Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

দাদুর চশমা ।। অনন্যা দাশ

 



জামশেদপুরের দাদুর কাছ থেকে বাবা যখন ফিরল তখন রোহিন আর বাবাকে জিজ্ঞেস করেনি ওর জন্য কিছু এনেছে কিনা। বাবা যে ওর জন্যে জামশেদপুর থেকে কিছু আনবে সে আশাই করেনি রোহিন। যাওয়ার আগে স্কুল থেকে ডাক পেয়ে টিচারের কাছে ওর নামে নালিশের যা সব ফিরিস্তি শুনেছে তারপর বাবা খুব রেগে গিয়েছিল। অর্ঘ্যর সঙ্গে মিলে ক্লাসের অন্য সব ছেলেমেয়েকে ভয় দেখিয়ে, মেরে, টিফিন কেড়ে নিয়ে যা করে বেড়াচ্ছে তা আর কিছুদিন চললে নাকি রোহিনকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে। তা দিক, বয়েই গেছে রোহিনের। যখন সুযোগ পাচ্ছে তখন মজা তো করে নিক। আর এমনিতেও স্কুল থেকে তাড়ালে আর স্কুলে যেতে হবে না হোমওয়ার্ক, দুনিয়ার টেস্ট পরীক্ষা-টরীক্ষা সব মিলিয়ে যাবে। দারুণ হবে! ওর দাদা অবশ্য ওর থিওরিটা শুনে বলেছে, 'এটা তোকে কে বলেছে অর্ঘ্য? ওই ছেলেটাই তোর মাথা খাচ্ছে। ওসব কিছুতেই হবে না। এই ভাল স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বাবা তোকে নিয়ে গিয়ে কোনো একটা পচা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। তখন বুঝবি মজা।'

রোহিন অবশ্য দাদার কথায় কান দেয়নি। সে মা-বাবার কথাই শোনে না আর দাদা তো কোন ছাড়।

যাইহোক দাদু, দাদার জন্য কি সব মোটা মোটা বই পাঠিয়েছেন বাবার হাতে। সেটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়। যেটা আশ্চর্যের সেটা হল, রোহিনের জন্য যেটা পাঠিয়েছেন একটা সাধারণ চশমা। রোহিন দেখে বলল, 'দাদুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার জন্য চশমা পাঠিয়েছেন? আমার চোখ তো ভালই আছে।

রোহিনের দাদু এককালে নামকরা চোখের ডাক্তার ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। কিন্তু যত ভালো ডাক্তারই হোন না কেন চোখ পরীক্ষা না করে তো আর চশমা দেওয়া যায় না।'

বাবা কিন্তু ওর কথা শুনে গম্ভীর মুখে বলল, 'এই চশমাটায় পাওয়ার নেই। এই ছোটোবেলায় বাবার চশমা ছিল। বাবা মানে তোমার দাদু তোমাকে শুধু দুদিন চশমাটা পড়ে স্কুলের দিতে বলেছেন।'

রোহিন চশমাটা পরে দেখল ওর ঠিকই হচ্ছে। ওটা পরে ওকে বেশ বিজ্ঞের মতো দেখাচ্ছে। স্কুলে পরে গেলে মন্দ হবে না, সবাইকে বোকা বানানো যাবে।

পরদিন রোহিন চশমাটা পরে স্কুলে গেল। অর্ঘ দেখে বলল, দারুণ দেখাচ্ছে তোকে। পরক্ষনেই আবার বলল, জানিস, সুস্মিতার কাকু ওর জন্য বিদেশ থেকে পেন্সিল এনে দিয়েছেন। একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ খানা! ফাটাফাটি দেখতে ওগুলো। চল ওকে ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে দুটো নিয়ে নেব। একটা তোর, একটা আমার। রোহিন অর্ঘ্যের সঙ্গে গেল। সুস্মিতা মনে হয় ওদের মতলব বুঝতে পেরেছে। তাই পেন্সিলগুলো তাড়াতাড়ি বাক্সে পুরছিল। অর্ঘ্য এক ধমক দিল। এই কোথায় ঢোকাচ্ছিস? বার কর ওগুলো।

সুস্মিতা ভয়ে পেন্সিলগুলো বার করে রাখল। রোহিন তাকিয়ে দেখল, টেবিলে পাঁচখানা সরু লিকলিকে সাপ কিলবিল করছে। অর্ঘ্য হাত বাড়াচ্ছে দেখে ওর হাত সরিয়ে দিল। থাক ওই বাজে পেন্সিল নিয়ে আর কাজ নেই!

ওর কথা শুনে সুস্মিতা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। অর্ঘ্য রেগে গিয়ে বলল, 'তোর কী হয়েছে বলত চোখ অমন পিটপিট করছিস কেন? এত সুন্দর পেন্সিলগুলো কিনা বললি বাজে দেখতে। আচ্ছা নে চল।

টিফিনের সময় অর্ঘ্য ফিসফিস করে বলল, আজ দেবজ্যোতিকে বেদম মারব বুঝলি। কালকে ও টিচারের কাছে আমাদের নামে নালিশ করেছিল। আর অন্বেষা লাঞ্চে কেক এনেছে। ওর লাঞ্চটা কেড়ে নিতে হবে, বুঝেছিস! এক কাজ করা যাক, আমি দেবজ্যোতিকে গিয়ে ধরি তুই বরং অন্বেষার কাছ থেকে একটা কেকটা কেড়ে নিয়ে আয়, তারপর দুজনে মিলে খাওয়া যাবে। বলেই অর্ঘ্য চলে গেল।

রোহিন, অন্বেষা, স্নেহারা যেখানে বসে খায় সেই দিকে গেল। রোহিন এগিয়ে গিয়ে দেখল ওদের খাবারের বাক্সে থিক-থিক করছে পোকা! চমকে উঠল রোহিন। কি হচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। অর্ঘ্যকে খুঁজতে গিয়ে দেখল ও দেবজ্যোতিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, মেরেছেও বোধহয়। হঠাৎ দেবজ্যোতির অসহায় মুখটা দেখে ওর কেমন যেন মায়া হল। এক ধাক্কায় অর্ঘ্যকে ঠেলে ফেলল ফেলে বলল, দেবজ্যোতি তুই পালা। দেবজ্যোতি পালিয়ে যেতে রোহিন দেখল, অর্ঘ্য মুখ হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তোর কী হয়েছে বলতো? অন্যদিন হলে তুই মনের সুখে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাতিস। আর আজকে তুই কিনা আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ওকে যেতে দিলি!

তোর ভালোর জন্যেই করলাম, ও যদি আবার গিয়ে টিচারকে নালিশ করে তাহলে তোকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, সঙ্গে আমাকেও।

অর্ঘ্য আরও অবাক হয়ে বলল, তুই তো স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বাঁচিস বলেই জানতাম। নো হোমওয়ার্ক, নো টেস্ট, নো এক্সাম বলছিলি না?

দূর বোকা এই স্কুল থেকে তাড়ালে মা-বাবা নিয়ে গিয়ে অন্য কোনো পচা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। আর সেখানে যদি আমাদের চেয়ে বড়োসড়ো চেহারার কেউ থাকে সে তখন আমাদের নতুন পেয়ে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাবে!

তুই কি ভয় পাচ্ছিস?

দূর  দূর না আকাল কি বাত।

স্কুল ছুটির পর বাসে করে বাড়ি যাওয়ার সময় অন্বেষা এসে ওকে একটা চকলেট দিয়ে গেল। বলল, এটা আজকে আমাদের লাঞ্চ না কেড়ে নেওয়ার জন্যে আমাদের তরফ থেকে।

দেবজ্যোতি ওদের পাশের পাড়াতেই থাকে। বিকেলবেলা মা অফিস থেকে ফেরার সময় দেবজ্যোতির মা'র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। উনি মা'র সঙ্গে রোহিনদের বাড়ি চলে এলেন। রোহিনকে দেখে বললেন, আজ দেবু বলছিল তুমি নাকি ওকে অর্ঘ্যর হাতে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছ! এইরকমই একটু দেখো, ও খুব ভোগে। তাই একটু দুর্বল। তা তুমি যে এত ভালো হয়ে গেছো শুনে ভালো লাগছে।

যে রোহিনের নামে চিরকাল নালিশ আসে, সেই রোহিনের নিজের প্রশংসা শুনতে বেশ ভালো লাগল।

পরেরদিন ওর মনে হল টিচারদের মুখের ওপর জবাব দেওয়াটা বোকা বোকা, আর মা যখন রোজ ওর জন্যে রকমারি সব লাঞ্চ দেয় তখন সেটা না খেয়ে অন্যের থেকে লাঞ্চ কেড়ে খাওয়াটাও ভয়ঙ্কর বোকামি।

সারা ক্লাসের রটে গেল রোহিন পাল্টে গেছে। অর্ঘ্যও আর তাই রোহিনের সঙ্গে থাকে না। শুভ্রদীপ একদিন হঠাৎ বলল, এই চশমাটা হওয়ার পর থেকেই তুই পাল্টে গেলি রোহিন।

চমকে উঠল রোহিন। সত্যিই তো! দাদু তো মোটে দুদিন পরতে বলেছিলেন। কিন্তু ও তো এই ক'দিন রোজই ওটা পরছিল।

সেদিন রাতে ফোনে দাদুর সঙ্গে কথা বলল রোহিন, দাদু তোমার চশমাটায় ম্যাজিক ছিল! আমি ওটা বারো দিন পরে ফেলেছি। আর ভালো ছেলে হয়ে আমার ভালোই লাগছে।

দাদু হেসে বললেন, তাহলে তো খুব ভালো কথা দাদু। আমি যখন তোমার বয়সের ছিলাম তখন আমার মাথায়ও ভূত চেপেছিল। তখন আমার বাবার এক বন্ধু ওই চশমাটা আমাকে দিয়ে দু'দিন পরতে বলেছিলেন। তারপরই আমি বদলে গিয়েছিলাম। তোমার যখন ভালো ছেলে হয়ে থাকতে ভালোই লাগছে তখন ওই চশমাটা আর তোমার কাজে লাগবে না। তবে ওটার সামলে রেখে দিও। কখন কার কাজে লেগে যায় তা তো বলা যায় না!

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

 

Topic : Children's Funny Story,  ছোটোদের মজার গল্প, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, বদলে যাওয়ার গল্প, স্কুলের গল্প, দুষ্টু ছেলের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ