না। ওরকম কত কেটে যায় কাগজ কুড়তে গিয়ে। আর তোর মা যদি জানতে পারে তুই আমাকে মলম দিয়েছিস, তাহলে তোকে খুব বকবে।

প্রীতম বলল, না-না মা জানতে পারবে না। এটা অনেকদিন টেবিলের নিচে পড়েছিল। আমি পেন্সিল কুড়তে গিয়ে পেয়েছি। এটা মা আর খুঁজবে না। আর শোন, পা'টা ভালো করে ধুয়ে মলমটা লাগিয়ে দিস।

শ্যামল মলম নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

পরের দিন সকালে কিছু লোকের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল শ্যামলের। শ্যামল উঠে গিয়ে দেখে কয়েকজন লোক বস্তির লোকেদের বলছে, সামনের রবিবারের মধ্যে সব ফাঁকা করে দিতে হবে।

বস্তির লোকেরা বলল, আমরা গরীব মানুষ, কোথায় যাব? কিছু টাকা-পয়সা দেবার ব্যবস্থা করুন, আমরা অন্য কোথাও থাকার কিছু একটা ব্যবস্থা করি।

লোকগুলো রেগে বলে, জবরদখল করে আছো, আবার টাকা-পয়সা কিসের? রবিবারের মধ্যে খালি না হলে সব ভেঙে দেব।

দেখতে-দেখতে রবিবার চলে এল। শ্যামল সকাল থেকেই ভাবছে কোথায় যাবে তারা। প্রীতমের সঙ্গে আর দেখাও হবে না। এমন সময় লরিতে করে অনেক লোক হাতে লাঠি, কোদাল, বেলচা ইত্যাদি নিয়ে নামল।   ''হঠাও হঠাও'' বলে বস্তির দিকে তেড়ে এল।

বস্তির লোকেরাও চিৎকার করে বলল, আমরা শুধু শুধু এখান থেকে এক পা'ও নড়ব না। আমাদের ব্যবস্থা আগে করতে হবে।

লোকগুলো কোনো কথাই শুনল না। বস্তির প্লাস্টিক ঘর ভাঙতে শুরু করল এক-এক করে। ওই লোকগুলোর সঙ্গে বস্তির লোকেদের মারামারি শুরু হল।

শ্যামলের মা উপায় নেই দেখে ঘরের জিনিসপত্র দূরের গাছতলায় রেখে এল।

এদিকে ফ্লাটের লোকগুলোও এগিয়ে এল। তারাও বলল, আমরা এখানে বস্তি রাখব না।

বস্তির লোকেরা ফ্লাটের লোকদের ওপর ঢিল ছুড়ল।

তারা ক্ষেপে গিয়ে বস্তি ভাঙতে লাগল।

শ্যামলও একটা ইঁটের টুকরো নিয়ে ফ্ল্যাটের লোকগুলোর দিকে ছুঁড়ল। ঢিলটা জানলা ভেদ করে এসে লাগল প্রীতমের কপালে। প্রীতম সেই সময়ে জানলা দিয়ে দেখছিল বস্তির ঝামেলা। প্রীতম চিৎকার করে উঠল। ভয় পেয়ে শ্যামল মাঠের দিকে ছুটে পালিয়ে গেল।

বেলা পড়ে এল। শ্যামলদের সারাদিন রান্না হয়নি। খাওয়া-দাওয়াও হয়নি। শ্যামল সেই গাছতলায় এসে দাঁড়াল, যেখানে ওর মা ঘরের জিনিসপত্র এনে রেখেছিল। দেখল, মা একটা ছেঁড়া প্লাস্টিক টাঙিয়ে ছাউনি করেছে।

শ্যামলকে দেখে মা বলল, সারাদিন কোথায় ছিলি? মা তাড়াতাড়ি শ্যামলকে দুটো বাসি রুটি খেতে দিল।

শ্যামল মাকে জিজ্ঞেস করল, বস্তির আর সব লোকেরা কোথায় গেল মা? জানি না বাবা, কে কোথায় গেল কে জানে। মায়ের চোখে জল এল।

শ্যামল রুটি খেয়ে চুপিচুপি প্রীতমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে প্রীতমের কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

প্রীতম জানে না শ্যামলের  ছোঁড়া ঢিলেই তার কপাল ফেটে গেছে।

ইস সে এটা কি করল। প্রীতম তাকে কত ভালোবাসে। তার পা কেটে যেতে তাকে মলম দিল। আর সে ঢিল ছুঁড়ে প্রীতমের কপাল ফাটিয়ে দিল। তার ইচ্ছা করছে এক্ষুনি গিয়ে প্রীতমকে জড়িয়ে ধরে বলে, প্রীতম আমি তোকে মারতে চাইনি। চেয়েছিলাম ওই লোকগুলোকে মারতে। যারা এত বড়ো-বড়ো বাড়িতে থেকেও আমাদের কষ্ট বুঝতে চায়নি। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।

বাড়ি ফিরে মাকে বলে, মা আমার পায়ের মলমটা ঠিক করে রেখে দিয়েছ তো?

মা মলমটা বের করে শ্যামলের কেটে যাওয়া জায়গায় লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,  কেন পাটা ব্যথা করছে?

শ্যামল কাঁদতে-কাঁদতে মাকে বলে, মা আমি আর কোনোদিন ঢিল ছুঁড়ব না। কোনোদিনও না।

মা শ্যামলকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, ঘুমিয়ে পড়। কাল থেকে নতুন আস্তানার খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে। শ্যামল মলমটা জামার পকেটে রেখে দিল, বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসেবে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

 

Topic : সামাজিক গল্প, প্রগাঢ় বন্ধুত্বের গল্প, Social story, Friendship story, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলা-র গল্প, মন খারাপের গল্প, অনুভবের গল্প, বোধের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ