Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

চকলেট দাদু ।। প্রিয়াঙ্কা কুণ্ডু

 



 

আজ শনিবার। কাল ছুটি, মানে কাল স্কুল নেই। পরীক্ষা শেষ। সোমবার কম্পিউটার। মা কম্পিউটার অন করে প্র্যাকটিস করতে বলে ও ঘরে সিরিয়াল দেখতে চলে গেল। দূর থেকে একটা পাখি সমানে ডেকে চলেছে এক সুরে। কম্পিউটার ডেক্সটপে একটা উঁচু মাঠ আর মাঠের উপর উল্টানো বাটির মতো আকাশে তুলোর মতো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পি-পি... পি-পি... পাখিটা ডাকছে।

বুবুন জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিল, আরে ওই যে মাঠের উপর, ঘাসের থেকে কি খুঁটে খাচ্ছে পাখিটা। বুবুন ওঘরে দেখল, মা কি করছে। উফঃ, মা তো টিভি চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুবুন এক ছুটে মাঠে বেরিয়ে গেল। গা'টা পুরো হলুদ রংয়ের। ঠোঁটটা লাল। নাম না-জানা পাখিটা কালো টানা দুটো চোখ দিয়ে বুবুনের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরে ওর তো ভয় করছে না। বুবুনকে দেখে উড়েও যাচ্ছে না। অত বড়ো মাঠ, বুবুন ছুটেও শেষ করতে পারল না। মাঠের ঢালু দিকটা নিচু হয়ে কিছুদূর গিয়ে ও একটা পুকুর দেখতে পেল।

একটা লোক পুকুরপাড়ে বসে একমনে ড্রইং খাতা খুলে আঁকছে। এবার বুবুন চিনতে পারল, এ তো সেই চকলেট দাদু। স্কুলের পাশের দোকানে সারাদিন থাকেন। দাদু হেসে বলল, এদিকে এসো। বসো এখানে। দাদু তারপর একমনে কতগুলো রঙিন মাছ আঁকল। আঁকা শেষ হলে বুবুনকে বলল, দাদুভাই তোমার কোন মাছটা পছন্দ?

বুবুন একটা লাল রঙের ছোটো মাছে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেই মাছটা জ্যান্ত হয়ে গেল।

দাদু হাসছে আর বলছে, এবার এটাকে পুকুরের জলে ছেড়ে দাও। এরপর এক-এক করে হলুদ, নীল, কমলা সবক'টা মাছই বুবুন জলে ছেড়ে দিল। উফঃ ! এতো দারুণ মজা! ড্রয়িং খাতার পাতা সাদা হয়ে গেল।

দাদু এরপর কতগুলো গঙ্গাফড়িং আঁকল। তার মধ্যে দুটোর পেছনের পা সুতো বাঁধা। কালই তো গঙ্গা ফড়িং দুটো ওদের ডাইনিং প্লেসে উড়ছিল। বুবুনই জানলা-দরজা বন্ধ করে দিল।

সুতোটা তো তুমিই বেঁধেছিলে?

দাদুর প্রশ্নে বুবুনের পলক পড়ল।

দেখছ তো, ওদের কি কষ্ট, উড়তে পারছে না। দাও, শিগগিরই খুলে দাও। এরকম আর কখনো কাউকে ধরে রাখবে না।

দাদুর কথায় বুবুন সুতো খুলে দিল। ওরা উড়ে গেল।

চলো, একটু ঘুরে আসি। ড্রইং খাতাটা কাঁধের ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে দাদু বুবুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

বুবুন দাদুর হাত ধরে পুকুরের পাড় বরাবর এগিয়ে চলল। এ জায়গাটা খুব সবুজ। কত নতুন গাছ চিনিয়ে দিল দাদু ওকে। এরকম কত গাছ স্কুলে যাওয়ার পথে ফুটপাতে দেখেছে বুবুন, অথচ চিনত না। নামগুলোও কী সুন্দর! আকাশমনি, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, দেবদারু, মেহগনি, শিউলি, শিরিষ, শিমূল।

ঘুরতে-ঘুরতে ওরা যখন একটা দেবদারু গাছের তলায় এসে দাঁড়াল, তখন কোত্থেকে একটা কালো রঙের কুকুর এসে বুবুনের পা চাঁটতে লাগল।

বুবুন জানে, এরকম করলে ওদের আদর করতে হয়। বুবুন নিচু হয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতেই ও আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

দাদু এ তো আমার কালু! কোথায় হারিয়ে গেছিল?

দাদু বলল, ওহো, আমি তো জানি।

কালু ওকে আদর করে অস্থির করে তুলল।

দাদু বলল, চলো এগিয়ে চলি।

দাদু, বুবুন আর কালু তিনজনে মাঠের শেষে একটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। রাস্তার দু'ধারে ছোটো-বড়ো গাছ জঙ্গল করে রেখেছে জায়গাটাকে। দূরে আকাশের গায়ে রামধনু উঠেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। দাদু সব ক'টা রং আলাদা-আলাদা করে চিনিয়ে দিল। রাস্তার ধারে একটা বড়ো গাছে বাবুই পাখির বাসাও দেখল। বিকেল হয়ে এসেছে, তবুও বুবুনের পা ব্যথা করছে না।

দাদুভাই, কেমন লাগছে এখানে?

দারুণ দাদু।

ওই যে দেখো তো, কারা আসছে-

বুবুন দেখল, একটা ছোট্ট ছেলে তার বাবা-মা'র হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ছেলেটা মাঝে-মাঝে হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ছে। আবার তার বাবা তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

বুবুনরা যখন ওদের কাছে এল, বুবুন তো অবাক। এতো বাবা-মা আর ছোট্ট ছেলেটা ওরই ছোটোবেলা। বাবা-মা যেন ওকে দেখতেই পেল না। ছোট্ট বুবুনকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেল। বুবুন চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কি দাদুভাই মন খারাপ করছে?

বুবনের চোখ ফেটে জল আসছে। তবুও কাঁদলে চলবে না। তাহলে তো বড়ো হওয়া যায় না। তবুও বুবুন বলে ফেলল, জানো দাদু বাবার সঙ্গে কতদিন ক্রিকেট খেলিনি। বেড়াতে যাইনি। সকালে আমি স্কুলে যাই আর রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়লে বাবা অফিস থেকে ফেরে।

তাহলে তোমার বাবা তো খুব কাজ করে!

কাজ করে বলে কি, আমায় আদর করতে নেই? অভিমানী সুরে বলে উঠল বুবুন।

দাদু বলল, তুমি কি জানো, সেদিন যে তোমার জ্বর হয়েছিল, সারারাত তোমার বাবা তোমার কাছে বসে ছিলেন? দেখো তো তোমার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন। এই যে তুমি সেবার এক্সামে জিওগ্রাফিতে ভালো নম্বর পেলে না, তখনও তো বাবাই বুঝলেন যে, তুমি ঠিকমতো সাবজেক্টটা বুঝতে পারোনি। এবার তো পরীক্ষার আগেই গ্লোব, অ্যাটলাস সব এনে দিলেন। তুমিই বলো, এবার ভূগোল পড়তে খুব মজা হয়েছে তো, নাকি?

বুবুন মাথা নাড়িয়ে বলল, খুব মজা হয়েছে।

আবার দেখো তো, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সক্কালবেলা পেটকাটি, চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খীগুলো যে পেলে, সেগুলো তো বাবাই এনেছিলেন।

বুবুন বলল, সত্যিই তো! বাবা তো আমায় খুব ভালোবাসে!

তাই তো বলছি দাদুভাই, মা-বাবা সবসময় তোমার পাশে আছে। তোমাকে বিশ্বাস করে তারা। তারা চায় তুমি সবসময় ভালো কাজ করো।

বুবুন এবার সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেলল। কাল যখন মা অংক প্র্যাকটিস করতে বলেছিল, ওর তখন মোটেও অংক করতে ইচ্ছে করছিল না। মা তো অংক করতে বলে বাড়ির কাজ করছিল। সেই সুযোগে ও সারাদিন খেলেছে। মা কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি। তাই তো পরীক্ষায় দুটো অঙ্ক করতে পারেনি বুবুন। বুবুন কাঁদছে আর বলছে, মা, আর কখনো করবো না। আর করব না মা-

বুবুন, এই বুবুন কাঁদছিস কেন? কি করবি না?

এইতো মা। বুবুন মাকে জড়িয়ে ধরেছে। আরে একি কাণ্ড! সারাদুপুর টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে ঘুমালি? বিছানায় গিয়ে শুতে পারতিস। কী স্বপ্ন দেখেছিস? আরে বোকা, কাঁদছিস কেন? স্বপ্ন কি সত্যি হয়?

বুবুন চোখ মোছে আর ভাবে, সত্যি, স্বপ্ন যদি সত্যি হত!

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । আশ্বিন ১৪১৫

 

Topic : সুন্দর অনুভবের গল্প, দেদার মজার গল্প, Wonderful feeling story, Best Children story in Bengali, ছোটদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, বোধের গল্প, শিশু কিশোর পাঠ উপযোগী গল্প,

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ