Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কালো ভালো ।। সুকুমার মণ্ডল

 


সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল তুতুর চোখে ঘুম নেই। আজ বুঝি পূর্ণিমা। জানলার বাইরে বাগানটা ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ওপর থেকে ঝরে পড়া চাঁদের আলোয় বকুল গাছের পাতাগুলো রুপোর মতো ঝকমক করছে। ধবধবে সাদা ফুলের টগর গাছটা সাদা হয়ে আছে। কিছু পাখি এখনও জেগে আছে, ওদের কিচিমিচি শোনা যাচ্ছে।

তুতু হঠাৎ দেখল, জানলার ঠিক বাইরে, পেয়ারা গাছের ডালে একটা কাক এসে বসেছে। ভীষণ চমকে তুতু আঁতকে উঠতে যাচ্ছিল। তখন কাকটা পরিষ্কার মানুষের ভাষায় বলে উঠল, ভয় পেয় না, তুমি ঘুমাওনি দেখে গল্প করতে এলাম। ওপাশে ঠাকুমা ঘুমাচ্ছে, তাই প্রায় ফিসফিস স্বরে তুতু প্রশ্ন করল, তোমারও বুঝি ঘুম পায়নি?

চাঁদের আলো গায়ে মেখে ঘোরার এমন সুযোগ বেশি তো আসে না। তোমার মুখটা দেখে মনে হল অনেক দুঃখ জমে আছে। কি হয়েছে আমাকে বলতে পারো, মন হালকা হবে।

দুঃখ কেন হবে না বল, সবাই কেন আমাকে কালো মেয়ে বলবে? আমি কি রান্নার  মাসির থেকেও কালো?

কে তোমায় কালো বলেছে?

কে নয়! ক্লাসের মেয়েরা, অঙ্কের দিদিমণি থেকে শুরু করে বাড়িতে মা পর্যন্ত, সব্বাই। মা বলে, ভাই নাকি আমার থেকে ঢের ফর্সা। শুধু বাবা বাদ। বাবা বলে, আমার কালো মেয়েই ভালো।

তোমার বাবা ঠিকই বলেছেন। কালো মানেই খারাপ এমন ধারণা এক্কেবারে ভুল। এই আমাকেই দেখো না, আগে আমাদের গায়ের রামধনুর মতো বাহারি রং ছিল অথচ এখন কুচকুচে কালো, তাই বলে কি আমি মন খারাপ করে বসে আছি?

তোমাদের গা রামধনুর মতো সাতরঙা ছিল। সত্যি! তাহলে এখন এমন কালো হল কি করে?

শুনবে সে কথা? বেশ, শোনো তাহলে। পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে তুতু জানালার গরাদ ধরে দাঁড়ায়।

সুরেলা আওয়াজ। লোকালয় থেকে দূরে, গহীন বনে থাকত তারা। কারণ, মানুষেরা ওদের দেখলেই ফন্দি-ফিকির করে খাঁচায় ধরে রাখত।

এক জমজমাট শীতকালে অবিরাম তুষারপাত শুরু হল। বরফ পড়ছে তো পড়ছেই। জঙ্গলে ঘাস প্রথমে ঢেকে গেল, তারপর পুকুর, ঝিল, নদী সব জমে কঠিন হয়ে গেল। এরপর বরফ ক্রমশঃ উঁচু হতে হতে ছোটো ছোটো গাছগুলিকে ঢেকে ফেলল, তবু তুষারপাতের বিরাম নেই। বহু পশুপাখি ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে প্রাণ হারাতে লাগল। ভগবানের কোপ মনে করে সবাই প্রমাদ গুনল। প্রবীণেরা মাথা নেড়ে বলল, ঈশ্বরের দরবারে গিয়ে প্রার্থনা করতে পারলে ভগবানের ক্রোধ হবে না। কিন্তু কে যাবে স্বর্গলোকে। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তখন রামধনু-রঙা কাক সাহস করে এগিয়ে এল দূতের দায়িত্ব নিতে। ঘন তুষার ঝড়ের মধ্যে উড়তে-উড়তে কাক কোনোমতে গিয়ে পৌঁছল স্বর্গদ্বারের সম্মুখে। বরফের আঘাতে তখন প্রায় আধমরা সে। কাকের এই অদম্য প্রচেষ্টা দেখে ঈশ্বর মনে মনে খুশি হলেন। ভগবানকে সামনে দেখতে পেয়ে কোনোমতে কাক বলল, রক্ষা করুন প্রভু। তুষারপাত বন্ধ না হলে সমস্ত জীব প্রাণ হারাবে।

ভগবান বললেন, সৃষ্টির বিরুদ্ধে তো আমার যাওয়ার জো নেই। তবে তুমি যখন এত বাধা উপেক্ষা করে আমার স্মরণ চেয়েছ, তোমাকে সাহায্য না করতে পারলে ঈশ্বরের ওপর সকলে বিশ্বাস হারাবে। এরপর ভগবান একটি জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এসে কাককে বললেন, এটা ঠোঁটে চেপে তুমি মর্তে ফিরে যাও। বরফের কাছে এটা নিয়ে গেলেই এর উত্তাপে বরফ গলতে থাকবে।

ঠোঁটে জলন্ত মশালটি চেপে ধরে পৃথিবীময় উড়ে-উড়ে ঘুরতে লাগল সেই কাক। মশালের স্পর্শে বরফ গলতে শুরু করল। এভাবে একদিন বরফ মুক্ত হল নদী, বিল, বন-বনানী। প্রাণীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অবশেষে নিজের প্রিয় বনে তার পরিচিত পশুপাখিদের মাঝে ফিরে গেল সেই কাক।

কিন্তু একি! ওকে দেখে সকল পিছিয়ে গেল কেন! মুখ থেকে মশালটা ঝিলের জলে ফেলে দিয়ে কাক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা অমন করে আমার দিকে চেয়ে আছো কেন?

সেকি! আমাকে চিনতে পারছ না? আমি কাক। সকলের দূত হয়ে ভগবানের কাছে গিয়েছিলাম।

অসম্ভব। কাকের চমৎকার রং হয়। আর তোমার তো দেখছি কুচকুচে কালো রং। বিশ্বাস না হয় ঝিলের জলে গিয়ে দেখে এসো নিজের চোখে।

একথা শুনে শিউরে উঠল কাক। শোঁ করে ঝিলের ধারে উড়ে গেল সে। উফঃ মাগো, কি ভয়ংকর! জলে ওটা কার ছায়া! মশালের তাপে তার এমন রঙিন পাখাগুলির একি দশা হয়েছে! হাহাকার করে কেঁদে উঠল কাক। আর তখন আবিষ্কার করল যে ওর গলা দিয়ে আগেকার সেই মিষ্টি আওয়াজের বদলে বেরুল এক তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজ।

কিছু দূরে ভিড় করে দাঁড়ানো কৌতূহলী পশুপাখিরা সব ভয়ে ক' পা পিছিয়ে গেল। সকলের করুণা ভরা চাহনি আরও বুঝি অসহ্য মনে হতে লাগল।

মনের দুঃখে নির্জনে উড়ে গিয়ে কাক বিলাপ করতে লাগল, হে ভগবান, সমস্ত প্রাণীর প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে গেলাম আর তার এই পরিণতি!

কাকের সামনে স্বশরীরে হাজির হলেন ভগবান। অভয় দিয়ে বললেন, দুঃখ কোরো না। অনুশোচনা করারও প্রয়োজন নেই। তোমার নিঃস্বার্থ কাজের জন্য পুরস্কার হিসাবে তুমি পেয়েছ চিরকালের মতো স্বাধীনতা। রঙিন বাহার আর সুরেলা কন্ঠের জন্যই মানুষরা পাখি ধরে রাখে। ভেবে দেখ, তোমার গায়ের কালো রং ও কর্কশ আওয়াজ লোভী মানুষদের আর আকর্ষণ করবে না। তুমি নির্ভয়ে ঘুরতে পারবে যেখানে ইচ্ছে, যখন খুশি।

হতাশায় কাতর কাকের মনে আশার আলো দেখা দিল। বন ছেড়ে সে উড়ে চলল লোকালয়ের দিকে। বসল গিয়ে খুব নীচু একটা বেড়ার গায়ে। সামনের পথ দিয়ে লোক চলাচল করছে। অবাক হয়ে দেখল কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না, ধরতে আসা তো দূরের কথা।

কী কাণ্ড। রাতদুপুরে জানলায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিস?

ঠাকুমার গলা পেয়েই একছুটে বিছানায় উঠে পড়ে তুতু। বালিশে মাথা গুঁজে জানলার দিকে ফিরে সে দেখল কাকটা আর নেই সেখানে।

(বিদেশি রূপকথা অবলম্বনে)

 

 অলংকরণ- অমর লাহা

 প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

Topic : Fairy story, Fairy tale in Bengali for kids, Rupkothar Golpo, Children best strory, Chhotoder Golpo, রূপকথার গল্প, ছোটোদের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ