Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বেলুনের দেশে ।। সুব্রত হালদার



বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সূত্র অনুসারে গ্যাসীয় পদার্থ পূর্ণ বেলুন আকাশের উপরে উঠে যায়। সেটা ইস্কুলে পড়ার পর থেকেই অবিন আর অগ্নিভর মাথায় কিলবিল করছে আকাশে উঠে বেলুনটা কোথায় যায়! চাঁদের দেশে, না দেবতারা যেখানে থাকে সেই স্বর্গ দেশে! কেন না চাঁদ আকাশে থাকে স্বর্গও আকাশে।

ওরা এইচ. এম. এডুকেশন সেন্টারে সিক্সে পড়ে। ক্লাসের ম্যামকে প্রশ্নটা করবে কি করবে না এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে ভয়ে-ভয়ে একদিন বলেই ফেলল ওদের ক্লাস টিচারকে।

যাক, সেদিন সীমা ম্যামের মেজাজটা ভালোই ছিল। যা কড়া ম্যাম, কোনো কৌতুহলী প্রশ্ন করতেই হাত-পা কাঁপে ছাত্র-ছাত্রীদের। এবার কিন্তু সীমা ম্যাম ভালো মনেই ওদের প্রশ্নের উত্তর দিল। সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল- না, বেলুন ওই দু' জায়গার কোথাও যায় না। উপরে উঠতে-উঠতে এক সময় সে এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়। সেখান থেকে সে উপরে  ওঠে না, নিচেও নামে না। ওটাই তখন ওর দেশ হয়ে যায়।

ম্যামের কথায় উৎসাহিত হয়ে অবিন বলল, তা কেমন করে সম্ভব ম্যাম? সিমা ম্যাম তখন ঠোঁটের কোণে চিরিক করে হাসি ফুটিয়ে বলল, গ্যাস ভর্তি বেলুনের মোট ওজন সমান ডব্লিউ। আর তার অভিমুখ বা গতি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে হয়। আর ওই বেলুনটি ফুলিয়ে বড়ো করার ফলে তার আশপাশ থেকে যে বাতাসগুলো সরে গেল তার উপরের দিকের চাপ বা বলের ওজন সমান এক্স। এই ওজনের গতি সবসময় হয় উপরের দিকে। এই দুই ওজন যখন এক জায়গায় এসে সমান হয় তখন তা হয় এক্স। অর্থাৎ শূন্যস্থানে দুটোর ওজন সমান সমান হয়, সেই জায়গাতেই বেলুনটা দাঁড়িয়ে থাকে। তোমরা যে পড়েছ না- বাতাসের উর্ধ্বচাপ এবং নিম্নচাপ আছে, এখানে সেই কাজটাই করছে উপর নিচের দুটো চাপ। যেখানে এসে সমান-সমান হচ্ছে, সেখানে বেলুনটা দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সীমা ম্যাম বলল, শুধু একটা গ্যাসীয় বেলুন কেন, এই বেলুনে করে মানুষও আকাশে পাড়ি দিচ্ছে।

ম্যামের এই কথাটা শুনে অগ্নিভ আর অবিন এতটা মনমরা হয়ে পড়ল যে ম্যামের চোখ এড়াতে পারল না ওরা। ওদের মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করলে অগ্নিভ ফস করে বলে ফেলল, ম্যাম আমরাও যদি ওই বেলুনের দেশে গিয়ে থাকতে পারতাম তো খুব ভালো হত। সীমা ম্যাম বলল, ঠিক আছে থাকবে, কিন্তু তোমাদের তো আগে আর্কিমিডিসের মতো বড়ো হতে হবে। তবে তো বেলুনে চড়তে পারবে।

ম্যামের কথায় তখনকার মতো ওরা চুপ করে গেল বটে, কিন্তু মন থেকে বেলুনের দেশে যাবার বাসনা ঝেড়ে ফেলতে পারল না। ওরা যে এখনই সেখানে যেতে চায়। অগ্নিভ যদি বা রেলগাড়ি বা প্লেন-ট্রেন দেখলে বেলুনের কথা মাঝে-মাঝে ভুলে থাকতে পারে, অবিন কিন্তু ভুলবার পাত্র নয়। সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত ওর মনে শান্তি নেই।

রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময় রোজই অবিন বেলুনে চড়ে আকাশে ভেসে সেই বেলুনের দেশে যাবার কথা ভাবতে-ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। ভেসে বেড়ায় আকাশের দেশে, বেলুনের দেশে।

বড়োদিনের ছুটিতে অগ্নিভ আর অবিন ওদের বাবা-মায়ের সঙ্গে দিঘাতে বেড়াতে গেছে। আনন্দে যেমন খুশি ছুটোছুটি করছে ওরা। বড়োরা কেউ নিষেধ করছে না। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অগ্নিভর মিনি দিদি। মিনি দিদি অগ্নিভর থেকে চার বছরের বড়ো। মিনি দিদির সঙ্গে আছে বলে বড়োরা আর তেমনভাবে ওদের চোখে-চোখে রাখেনি। খেলতে-খেলতে ওরা কখন যেন সমুদ্র সৈকতের লোকালয়ের বাইরে নির্জন জায়গায় চলে এসেছে। মিনি দিও। সামনে এক জায়গায় ঢাল হয়ে উঠে যাওয়া একটা উঁচু বালিয়াড়িতে ওরা চড়ে বসে। বিশাল বালিয়াড়ির মাথাটা একদম সমতল। খেলনাগুলির মতো নুড়ি আর সুন্দর সুন্দর সামুদ্রিক ঝিনুক দেখে আনন্দে সেগুলো কুড়তে থাকে ওরা।

এমন সময় হঠাৎ সাঁ-আঁ-আঁ- করে প্রায় ঝড়ো হাওয়া সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীর আকৃতির বেলুনের মতো কি একটা যান চারটে ফুলো-ফুলো পা বার করে নামল একটু দূরে। ওরা তিনজনই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ওদের বড়ো বড়ো কৌতুহলী চোখে দেখতে থাকে সেদিকে।

সত্যি সত্যি যেন একটা আস্ত পৃথিবী। নিচে নামার পর গা থেকে বার করা ফুলকো-ফুলকো লুচির মতো দুটো ডানা ঝপ্ করে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেল। ডানার পাশ দিয়ে একটা বেলুন-দরজা হাট করে খুলে যেতে দুটো অদ্ভুত আকৃতির জীব নেমে এল। ওরা ভাবতে লাগল, এ-নিশ্চয়ই আকাশের অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছে, আর মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান এবং উন্নত। ওই পৃথিবীর আকৃতির বেলুন যানই তার প্রমাণ। ওরা বেলুন থেকে একটু দূরে সরে আসতে অবিনরা ভালো করে দেখতে পেল ওদের চেহারা। টেনেটুনে বড়ো জোর চার-সাড়ে চার ফুট লম্বা। পায়ের পাতা দুটো প্রায় এক ফুটের মতো। মাথা বড়ো তরমুজের মতো গোল, আর কালো। কোনো চুল নেই মাথায়। চারটে হাত, সামনে আর পেছনে। একজন দরজার ভেতর থেকে কি একটা যন্ত্র বার করে কিছুটা বালি মাটি খাবলে নিয়ে ভেতরে রেখে দিল।

ওরা এবার অবিনদের দেখতে পেয়ে পিটপিট করে হেসে সামনের দিকে দুই হাত দিয়ে হাতছানি দিল। অবিনরা ছুটে গেল সেদিকে। অবিকল আপেলের আকৃতির হালকা  নীল-হলুদ রঙের তিনটে ফল ওদের দিল। ওরাও সেই ফল খেতে লাগল। ওদের খাওয়া দেখে অবিনরাও খেতে শুরু করল। এত দারুণ মিষ্টি আর সুস্বাদু! মুগ্ধ হয়ে গেল অবিনরা। ওরা কেউ কারোর ভাষা বোঝে না। অথচ কী আশ্চর্য- আকারে-ইঙ্গিতে ওরা কি সুন্দরভাবে একে-অপরের কথা বুঝতে পারছে। অবিনরা এখন ওদের একজনকে 'কিউকাকু' আর একজন 'ভিউকাকু' বলে ডাকছে। ওরাও প্রখর বুদ্ধিধর। তাই ওরাও বুঝতে পেরেছে এরা এই নামে ওদের ডাকছে। তাই ওরা ওদের ডাকে সাড়াও দিচ্ছে।

এতক্ষণের নিবিড় মেলামেশায় ওরা পরস্পরের এমন বন্ধু হয়ে গেল যে, অবিনরা ওদের আকাশের দেশে যাবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করল। অবিনরা জেনেছে, ওরা চাঁদের দেশেও থাকে না স্বর্গেও থাকে না। এর মাঝামাঝি একটা জায়গা ওদের দেশ। অবিনরা নিশ্চিত- ওদের দেশ সেইখানে, যেখানকার কথা সীমা ম্যাম বলেছিল। বেলুন যে দেশে গিয়ে আর নিচেও নামে না, উপরেও যায় না। সেই বেলুনের দেশ। কিন্তু এরা ওদের পৃথিবী যানটা ছিল বলেই তাতে করে পৃথিবীতে আসতে পেরেছে।

অবশেষে যখন 'কিউকাকু' আর 'ভিউকাকু'র দেশে ফিরে যাবার সময় হল- অবিনও ওদের সঙ্গে বেলুন জানে চেপে বসল। মিনি দিদিকে নিল না। মিনি দিদিকে অবিন চেঁচিয়ে বলল, মিনি দিদি, মা-বাবাকে বলে দিস। আমি এদের সঙ্গে বেলুনের দেশে যাচ্ছি। আবার এই পৃথিবী যানে চেপে ফিরে আসব। আমার জন্যে যেন চিন্তা না করে।

ওদের পৃথিবী যানটা সবে উড়তে শুরু করেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বালি জুট মিলের ভোর পাঁচটার শিফটের বাঁশি বিকট শব্দে অবিনের কান ভেদ করে যেন মাথায় গিয়ে সজোরে আঘাত করল। চমকে গিয়ে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে অবিন। মনটা এমন খারাপ হয়ে গেল, বেলুনের দেশ থেকে এই পৃথিবীতে ফিরে এসে। আবার সেই রোজকার মতো স্কুলে যাবার জন্যে এখনই তৈরি হতে হবে। পৌনে ছ'টায় গাড়ি আসবে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ ১৪১৬ (জানুয়ারি ২০১০)

 

Topic : ছোটোদের গল্প, Best children story in Bengali, ছোটোদের পত্রিকার গল্প, ছোটোদের কল্পবিজ্ঞানের গল্প, মজার গল্প, Best children Science fiction short story

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ