Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাজডাঙার মাঠ ।। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়


 

বর্ধমান জেলার কারেলাঘাটের কাছে দামোদর নদের তীরে বাজডাঙার মাঠ নামে একটি মাঠ আছে। মাঠের অনেকটাই এখন নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। আগে এই স্থানটির নাম ছিল ব্রাহ্মণডাঙা। পরে এর নাম হয় বাজডাঙা। ব্রাহ্মণডাঙা কি করে বাজাডাঙা হল সেই গল্পই বলছি এবার।

ব্রাহ্মণডাঙার কাছাকাছি কোনো একটি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে গোপাল নামে একটি ছেলে ছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু জন্মের পর থেকে সে ছিল অপ্রকৃতিস্থ। বদ্ধ উন্মাদও নয়, আবার স্বাভাবিকও নয়। এই নিয়ে বাবা-মায়ের মনে দুঃখের আর অন্ত ছিল না।

চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে। পরনে কখনও পোশাক রাখত কখনও রাখত না। লোকের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। কথা বলত কম। যা বলত তাও অসংলগ্ন। খিদে পেলে খাবার সময় আর রাত্রে ঘুমানোর সময় বাড়ি আসত। তাছাড়া সারাটাদিন ঘুরে বেড়াতো বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, নদীর চরে। কখনও নিজের মনেই হাসত, কখনও কাঁদত। তবে কেউ খ্যাপালে বা কোনো কারণে রেগে গেলে বিপর্যযয় বাধিয়ে বসত। তখন আর সামলানো যেত না ওকে। হাতের কাছে যা পেত তাই ছুঁড়ে মারত সকলকে। ভাঙচুর করত।

এক একদিন কি খেয়াল হত, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গেরস্থের গোয়ালে-গোয়ালে ঢুকে বাছুরের দড়িগুলো খুলে সব দুধ খাইয়ে দিত। কখনও কারো বাড়ির পোষা পাখির খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিত পাখিগুলো। ময়রার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার চাইত। দিলে ভালো, না দিলে ভালো ভালো খাবারের ধুলো-ময়লা ছুঁড়ে খাবার নষ্ট করে দিয়ে আসত। প্রতিবেশীরা এইসব উপদ্রব কত আর সহ্য করবে? ফলে এমন মার মারত যে, সে মার চোখে দেখা যেত না। গোপালের বাবা-মা ছেলের দুর্দশা দেখে নীরবে চোখের জল মুছত।

এইভাবে দিন যায়। অবহেলায় অনাদরে গ্রামের আবুঝ মানুষের অকথ্য নির্যাতনে গোপাল অস্থিচর্মসার হল। কেউ কেউ বলল- ছেলেটার কষ্ট দেখা যায় না। আর পাগলামিও তো দিন দিন বেড়েই চলেছে। তা এক কাজ কর না, ওকে তেরলের বালা পরিয়ে নিয়ে এসো। শুনেছি ওই বালা পরলে বদ্ধ পাগলও ভালো হয়ে য়ায। এত সেরকম পাগল নয়, টনটনে জ্ঞান আছে। সেই সঙ্গে পাগলামিও আছে। যদি ভালো হয়, দেখইনা চেষ্টা করে।

গোপালের বাবা-মায়ের মনে ধরল কথাটা। একদিন গ্রামের কয়েজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল তেরলের বালা পরাতে। কিন্তু যাওয়া আসাই সার হল। তেরলের বলাতেও কিছু হল না ওর। দু-একদিন পরে থাকার পর সে বালা নিজেই খুলে ফেলে দিল গোপাল। তারপর আবার যাকে তাই। বরং উল্টো এক উপসর্গ দেখা দিল ওর মধ্যে।  দিন রাত শুধু 'অ্যাঁ-অ্যাঁ' করে কেঁদে বেড়াতে লাগল গ্রামময়।

এসহ্যেরও একটা সীমা আছে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠল গ্রামবাসীরা। দিনরাত ওই মড়াকান্না কে কতক্ষণ সহ্য করবে? সবাই ওকে দেখামাত্র দূর দূর করতে লাগল। ওর এখন এমন অবস্থা যে মারধর করলে বা গায়ে জল ঢাললেও যেতে চায় না। বরং আরো বাড়ায়।

কেউ কেউ বলল- এই পাপের জ্বালায় অতিষ্ঠ হওয়ার থেকে একে হয় বিষ খাইয়ে মেরে ফেল, নয়তো ছেড়ে দিয়ে এসো দূরে কোথাও।

কিন্তু মুখে বললেও মেরে ফেলার ঝুঁকি নেওয়া যায় না। আবার দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসার ব্যাপারে আপত্তি অনেকেরই। কাজেই গোপাল তেমনই কেঁদে বেড়াতে লাগল।

প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য মাসের সাত তারিখে ব্রাহ্মণডাঙায় ঘটা করে কালীপুজো হত। অনেক পাঁঠা পড়ত। যাগযজ্ঞ হত। ছোটখাটো মেলাও বসে যেত একটা। দূর-দূর গ্রাম থেকে লোক মেলা দেখতে, পুজো দিতে।

তা সে বছরটা ছিল ভয়ঙ্কর খরার বছর। পুকুরে জল নেই, কুয়োয় জল নেই। নদীও জলহীন। নদীর বালি খুঁড়ে সেই জল বার করে খেতে লাগল লোকে। এরইমধ্যে কালীপুজোর দিন এসে গেল।

চারিদিকে জলের হাহাকার। রোদের উত্তাপে মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। তবু বছরে একটি মাত্র দিন। মেলা জমাতে দোকানপত্তর বসেনি। তাতে কী? মায়ের পুজো হবেই। যদি মা করুণাধারায় ভরিয়ে দেন সেই আশায় উৎসবমুখর হয়ে উঠল ব্রাহ্মণডাঙা।

সকাল থেকেই চালা বাঁধা, বেদী স্থাপন ইত্যাদি কাজে মেতে উঠল সকলে। চড়া রোদ্দুর ও খরার দহন উপেক্ষা করে চলতে লাগল কালী পূজার প্রস্তুতি। আর সেইসঙ্গে শুরু হল গোপালের পাগলামিও দৌরাত্ম্যের উপদ্রব। মাঝে মাঝে মড়াকান্না। কখনও সে বাঁশের খুঁটি নাড়িয়ে দেয়, কখনও ঢিল ছোঁড়ে। শেষমেশ সে যখন দেবীর জন্য নির্মিত মাটির বেদিকার ওপর উঠে নাচতে শুরু করল তখন আর রাগ সামলানো গেল না। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসিরা তাকে প্রচণ্ড মারধোর করে গ্রামের মাঠের প্রান্তে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখল দড়ি দিয়ে।

সারাটা দিন দুপুর কাটল এইভাবে। গোপালের মা-বাবাও আর ছেলের খোঁজে এল না। সেই কোন সকালে দুটো পান্তা খেয়ে গেছে ছেলেটা, তারপর সারাদিন আর পাত্তা নেই। ঘরে আটকে রাখারও নয়, অথচ ছাড়লেই বিপত্তি। তা পাঁচজনে যা ভালো বোঝো তাই করুক।

দুপুরের পর হঠাৎই আকাশ জুড়ে দেখা দিল ঘন কালো মেঘ। সে কি ভয়ঙ্কর মেঘের মূর্তি। দিনের আলো নিমেষে ম্লান হয়ে গেল। দাবদাহর সেই জ্বালা দূর হয়ে শীতল বাতাস বইতে লাগল। আনন্দে ভরে উঠল সকলের মন প্রাণ। ঘনঘন বিদ্যুৎচমকের সঙ্গে হঠাৎ এই ভয়ঙ্কর নাদে এক বজ্রপতন হল ব্রহ্মডাঙার মাঠে। চারিদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল। গেল গেল রব উঠল চারিদিক থেকে। আর্তনাদ কোলাহল ও কান্নার শব্দে মুখর হয়ে উঠল চারিদিক। সেইসঙ্গে শুরু হল প্রবল বর্ষণ।

গ্রামের লোক দুর্যোগ উপেক্ষা করেও ব্রাহ্মণডাঙার মাঠে গেল অবস্থাটা কি দেখতে। গিয়ে দেখল, মৃত অর্ধমৃত বেশ কয়েকজন লুটিয়ে আছে মাঠের বুকে। মৃতদেহ ঝলসে গেছে বজ্রাঘাতে। সাত জন ধুঁকছে। আর জনা দশ-বারো অচৈতন্য হয়ে কাদায় মাখামাখি।

গোপালের বাবা-মা ছুটে গেল গোপালকে মুক্ত করতে। যে খেজুর গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল গোপাল সেই খেজুর গাছের মাথা উড়ে গেছে। আর গোপাল সে কোনরকমে প্রাণে বাঁচলেও সংজ্ঞাহীন। ওর মা-বাবা কয়েকজনের সঙ্গে ওকে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে গেল।

সে রাতে কোনো রকমে মায়ের পুজো শেষ হলেও, শেষ রাতে পাঁচটি চিতা জ্বলতে লাগল নদীর ধারে।কালরাত্রি প্রভাত হল। অচৈতন্য গোপাল সকাল হতেই চোখ মেলে তাকাল। অনেকদিন পর সে হাসল, শান্ত মধুর হাসি। বলল- আমার বড্ড খিদে পেয়েছে মা।

গোপালের মা-বাবা অবাক হয়ে গেল। এতো উন্মাদের কথা নয়, এ যে সুস্থ স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। গোপালের মা-বাবা যা ছিল ঘরে তাই খেতে দিল। ওদের মনে আনন্দ আর ধরে না। কতদিন পরে গোপাল মা বলে ডেকেছে।

ব্রাহ্মণডাঙ্গা মাঠে বজ্রপাতের কারণে পাঁচজনের জীবনান্ত হলেও বাজের প্রভাবে গোপালের উন্মাদনা দূর হয়ে সে স্বাভাবিক হয়ে গেল। এই আশ্চর্য ঘটনায় চমকিত হল সকলেই। সেই থেকেই ব্রাহ্মণডাঙার নাম হয়ে গেল বাজডাঙা। ওদিককার লোকেরা এখন ওটাকে বাজডাঙার মাঠই বলে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০

 

Topic : Social story for Childrens in Bengali, Best story of Children সামাজিক গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ