Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হারিয়ে পাওয়া ।। বিপ্লব রায়


 



আজও বাসটা দেরি করল।

শিয়ালদহে নেমে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছি স্টেশনের দিকে। ছ'টা পঞ্চান্নতে ট্রেন। দু'এক মিনিট বাকি থাকতে ট্রেনে উঠি। শিবশংকরবাবু অন্যান্য দিনের মতো জায়গা রেখেছেন জানলার ধারে। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর খবরের কাগজে চোখ রাখি। একে-একে কাজলবাবু অমিত ও অন্যান্যরাও আসে।

খবরের কাগজ কোনোদিনই ট্রেনে সম্পূর্ণ পড়া হয় না। মানসবাবু এসেই খবরের কাগজ নিয়ে নেন। শুধু আমার কাগজটা নয়, সব যাত্রীদেরই কাগজগুলো তাঁর চাই। নিউজ থেকে বিজ্ঞাপনের পাতা, কোনোটিই বাদ রাখেন না। শিবশংকরবাবু রসিকতা করে মানুষবাবুকে ''কাগজ খেকো বুড়ো'' বলে ডাকেন।

নববাবু না আসলে আমাদের আড্ডার আসর জমে না। তিনি এসেই মানুষবাবুর উদ্দেশ্যে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন মানুষবাবু। শুরু হয় দু'জনের রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডা। আচমকা কেউ ওই কম্পার্টমেন্টে এলে ভাববে, দুই বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে তর্ক যুদ্ধ চলছে। হাতাহাতিও হতে পারে। প্রথম-প্রথম আমারও তাই মনে হত। পরে জানতে পারি, দু'জনের কারোরই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

সাতটা বেজে গেলেও, এখনও ট্রেনটা ছাড়ল না। সবাই ঘড়ির দিকে তাকায়। একে-অপরকে বলে, অফিস পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।

গত রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি। জানলার দিকে এলিয়ে দিয়েছি শরীরটা। বৃষ্টি ভেজা বাতাস আমার মুখ ছুঁয়ে যায়। ভীষণ ভালো লাগে। চোখের পাতা বুঝে আসে। হঠাৎ শিবশংকরবাবুর আলতো ধাক্কায় চোখের পাতা খুলি। তিনি ইশারা করে বলেন, দেখুন বাচ্চাটি একা, সঙ্গে কেউ নেই।

আমাদের কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের প্যাসেজে একটা বড়ো চটের বস্তার ওপর বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে নির্বাক বসে আছে। রোগা গড়ন। গায়ের রং বাদামি। অনেকদিন না-আঁচড়ানো লাল, কোকড়ানো চুল। ময়লা জামা গায়ে। অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো। এমন সময় ট্রেনটা চলতে শুরু করল। বাচ্চাটা আতঙ্কিত হয়ে এদিক-ওদিক চাইতে শুরু করল। ওর দু'চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরতে থাকল।

আমাদের কথাবার্তার মাঝে মানুষবাবু খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে, গম্ভীর স্বরে বললেন, বস্তাটাতে বোম-টোম নেই তো? যা দিনকাল পড়েছে!

কী করে বলব! শিবশংকরবাবু উত্তর দিলেন।

এত হালকা ভাবে নিও না শিবশংকর। এটা সিরিয়াস ম্যাটার। সেফটি ও সিকিউরিটির সঙ্গে আপস করো না। ও কাজল, বস্তাটা চেক করে দেখ না একবার। বললেন মানসবাবু।

কাজলবাবু বললেন, আমি কেন? বোমা ফাটলে আমি মরব, তাই তো? মানসদা, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চালানোর অভ্যাসটা ছাড়ুন। বয়সটা তো অনেক হল।

কাজলবাবুকে উত্তেজিত হতে দেখে অমিত বলল, কাউকে কিছু করতে হবে না। বাচ্চাটাকে সরিয়ে আমিই বস্তাটা চেক করছি।

অমিত সিট থেকে উঠে বাচ্চাটার দিকে এগোতেই সুপ্রিয়বাবু চিৎকার করে বললেন, অমিত, দাঁড়াও।

সকলে তাঁর দিকে তাকিয়ে। মনে হল, তিনি যেন অমিতকে সাহায্য করতে আগ্রহী। সুপ্রিয়বাবুর এরকম আচরণে আমি কিন্তু অবাক হই। বেশ কিছুদিন লক্ষ্য করে দেখেছি, উনি কারোর সঙ্গেই বিশেষ কথা বলেন না। কখনও কোনো বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে, সযত্নে এড়িয়ে যান। সর্বদাই একটা দূরত্ব রেখে চলেন।

অমিতও আমার মতো অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন?

কী করছ তুমি? বললেন সুপ্রিয়বাবু।

বস্তাটা চেক করে দেখব, বোম আছে কিনা। অমিতের সহজ উত্তর।

তুমি কি পাগল হয়েছ? আরে, প্রেসার বোমাও তো হতে পারে। আর তা যদি হয়, তবে জেনো, বাচ্চাটাকে সরানো মাত্রই ফেটে যাবে।

সুপ্রিয়বাবুর কথা শুনে অমিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এমনটা হয় নাকি?

সুপ্রিয়বাবু জোর দিয়ে বললেন, আলবাত হয়। ল্যান্ডমাইন কি জানো? একটা বিশেষ ধরণের বোম। যা মাটির তলায় পুঁতে রাখা হয়। মাটির ওপর চাপ পড়ামাত্র সেটি ফেটে যায়।

সুপ্রিয়বাবুর কথায় বিরক্ত কাজলবাবু বললেন, অনেক হয়েছে। বস্তার ভেতর ল্যান্ডমাইন। কি যে সব আজে-বাজে বকেন!

ল্যান্ডমাইন না থাক, ওই ধরণের অন্যকিছু তো থাকতেই পারে। নিজের মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে যুক্তি খাড়া করলেন সুপ্রিয়বাবু।

অন্যকিছু মানে? কাজলবাবু চেপে ধরলেন।

এই যেমন ধরুন, বাচ্চাটার শরীরেই বোম প্ল্যান্ট করা আছে। বাচ্চা বলে বিষয়টা হালকা করে দেখা উচিত নয়। এখন তো গর্ভবতী মহিলার গর্ভেও বোম প্লান্ট করা হচ্ছে। তাছাড়া, বাচ্চাটাকে তো দেখে মনে হচ্ছে কাশ্মীরি! বললেন সুপ্রিয়বাবু।

সুপ্রিয়বাবুর কথার মাঝেই অমিত বাচ্চাটার কাছে বসে বাংলা মেশানো হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে, এই শোনো, তুমহারা ঘ্যার কিধার হ্যায়? কিধার যাওগে...?

কোনো উত্তর দেয় না বাচ্চাটা। মাথা নিচু করে, শক্ত হয়ে বসে থাকে। শুধু দু'চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে তার।

ট্রেন চলছে ঝিমিয়ে-ঝিমিয়ে। নিত্যযাত্রীরা এই কম্পার্টমেন্টে যায় বলে সকালের দিকে হকাররাও ওঠে না। ট্রেনটা বেলঘড়িয়া স্টেশনে থামে। জানলা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকাই, রেল পুলিশের দেখা মেলে না। মিনিট খানিকের মধ্যে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল।

সুপ্রিয়বাবুকে উদ্দেশ্য করে শিবশংকরবাবু বললেন, আপনি তো রানাঘাটে নামবেন। বাচ্চাটাকে রানাঘাট জি.আর.পিতে পৌঁছে দিন না। ওর একটা হিল্লে হয়ে যাবে।

অসম্ভব! সাড়ে দশটায় আমাকে ক্লাস নিতে হবে। নতুন হেডমাস্টার ভীষণ কড়া। আর পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় আমি জড়াতে চাই না। মানসবাবু তো রাজনীতি করেন, এটা ওঁকেই বলুন না। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন সুপ্রিয়বাবু।

খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে বিস্ফারিত চোখে মানুষবাবু তাকালেন সুপ্রিয়বাবুর দিকে। প্রতুত্তর করলেন না।

বাচ্চাটার দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়তে পারে ভেবে সুপ্রিয়বাবু এবার বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকলেন। কারোর মধ্যে বাচ্চাটাকে ঘিরে কৌতুহল, আবার কারোর মধ্যে বাচ্চাটার সঙ্গে থাকা বস্তাটাকে ঘিরে বোমাতঙ্ক। মুম্বাই বিস্ফোরণের দগ্ধ স্মৃতি সকলের মনেই জ্বলজ্বল করছে। কয়েকজন পরিচিত সহযাত্রী সোদপুরে নেমে গেল।

ব্যারাকপুর থেকে বিমলের ওঠার কথা। ও নদিয়া পুলিশ অফিসে চাকরি করে। শিবশংকরবাবু মোবাইলে বিমলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। সুইচ অফ। ট্রেন ততক্ষণে স্বাভাবিক গতি নিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা ব্যারাকপুরে ঢুকল।

বিমল ট্রেনে উঠতেই শিবশংকরবাবু বললেন, মোবাইলে সুইচ অফ করে রাখো কেন? অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে ফোনে চেষ্টা করছি।

আমাকে! কেন? বিমল জিজ্ঞাসা করল অবাক হয়ে।

এই বাচ্চাটার সঙ্গে কেউ নেই। কোথায় যাবে বলতে পারছে না। মানসদা বলছেন, ওর ওই বাস্তাটাতে বোম থাকতে পারে।

ও! এই ব্যাপার। সহজভাবে বলল বিমল। বলেই হ্যান্ড ব্যাগটা নববাবুর হাতে দিয়ে, পুলিশি জেরা শুরু করল। রীতিমতো ধমকের সুরে। বাচ্চাটা আরো ঘাবড়ে গেল। চোখের জলে অনেক কিছু বোঝাতে চায়, কিন্তু পারে না।

কাজলবাবু বিমলের আচরণে প্রতিবাদ করতে গেলে মানসবাবু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, চারপাশে ট্রেন বিস্ফোরণের খবর রাখো না? বাচ্চাটা কাশ্মীরি উগ্রপন্থীদের ঘাঁটি থেকে এসেছে। বিমল তুমি চালিয়ে যাও।

অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও বিমল বাচ্চাটার মুখ থেকে একটা শব্দও উদ্ধার করতে পারল না। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, সামনের স্টেশনে বাচ্চাটাকে নামিয়ে দিই। আমাদের আর ঝামেলা পোহাতে হবে না।

সুপ্রিয়বাবু বিমলের কথায় সায় দেন।

বস্তাটার কী হবে? নববাবু জিজ্ঞেস করেন।

বোমের কথা ভাবছেন? বোম-টোম নেই। কাশ্মীরি শাল থাকতে পারে। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

বিমলের অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। হাজার হোক, পুলিশের লোক বলে কথা।

বাচ্চাটার হাত ধরে টানতে শুরু করল বিমল।

বাচ্চাটা বার কতক হাত ছিটকে দেয়।

বিমল নাছোড়। ধমক দিয়ে বলে, হাত সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কিয়া সমজতে হো?

সকলের দৃষ্টি তখন বিমলের দিকে। এক হাতে বস্তার মুখ আর অন্য হাতে বাচ্চাটার হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে দরজার দিকে নেবার চেষ্টা করছে ও।

বাচ্চাটা কাঁদলেও মুখে কোনো আওয়াজ বের হয় না।

শিবশংকরবাবু বিমলের আচরণে অবাক হয়ে দেখছেন। তাঁর চোখে-মুখে অপরাধবোধ লক্ষ্য করা যায়।

অধিকাংশ যাত্রীই বিমলের হীরো সুলভ আচরণে খুশি।

ট্রেন ইছাপুর স্টেশনে থামতেই বছর চল্লিশের এক কাশ্মীরি যুবক উদভ্রান্তের মতো কম্পার্টমেন্টে উঠে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। চোখে-মুখে হামি খেয়ে আদর করতে থাকল।

একরাশ আতঙ্ক আর কান্না ভেজা গলায় বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করল, তুম কিধার গ্যায়ে থে পাপা?

দু'জনের নির্মল অশ্রুধারায় আমাদের মধ্যে মরে যাওয়া মনুষত্ব আবার বেঁচে উঠল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭ (অক্টোবর ২০১০)

 

Topic : Best social story in Bengali, সামাজিক গল্প, মূল্যবোধের গল্প, Beautiful story, story of values, ছোটদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, ট্রেন যাত্রার গল্প, লোকাল ট্রেনের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ