Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

রুপোর চামচ ।। প্রবীর জানা


পুকুর পাড়ে আমগাছে কাকের বাসা। দুপুরে বাসায় বসে কাক আর কাকবউ গল্প করছে। কাকবউ বলল, ডিম পেড়েছি। কয়েকদিন পরে ডিম থেকে বাচ্চা জন্মাবে। নিজেরা দু'বেলা পেট ভরে খেতে পাই না। ভাবছি, ওদের কোত্থেকে খাওয়াবো।

কাক কোনো উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকল পুকুর ঘাটের দিকে। রাজবাড়ির ঝি'রা ঘাটে বসে বাসন মাজতে মাজতে গল্প করছে। কিছু সময় পরে কাক বলল, ওই যে রাজপ্রাসাদ দেখা যাচ্ছে, সেখানে রাজা থাকেন। রাজবাড়ির ঝি'রা গল্প করতে করতে বলছে, রুপোর চামচ মুখে নিয়ে নাকি রাজা জন্মেছেন। তাই তার কোনো অভাব নেই। কত টাকা তার।

কাকবউ বায়না ধরল, তাকে একটা রুপোর চামচ এনে দিতে হবে। তাদের বাচ্চা যখন জন্মাবে, তখন তাদের মুখে রুপোর চামচ দেবে। তাহলে বাচ্চাগুলো রাজার মতো বড়লোক হবে। কাক চিন্তা করে বলল, এ এমন কি আর কঠিন কাজ। রাজবাড়ির ঝি'রা সোনার, রুপোর বাসন মাজছে। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে একটা চামচ ছোঁ মেরে তুলে আনছি।

সূয্যি ঠাকুর এখন পশ্চিম আকাশে। একটা চিল আকাশে গণ্ডি কাটতে কাটতে এসে আমগাছের মগডালে বসল। কাক বলল, শোন বাবু চিল, আমগাছে বসার জন্য আপত্তি করছি না। আমার বাচ্চাদের ওপর দৃষ্টি দিও না। ওরা রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছে। বড়ো হলে রাজার মতো বড়লোক হবে।

চিল বলল, তাই বুঝি! ভীষণ ইচ্ছে করছে রুপোর চামচটা দেখতে। কাক বলল এত দূর থেকে কি করে দেখাব।

চিল কাকের বাসার কাছে চলে এলে কাক তাকে রুপোর চামচটা দিল দেখার জন্য। চিল চামচটা হাতে নিয়ে বলল, দেখতে দারুণ তো! আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি আমার ছেলে-মেয়ে হলে তাদের মুখে দেব। কাক বলল, আমি কিন্তু চিৎকার করে সকলকে জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি জোর করে রুপোর চামচ কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ।

কাক তো চিৎকার শুরু করল, সব পাখিরা শুনছ, দুষ্টু চিল আমাদের রুপোর চামচ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

রাজা ঘোড়ায় টানা রথে চেপে পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। তাঁর কানে এল পাখিদের চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ। তিনি সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা চিলের কাছে রাজার ছাপ লাগানো রুপোর চামচ রয়েছে। সেই চামচটা কেড়ে নেওয়ার জন্য চিলের সাথে অন্য পাখিদের হাতাহাতি-মারামারি চলছে।

রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, আমি অবাক হচ্ছি পাখিদের সাহস দেখে রাজার চামচ চুরি করেছে একটা পাখি।

মন্ত্রী বললেন, ঠিক বলেছেন মহারাজ, ওদের কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত।

রাজা বললেন, আমার রাজ্য থেকে পাখিদের তাড়িয়ে দিন। চোর পাখিদের মুখ আমি দেখতে চাই না।

রাস্তার ধারে একজন নিন্দুক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি রাজার সামনে এসে বললেন, মহারাজ, আমি একটি কথা নিবেদন করতে চাই।

রাজা বললে, বলুন।

মহারাজ, পাখিদের দিকে তাড়িয়ে দিলে আবার ফিরে আসবে। গাছে বাসা বানাবে।

তাহলে উপায়?

মন্ত্রী বললেন, উপায় আছে। পাখিরা গাছে বাসা বানিয়ে বাস করে, গাছ যদি না থাকে তাহলে পাখিও বাধ্য হবে এ রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে।

রাজার গোফেঁর ফাঁকে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি নিজের গলার গজমতির হার খুলে নিয়ে মন্ত্রীর গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। তাই আমার গলার হার আপনাকে উপহার দিলাম। আদেশ দিলাম, সারা দেশের সমস্ত গাছ কেটে ফেলতে। এবার পাখিরা নিশ্চয় জব্দ হবে।

আগে রাজা ছিলেন ভীষণ হাসি-খুশি। আজকাল তাকে কেউ হাসতে দেখেনা। আকাশ ও রাজার মতো ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। চঞ্চল মেঘ বালিকারা যেন গম্ভীর আকাশ দাদুকে দেখে ভয় পেয়েছে। তাই আকাশ দাদুর সাথে আর খেলা করেনা। সূয্যি ঠাকুরও ভীষণ রেগে গেছে। তার চোখ থেকে আগুন ঝরছে।

রাজসভা। রাজা মন্ত্রী পরিষদ বর্গ রাজসভায় বসে আছেন। মন্ত্রী সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন, মহারাজ, আপনার কি শরীর খারাপ? চোখে মুখে কালের ছাপ যেন পড়ে গেছে।

রাজা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, প্রজারা কত কষ্টে আছে তা কি কখনো ভেবেছেন?

পরিষদেরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

রাজা আবার বললেন, পরপর দু'বছর বৃষ্টি ভালো হয়নি। তাই ফসলও ঠিকমতো ফলেনি। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজুন।

একজন পরিষদ বললেন, আগে তো কখনো এরূপ ঘটনা ঘটেনি। এ নিশ্চয় এসব কোনো দৈত্যের জাদুর খেলা। রাজা বললেন, যে সেই দৈত্যকে ধরে আনতে পারবে তাকে আমি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেব।

একদিন বিকালে রাজা বেড়াতে বেরিয়েছেন। সঙ্গে চলেছে হাতির পিঠে, ঘোড়ার পিঠে বা হেঁটে সৈন্যরা। পাত্র-মিত্র মন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন সঙ্গে। রাজা হঠাৎ আদেশ করলেন রথ থামাও। ওই দূরে পথের ধারে যে একটা বালক বসে আছে তাকে ডেকে আনো।

রাজার লোকজনেরা বালককে ধরে আনলেন রাজার সামনে। রাজা বললেন, তোমার নাম কি?

বালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বিনয়ের সঙ্গে বলল, মহারাজ আমি কথায় কথায় কবিতা রচনা করে বলতে পারি। তাই সবাই আমাকে কবি বলে ডাকে।

তুমি থাকো কোথায়?

ওই যে গোলাপ পাতার ছাউনি দেওয়া কুঁড়ে ঘর দেখছেন সেখানে।

কি যেন একটা কবিতা জোরে জোরে বলছিলে?

বালক বলা শুরু করল-

গাছ ছিল তাই মেঘ ছিল

লোকজন সব বলছিল,

গাড়ি নাই এখন মেঘ নাই

আগে বৃষ্টি-জল ছিল।

মন্ত্রী বললেন, মহারাজ, আপনার চোখে জল!

রাজা বললেন, একজন বালকের কাছে আমি হেরে গেলাম। রাজ্যে দুর্ভিক্ষের কারণ, আমার অহংকার। আমার আদেশে পাখিদের তাড়ানোর জন্য সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ না থাকলে যে, মেঘ সৃষ্টি হয় না। মেঘ না থাকলে বৃষ্টি হয় না। বৃক্ষ ও মেঘ পরস্পরের বন্ধু। গাছ না থাকার জন্য মেঘও রাগে আমার রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে। এই বালকের কথায় আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। বালককে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কার করুন। বালকটি আনন্দে বলতে বলতে চলে গেল-

দয়ার সাগর মহারাজা

বিশাল যে তার মন,

আসবে ফিরে বৃষ্টি বাদল

সৃষ্টি হলে বন।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

Topic : Story of Fairy Tales in Bengali, Educational stories for children, Best story of Chilfren,  রূপকথার গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ