পাশ কাটিয়ে যাচ্ছ যে? দাঁড়াও, কথা আছে। ধরণিধর ছাতা বন্ধ করতে করতে গম্ভীর সুরে বলে।
আমার দুটো সতেরোর লোকালটা ধরতে না পারলে খুব অসুবিধা হবে। পরে তোমার কথা শুনব। তারিণীচরণ বলে।
আরে, রাখো তোমার ট্রেন ধরা। তার আগে বলে যাও, আমার দুটো ছাত্রকে তুমি আমার গানের স্কুলে যেতে বারণ করেছ? ধরণিধরের গলার সুর একটু চড়া।
তার চেয়ে চড়া গলায় তারিণীচরণ বলে, বলেছি তার কারণ আছে। সামনে ছেলেদের পরীক্ষা। পড়া বাদ দিয়ে তোমার গানের স্কুলে গিয়ে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে চিৎকার করার চেয়ে পড়াটা এখন বেশি জরুরি।
বাপু হে! তোমার কোচিং সেন্টারে গিয়ে ছেলেরা কোন বিদ্যাসাগর হবে শুনি? ধরণিধর একটু এগিয়ে তর্জনীটাকে তারিণীচরণের নাকের সামনে নাচিয়ে বলে।
দেখ, তোমার সঙ্গে এই খটখটে রোদ্দূরে দাঁড়িয়ে তক্কো করার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আমার নেই। আমি চললাম। তারিণীচরণ বলে।
ওরে আমার কে রে! তোমার সঙ্গে তক্কো কি আমাকে পাঁজি দেখে করতে হবে? তোমাকে রাস্তায় পেলাম তাই ধরেছি। আগে বলো, কেন ভাঙচি দিচ্ছ? ধরণিধর তরণীচরণের পথ আগলে দাঁড়ায়।
তারিণীচরণ অস্থির হয়ে ওঠে। ট্রেনটাকে ধরতেই হবে। কব্জি উল্টে হাতঘড়িটা দেখে বলে, বললুম তো পড়াশুনা বাদ দিয়ে ষাঁড় চিল্লানি গানের এখন দরকার নেই। আমার কোচিং-এ পড়ে বিদ্যাসাগর না হলেও তোমার কাছে গান শিখে কেউ তানসেন হবে কি?
ধরণিধর দুচোখ বুজে কানে হাত দিয়ে আস্তে করে বলে, তানসেন। তারপর দু-চোখ খুলে ভেংচি কেটে বলে, এই তো তোমার বিদ্যে। কী যে ছাই পড়াও কে জানে? শুনে রাখো, তানসেন একটাই হয়। গণ্ডা গণ্ডা হয়না। একটু বোঝার মতো বুদ্ধিও যে তোমার ঘটে নেই তা আমি জানি।
সেটা তুমি বোঝো? তারিণীচরণ বলে।
গানের ব্যাপারে আমি বুঝব না তো কী তুমি বুঝবে?ধরণিধর আবার তর্জনী তুলে চিৎকার করে।
তারিণীচরণ রুখে দাঁড়ায়। দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলে, আঙুলটা নামাও। তুমি শুধু দিন নেই, রাত নেই, সকাল-দুপুর-সন্ধে নেই, ঘরে বসে বিকট গলায় অ্যা-অ্যা-অ্যা করে যাচ্ছ। তোমার জ্বালায় দিনে কাক, রাতে প্যাঁচা বসতে পারে না দু'দণ্ড। গ্রাম থেকে সব পাখিগুলো তোমার গানের ঠেলায় দেশান্তরী হচ্ছে। সেটা খেয়াল করেছ? আর তোমাকে বলবই বা কী! একটু বুদ্ধি তো তোমার ঘটে নেই। তুমি যে নির্বোধ, সেটাই তুমি বোঝো না। এটাই দুঃখ। ভগবান তোমাকে চেঁচাবার গলা দিয়েছেন। গানেরটা তোমাকে দেননি তা জানো? তারিণীচরণ বলে।
কি বললে তুমি? আমি বুদ্ধিহীন? আমার ঘটে বুদ্ধি নেই? ধরণিধর বলে।
না, নেই। তারিণীচরণের সোজাসাপ্টা জবাব। তুমি বললে না, আমার কোচিং-এ পড়ে কে বিদ্যাসাগর হবে? তানসেন দুটো হয় না, বিদ্যাসাগর বুঝি দুটো হয়?
গানে যে কী রস আছে তা জানো? তাই গান শিখতে মানা করছ। সে স্বাদ তুমি পাওনি। তাই গান নিয়ে এমন কথা তুমি অনায়াসে বলে দিতে পারো। ধরণিধর চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে।
গানের কিছু বুঝি বা না বুঝি, গান শুনতে খুব ভালোবাসি। আমার অবসর গান শুনে কেটে যায়। তাই বলে ডাকাতপড়া চিৎকারকে গান বলে মানতে আমি পারব না। তোমার চিৎকারকে গান বলে মানতে আমার বয়ে গেছে। তারিণীচরণ বলে।
থামো, থামো। তুমি যে কত বড়ো বিদ্যার জাহাজ আমি বুঝি তা জানি না। বাজার থেকে গুচ্ছের নোট বই কিনে এনে তাই ঝেড়ে তো ছাত্রদের পড়াও। সে কথা কি মিথ্যে? বেশি লাগতে এসো না, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। ধরণিধর চেঁচিয়ে বলে।
মাথার উপর সূর্য দপদপ করে জ্বলছে। একটু দূরে রাস্তার পাশে মস্ত নিমগাছটায় বসে একটা কাক ঝিমুতে-ঝিমুতে দুজনকে দেখছিল। মাঝে মাঝে ক্লান্ত স্বরে ডেকে উঠছিল। বিরক্ত কাকটা বুঝতে পারে, দুজনের ঠ্যালায় আজ দুপুরে ঝিমোনো হবে না। আবার ক্কঃ ক্কঃ করে ডেকে দুচোখ বোজে। এই আগুনে রোদ্দুরে গাছের ডালে ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেবে তার জো নেই। দুজনে মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন তক্কো জুড়েছে তাতে কি আর জিরিয়ে নেওয়া যায়! কাকটা দুজনকে দেখে বুঝতে পারে, দম না ফুরোনো পর্যন্ত কেউ থামবে না। আর দুজনের দম কখন ফুরোবে তা কে জানে! তাই কি আর করে। কা-আ-আ করে ডাক ছেড়ে উড়ে যায় একটু দূরে। যেখানে এদের তক্কের শব্দ কানে যাবে না।
কিন্তু তক্কো থামবে কেমন করে! কে থামাবে! তারিণীচরণ আবার হাত ঘড়ি দেখে। কপালে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। বুঝতে পারে দুটো সতেরোর লোকাল আর ধরা যাবে না। কিন্তু নোটবইগুলো আজই কিনে আনতে হবে। খুব জরুরী। কোত্থেকে এই উটকো ঝামেলা এসে পড়ল যে সব পণ্ড হয়ে গেল।
ধরণিধর বগলের ছাতাটা হাতে নিয়ে মাটিতে ঠুকে আবার চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, আমি কিন্তু তোমার কোচিং সেন্টারের বারোটা বাজিয়ে দেব। আমার পেছনে লেগো না।
তারিণীচরণ ডান হাতখানা ধরণিধরের মুখের সামনে ঘুরিয়ে বলে, কি গান তুমি ছেলেদের শেখাও শুনি? আমি না থাকলে ছেলেরা কোচিং-এ বসে খাতা বাজিয়ে যা গান গায়, সে কি গান! তার না আছে সুর না আছে তাল। যেন রামধানিয়ার খাটালে যে শব্দ শোনা যায় একেবারে ঠিক সে রকম। কানের পোকা বেরিয়ে যায়। তোমার কাছে পয়সা দিয়ে গান না শিখে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের মাইক শুনে অনেক ভালো গান শেখা যায়।
তুমি তো তাই বলবে। ধরণিধর বলতে শুরু করে। তোমার যেমন টোকা বিদ্যে, তেমন মোটা বুদ্ধি। ওরে বাবা গান টুকে হয় না। গলার আড় ভাঙতেই কয়েক বছর লাগে। গান হল সাধনার জিনিস।
তারিণীচরণ মুখ ভেঙিয়ে বলে, গলার আড় শেখাচ্ছে। নিজে যেমন গলার আড় ভেঙে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাও তাই তো শিখবে ছেলেরা গানের নামে। শোনো ধরণিধর এখন ওদের পড়ার বয়স। আগে পড়াশোনা শিখে মানুষ হতে দাও। তারপর ওদের যত খুশি গলার আড় ভেঙো, কেউ মানা করবে না।
ওঃ! তাহলে তুমি আমার কথা শুনবে না। ভাঙচি দেবেই। ধরণিধর বলে।
তোমার এমন কিছু গানের স্কুল না যে, ভাঙচি দিয়ে ছাত্র সরাতে হবে। তোমার ইস্কুল ওরা এমনিই ছাড়ত। আজ না হোক কাল তো বুঝতে পারবে। মাঝখান থেকে আমি নিমিত্তের ভাগী হলাম। তারিণীচরণ আস্তে করে বলে।
কাকটা উড়ে পালালেও পাড়ার ঘিয়ে ভাজা সেই গাছটার নিচে শুয়ে ছিল। মাঝে মাঝে লেজ আর কান নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছিল। আর চোখ পিটপিট করে দুজনকে দেখছিল। এই দুপুরে ছায়ায় শুয়ে একটু ঘুমোবে তা এদের জন্য হচ্ছে না। কুকুর হলেও সহ্যের একটা সীমা আছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘেউ-উ-উ করে একটা ডাক ছাড়ে। তারপর লেজটা দুবার নাড়িয়ে দুজনকে লক্ষ্য করে ধেয়ে আসে।
তক্কে ব্যস্ত দুজনের নজর পড়ে ঘিয়ে ভাজার দিকে।
ধরণিধর বলে, সর্বনাশ!
তারিণীচরণ বলে, গেছি রে! পালাও-
ধরণিধর বলে, ওর দাঁত যদি শরীরে বসে, চোদ্দখানা সূঁচ!
তারিণীচরণ বলে, কী করি এখন!
ধরণিধর বলে, দৌড়াও ইষ্টিশানের দিকে। দুটো সতেরোর লোকাল পেলেও পেতে পারো। কুকুরের ধাওয়া করলে পনের মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাবে।
তারিণীচরণ বলে, তুমি পালাও। নতুবা তোমার গলা দিয়ে সরগমের বদলে 'ঘেউ' সংগীত বেরোবে।
দুজন দুদিকে ছুটতে থাকে।
অলংকরণ- অমর লাহা
Topic : বেদম হাসির গল্প, মজার গল্প, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার গল্প, বুক ফাটানো হাসির গল্প, মজার হাসির গল্প, দমফাটা হাসি, সেরা হাসির গল্প, চরম হাসির গল্প, Laughter & Funny story,
0 মন্তব্যসমূহ