![]() |
কিছুদিন আগে আমাদের স্কুলে একজন নতুন দারোয়ান এসেছে। নাম গোলকরাম। নামের সঙ্গে যেন একটা সংকেতিক যোগাযোগ রয়েছে। নামের বাহারের মতোই তার চেহারার বাহার। বেঁটে-খাটো গোলগাল চেহারার মাঝে মস্ত এক পাট্টাই গোঁফ যেন তাকে আরো খোলতাই করেছে। গোলক তার নিজস্ব ভোজপুরি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই কথা বলতে পারে না। তবে বুঝতে পারে ইংরেজি, বাংলা দুটোই। গোলকের ঘরের পেছনেই রয়েছে বারুইপুরের বিখ্যাত পেয়ারার একটা গাছ। তাতে সারাবছরই গোলগাল নাদুস-নুদুস পেয়ারারা হাওয়ায় দোল খায়। আমরাও তাক করে থাকি পেয়ারা একটু ডাঁসা হলেই পাড়ার জন্য।
এই নিয়মেই এতকাল চলে আসছিল। আমাদের স্বাধীন পেয়ারা পাড়ার ওপর কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি। শুধু মাঝে-মাঝে অংকের স্যার ভুবনবাবু ক্লাসে একটা প্রশ্ন করতেন আমাদের উদ্দেশ্যে, আচ্ছা গাছে পেয়ারা হয় মানে কিছু যোগ হয়, কিন্তু তা আপনিই উবে যায়, এর উত্তর কী হবে? ভুবন স্যারের গাণিতিক ব্যাখ্যার উত্তর কিছুই যেন আমাদের জানা নেই, তাই ক্লাসঘরে অবিরল নীরবতা চলে সারা পিরিওড ধরেই।
গোলকরাম এসেই একটা বিপত্তি ঘটালো। বাগানের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে ফুলের গাছ বসালো। গাছের পাকা, ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে মাস্টারমশাইদের কেটে খেতে দিতে লাগল। কিন্তু আমরা কেউ পেয়ারা গাছের ধারে কাছে গেলেই সে খাটো একটা লাঠি নিয়ে এসে তাড়া করতে শুরু করল। গোলকরামের হাত থেকে পেয়ারাগাছটা বাঁচাতে আমরা ভাবনায় পড়লাম।
আমাদের নিত্য বৈকালিক সমাবেশ বসে ঘোষবাবুদের আমবাগানে। প্রাচীন গাছগুলোতে এখন আর তেমনভাবে আম ধরে না। তবু তার শীতল হাওয়ায় আমরা প্রাণ ফিরে পাই। হাওয়ার দোলায়, পাতাদের ঝিরিঝিরি শব্দের মূর্চ্ছনায় বিভোর ক্যাবলা তো সেদিন দু'চার ছত্র কবিতাই লিখে ফেলল। সেই কবিতা শুনে সভার পার্মানেন্ট সভাপতি শ্রীমান পোকাদা ঘন-ঘন ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ক্যাবলা চর্চা করে যা, তোর হবেই। তবে ওই 'জ্যাঠার সঙ্গে ঝাঁটা' না বলে অন্যকিছু ভাবতে পারিস...।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ক্যাবলা ফ্যাঁচ করে একটা হেঁচে বলল, সে নয় ভাবব, কিন্তু ওদিকে গোলকরামের হাত থেকে পেয়ারাগাছটার বাঁচাবার কী ভাবলে? শুনলাম ও নাকি কয়েকদিনের মধ্যেই গাছটার চারপাশে লোহার তার দিয়ে ঘিরে দেবে!
বেচারি গাছেদেরও যে প্রাণ আছে সেটা কি ও বোঝে না পোকাদা?
কথাটা শেষ করেই সন্তু কোঁ-কোঁ করে খানিকটা কেঁদে নিল। ওর কান্না শুনে পোকাদা ওর পোকা ধরা এবড়ো-খেবড়ো দাঁত বের করে ধমকে উঠল, এ্যাই সন্তু অত চোখের জলের বন্যা না বইয়ে, বইয়ের পড়ায় মন দে। তবে যদি বুদ্ধি খোলে!
সভা শেষ করে পোকাদা আমাদের বলল, ঠিক আছে রাত্রি আসুক, বুদ্ধি খুলুক। কাল বিকালে আবার কথা হবে।
রাতে আমার, সন্তুর, ক্যাবলার কারুর চোখেই ঘুম এল না। তবুও আমরা জানি, রাত্রি আসুক, বুদ্ধি খুলুক মন্ত্রে বিশ্বাসী পোকাদা স্বয়ং রণদামামা বাজিয়ে ঘুমিয়ে চলেছে নিশ্চিন্তে।
পরের দিন বিকালে আমরা সবাই ঘোষ-বাগানে উপস্থিত। শুধু সন্তুটারই দেখা নেই। পোকাদা ঘনঘন আকাশপানে তাকাতে-তাকাতেই আমাকে বলল, হ্যাঁরে, তারাময়ী সন্তুটা আজ কেন যে এল না তা তুই জানিস?
আমি মাথা নীচু করলাম। সকালে স্কুলে একবার দেখা হয়েছিল, আমি মিনমিন করতেই ক্যাবলা বলল, ধন্য হলাম। এতক্ষণ ধরে... ওই তো সন্ত আসছে! ওর উচ্ছ্বাসে আমরা দেখলাম, দূরে সন্তু খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে।
কাছে আসতেই পোকাদা বিঘ্নিত কন্ঠে বলল, এ কী রে! তোর পায়ে কি হল রে?
সন্তু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
ক্যাবলা বলল, আরে থাম। থাম আসনে ফিরে আয়।
কান্না থামিয়ে সন্তু শুরু করল, সকালে গাছের নিচে পড়ে থাকা হাফ পিয়ারা তুলে খেতে যেতেই ছুটে এসে গোলকরাম সেই শুদ্ধ আমাকে কান ধরে হেডস্যারের ঘরে নিয়ে গেছিল। চোর বামাল সমেত ধরা পড়েছে বুঝে হেডস্যার টানা তিনঘন্টা এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তাতেই...। আবার সন্তুর কান্নার রোল উঠল।
ওর কান্নার মাঝেই পোকাদা ধমকে বলল, সবই তো বুঝলাম। তবে হাফ পেয়ারার অর্ধেকটা কে খেয়েছিল?
সন্তু ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল, জানি না, তবে রাতে কোনো পাখি বা বাদুড়ে খেয়ে থাকতে পারে!
ইস্! বলেই পোকাদা উঠে দাঁড়াল। পোকাদা আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, আর সহ্য নয়। আর কান্না নয়। আজই গোলকরামের গোলকীপারি ঘোচাতে হবে। এর জন্য তোর প্রধান সাহায্য চাই।
আমি মৃদু মাথা নাড়তেই ক্যাবলা বলল, হিপ্-হিপ্-হুররে।
আমাকে পোকাদা নির্দেশ দিল, সন্ধেবেলা কাকিমার পুজো হয়ে গেলে, তুই ঠাকুরঘরের ধনুচিগুলো লুকিয়ে নিয়ে মন্টুদার দোকানের সামনে চলে আসবি। তবে খুব সাবধানে, আমাদের অভিযানের কথা যেন কেউ জানতে না পারে।
ক্যাবলা আর সন্তুকে পোকাদা কানে-কানে কী বলতেই তারাও চোঁ-চোঁ দৌড় লাগাল। পোকাদা আমাকে বলল, এখন তুই বাড়ি যা।
সন্ধেবেলা মা'র পুজো শেষ হতেই আমি পড়ার বই গুছিয়ে নিলাম, কোচিং আছে। বইয়ের ব্যাগে সযত্নে ভরে নিলাম দুটো ধুনুচি।
অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই পোকাদা বলল, চল গোলকরামের দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করি।
ক্যাবলা গুনগুনালো, মুলক যাবে, শালুক পাবে।
লক্ষ্য করলাম, ওদের সবার কাঁধেই একটা ব্যাগ।
পোকাদা ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বেড়াল বাঁশি বার করল।
পোকাদার নির্দেশ মতো আমরা চলেছি। একে-একে সবাই ইস্কুলের পাঁচিল টপকে নেমে পড়লাম।
একটা অস্পষ্ট শব্দ গোলকরামের কান এড়াল না। সে ''কৌন হ্যায়! কৌন হ্যায়'' বলে হাঁক পাড়ল।
ততক্ষণে পোকাদার নির্দেশে আমরা সবাই প্রস্তুত।
ক্যাবলা পেয়ারা গাছে উঠে পড়েছে। সন্তু নিচে ব্যাগ হাতে। পোকাদা দ্রুত গোলকরামের ঘরের জানলায় টোকা দিল।
এতদিন হয়েছে গোলকরাম এখানে এসেছে কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা তার পূর্বে হয়নি। সে কিছুটা আড়ষ্ট কন্ঠে কেঁপে বলল, কৌন হ্যায়?
নাকি সুরে পোকাদা বলল, হাঁম তুঁমারা চাঁচা হ্যাঁ হ্যাঁয়। বিঁশ সাঁল হাঁম তুঁমারা ইঁন্তেজার কঁর রাঁহা হ্যাঁয়। চঁলে আঁও বেঁটা গাঁছ কাঁ উঁপ্পর।
কিছুক্ষণ গোলকরাম চুপ। তারপর কী ভেবে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এল।
সঙ্গে-সঙ্গেই পোকাদার নির্দেশে আমি জ্বলন্ত ধুনুচিতে ফুঁ দিলাম।
গনগনে আগুনের গোলা দেখে গোলক থামল। তারপর অন্ধকারেই কী খুঁজল।
পোকাদা একটা মোমবাতি জ্বেলে দূরে দাঁড়িয়ে হিঁ-হিঁ করে হাসতে শুরু করল। গাছের ওপরে ক্যাবলা তখন ব্যাগ ভরতে ব্যস্ত। নিচে সন্তুর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে, ''তোঁকে খাঁব, তোঁকে খাঁব'' শুনেই গোলক ঘুরে গিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
পোকাদা এবার পকেট থেকে বেড়াল বাঁশিটা বের করে অদ্ভুত গা ছমছম করা সুরে বাজিয়ে উঠল।
ঘরের ভেতরে গোলকরাম ততক্ষণে কম্পমান।
ঘরের জানলায় ফের পোকাদার টোকা। সেইসঙ্গে নাকি সুরের আকুতি, চঁলে আঁও বেঁটা, হাঁম তুঁমারা ঘঁর কাঁ পাঁশেই খাঁড়া হ্যাঁয়। চঁলে আঁও বেঁটা।
ধুনুচি হাতে গোলকরামের আধভেজানো জানলার পেছনে পোকাদার সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ওর দিকেই নিষ্পলক দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একসময় জানলার দিকে চোখ রাখল গোলকরাম। জানলা দিয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পেল, জ্বলন্ত দুটো ভুতুড়ে চোখ। আর তারপরেই সে এক কাণ্ড ঘটালো। ''হায় সীয়ারাম, হায় সীয়ারাম'' বলতে-বলতেই দরজা খুলে এক্কেবারে সামনের গেটের দিকে ছুট লাগাল।
ক্যাবলা সন্তুর থলে ভর্তি পেয়ারা, মুখে হাসি আর পোকাদা তার স্বভাবসিদ্ধ মতে মত প্রকাশ করে বলল, ''এই না পোকা ভদ্রের বুদ্ধি!''
এর কিছুদিন বাদেই ইস্কুলে কানাঘুষো শোনা গেল, ভূতের ভয়ে নাকি গোলকরাম তার বাড়ি ফিরে গেছে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : ছোটদের হাসি মজার গল্প,, children laughter & funny story, ছোটদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, wonderful children story in Bengali, Best funny story in Bengali
0 মন্তব্যসমূহ