![]() |
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর কনকনে ঠাণ্ডা। দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘরের ভেতর জমিয়ে বসেছি গোল হয়ে। গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার, চাদর। তবু শীত মানছে না। ইয়া বড়ো একটা হ্যাজাক গনগন করে জ্বলছে ঘরের একপাশে। বেশি হাসাহাসি করলে ফোঁস ফোঁস আওয়াজে ধমকও দিচ্ছে। খাটের ওপর অতি যত্নে পাতা খবরের কাগজের গাদাখানেক তেল মাখা মুড়ি। ছোটোখাটো একটা ঢিবি যেন। বড়ো বড়ো সাইজের কাঁচা লঙ্কা পোঁতা। রান্নাঘরে আলুর চপ ভাজা চলছে।
বড়োমামির রান্নাঘরে গিয়ে সেই সব নিয়ে আসার কথা। অন্ধকারের কারণে তিনি রাজি হননি। এরপর চপ আনতে বলা হল ফুলকাকাকে। ফুলকাকাও দু'পাশে মাথা নাড়ল। সে বিরাট শীতকাতুরে। কলকাতার হালকা শীতেও মাঙ্কি ক্যাপ পরে। এরপর নাম উঠল আমার। মা বলল, যাও রান্নাঘর থেকে চপগুলো নিয়ে এসো। আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ঠেলে পাঠালেও যাব না। ক্লাস টেনে পড়লে কী হবে, আমার আবার ভূতের ভয়টা তখন খুব বেশি। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে চপ আনার মতো বীর আমি নই। তাও কলকাতায় হলে একটা কথা ছিল।
শেষ পর্যন্ত, ধুস! কাউকে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। কাউকে যদি একটা চপও দিয়েছি, বলে গায়ে একটা চাদর ফেলে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলেন বড়োমামা। বন্ধ দরজা খুলে সুরুৎ করে বেরিয়েও গেলেন।
রান্নাঘরে যেতে হয় উঠোন টপকে। একটু সময় লাগবে। আমরা ধৈর্য ধরতে পারছি না। বড়োমামা মুখে যাই বলুন, চপ আমরা পাবই।
আহা, কনকনে শীতে মুখ পুড়ে যাওয়া গনগনে আলুর চপ! আমরা চমকে উঠলাম। কী ব্যাপার? কী হয়েছে? ধড়ফড় করে উঠে ছুটে গেলাম বাইরে। গাবদা মার্কা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে বড়োমামা উঠোনে নেমেছিলেন। যাচ্ছিলেন আলুর চপের সন্ধানে। রান্নাঘরের কাছে পৌঁছতেই হলিডেহোমের কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান কাম রাঁধুনি ভীম হৈ হৈ করে উঠেছে, আরে করেন কী? করেন কী? আগে টর্চ নেভান। আলো বন্ধ করুন।
আলো বন্ধ করতে বলছে, এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে। কারণটা কী? মারবে নাকি? ভীমের কথা শুনে বড়োমামা গেলেন বিরাট ঘাবড়ে। তাড়াহুড়োতে টর্চ নেভানোর বোতামটাই গেল গুলিয়ে। হাতের জ্বলন্ত টর্চ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঘুরতে লাগল বনবনিয়ে। ছিটকে আলো পড়তে লাগল বাড়ির পাঁচিলে, ছাদের সিঁড়িতে, গাছের মাথায়।
ভীম রান্নাঘরে কড়াই থেকে গরম আলুর চপ ছাকনি দিয়ে তুলছিল। টর্চ হাতে বড়োমামাকে আসতে দেখেই আলো নেভান, আলো নেভান বলে হাঁক পাড়ে, আর তাতেই বড়োমামা যান ঘাবড়ে। আলোর লাফানি দেখে ভীম নিজেও লাফাতে শুরু করে। সর্বনাশ, কেলেঙ্কারি, বিপদ বলতে-বলতে চপের কড়াই উল্টে সে লাফ মারে উঠোনে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বড়োমামার ওপর। জ্বলন্ত টর্চ কেড়ে নিজের গায়ের চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলে তড়িঘড়ি। পাবদা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ভীমের তেলচিটে চাদরের তলায় ঢুকে কেমন যেন চিমসে মেরে গেল।
বড়োমামা গেলেন বিরাট চটে। এ আবার কেমন ব্যবহার? দেশে কার্ফু লেগেছে নাকি? যুদ্ধের সময় কার্ফু ঘোষণা হলে আলো জ্বালা নিষেধ। ভীমের ওপর শুরু করলেন বিরাট হম্বিতম্বি। ভীম বলল, যা খুশি বলেন। সেরকম বুঝলে আমার গালে দুটো চড় দেন। কিন্তু দোহাই, আলো নিয়ে বাইরে আসবেন না। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ভীম জানাল, এখানে থাকতে হলে আলোর ব্যাপারে ভারি সাবধানে থাকতে হবে। চলতে হবে নিয়ম মেনে।
নিয়মের একটু এদিক-ওদিক হলেই নাকি বিরাট বিপদ, বেজায় সর্বনাশ। রাতে বাইরে বেরোতে আপত্তি নেই। এমনকি মাঝরাতেও বাগানে, ছাদে হাঁটাহাঁটি চলতে পারে। কিন্তু, সঙ্গে আলো রাখা চলবে না। এমনকি টর্চেও মানা। সন্ধের পর যে ঘরে হ্যারিকেন, হ্যাজাক থাকবে সে ঘরের জানলা রাখতে হবে বন্ধ। ফাঁকটুকু দিয়ে আলো যেন গলে না বেরয়। উঠোন, বারান্দা দিয়ে আলো হাতে যেতে হলে, আলো রাখতে হবে আড়াল করে। খবরদার, আলো যেন বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকে বাইরে না যায়।
আমরা অবাক হলাম। এই নিয়মের মানে কী? অন্ধকারে ভয় নেই, অথচ আলোতে বিপদ। লোকটার কি মাথা খারাপ?
মামাতো বোন মিলি ফিসফিস করে বলল, মনে হয়, লোকটা ভূত পোষে। আলো দেখলে পাছে পোষা ভূতগুলো পালিয়ে যায়, তাই ভয় পাচ্ছে।
এসব বেশ আগের কথা। মোবাইল ফোন বা ফেসবুকের জমানা শুরু হয়নি তখনও। কয়লার ইঞ্জিন সবে বিদায় নিয়েছে। আমরা বিরাট দল নিয়ে গেছি শিমুলতলায়। পাক্কা দশদিনের আউটিং। বড়োমামা টু ফুলকাকা ছোটোমাসি টু রাঙাদি। ঘটু টু বিল্টু। হোল্ট অল টু ছাতা। জলের কুঁজো টু বেলুন চাকি। ফুল টিকিট, হাফ টিকিট মিলিয়ে মোট একুশজনের টিম। শিমুলতলায়, দেওঘর, মধুপুরে বেড়াতে গেলে টিম বড়ো না হলে চলত না। আমার ধারণা স্টেশনে নামতেই দেওয়া হত না। সেই সময়ে এইসব জায়গাগুলো ছিল ছমছমে, চমৎকার। শিমুলতলা ছিল সেরার সেরা।
তুফান মেল লেট করল সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। আমরা তিনখানা টাঙায় বসে, দাঁড়িয়ে, ঝুলে বড়োমামার অফিসের হলিডেহোমে পৌঁছে গেলাম শেষ বিকেলে। মূল শহর থেকে খানিকটা দূরে। আহা! শুনশান উঁচু-নিচু মাঠের একপাশে ছোট্টো বাড়ি, লাল ইঁটের। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। সামনে গোলাপ বাগান। মাথার ওপর ছাদ। পিছনে উঠোন। দূরে ছোটো টিলা আর জঙ্গল। সেখানে আসা শিরশিরে হাওয়া কনকনে ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে হলিডেহোম দুর্দান্ত। বাক্স-পেটরা রেখে প্রথমেই একচোট দাপিয়ে নিলাম। সন্ধে হতে না হতেই অন্ধকার নামল ধপাস করে। বাপরে! সে কি অন্ধকার! তারওপর আবার দু'দিন বাদেই ছিল অমাবস্যা। অন্ধকারে নিমেষে ঘুটঘুটে হয়ে গেল চারপাশ। শুনলাম, এসব জায়গায় ইলেকট্রিক কারেন্ট শুধু নামেই আছে। আমরা খুব খুশি হলাম। অন্ধকারেই মজা বেশি। বড়োমামা ছিলেন আমাদের ট্যুর ম্যানেজার। ভীমকে দিয়ে ঝটপট ঘরে ঘরে হ্যাজাক জ্বেলে দিলেন। সবাই বলল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নয়। এক ঘরে বসে গল্প হবে। ভূতের গল্প। সঙ্গে মুড়ি আর আলুর চপ। ভীম গদগদ মুখে হাত কচলে বলল, রাতে তাহলে মুরগির মাংস করে ফেলি? আমরা হৈ হৈ করে রাজি হয়ে গেলাম।
এর কিছু পরেই আলো নিয়ে গোলমাল লাগল। গোলমাল না বলে রহস্য বলাই ভালো। কেন এই রহস্য? আমরা সবাই মিলে ভীমকে চেপে ধরলাম। ভীম যা বলল, তাতে আমাদের চোখ কপালে উঠল।
এসব জায়গায় নাকি ডাকাতদের উপদ্রব। তারা অনেক দূরের টিলা, জঙ্গল থেকে নজর রাখে। রাতে নতুন কোনো বাড়িতে আলোর বিন্দু দেখলেই বুঝতে পারে ট্যুরিস্ট এসেছে। রাতে আছে। তারমানে মালপত্রও আছে সঙ্গে। ব্যাস, ইচ্ছে করলে হা-রে-রে করে ছুটে আসতে পারে। তবে আলো না দেখতে পেলে ডাকাত পড়ার ভয় অনেকটাই কমে যায়।
এরপর আরও ন'দিন আমরা শিমুলতলায় ছিলাম। সন্ধের পর আলো লুকোনো নিয়ে যে কত মজা করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের বেড়ানোকে আরো উত্তেজনার, আরো আনন্দের করে তুলেছিল। তবে, সেটা আর একটা গল্প। একুশজনের টিম নিয়ে বাঙালির হৈ-হৈ করে শিমুলতলা, দেওঘর, গিরিডি বেড়ানো এখন প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। প্রায় কেন? মনে হয় না কেউ যায়। এখন কান পাতলে চারপাশে শুধু হংকং, ব্যাঙ্কক, পাটাইয়ার গল্প।
আমি জানি, শিমুলতলায় গা-ছমছমে বেড়ানোর কাছে সেগুলো কিছুই নয়।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩
Topic : Mystery-thriller story in Bengali, Children short story, Adventure story, Chhotoder golpo, রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প, বেড়ানোর গল্প
0 মন্তব্যসমূহ