![]() |
ছোটবেলা থেকে রূপচাঁদ খুব বুদ্ধিমান ছিল। বুদ্ধির খেলা খেলতে তার খুব আনন্দ হত। তবে বড়ো হয়ে সে তার বুদ্ধিকে ভালো কাজে লাগাতে পারেনি। কেন না সে ছিল একেবারে গরিব ঘরের ছেলে। আর তার ওপর বড়ো পরিবার। বাবা-মা-ভাই-বোন, নিজের স্ত্রী ছেলেপুলে করে প্রায় ১২ জন। সুখে বাস করা তো দূরের কথা দু'বেলা খাবার জুটত না। অভাবে স্বভাব নষ্ট, তাই তার বুদ্ধি ভালো কাজের পরিবর্তে খারাপ কাজেই লাগাত বেশিরভাগ সময়।
কাঠুরিয়া কাঠ কিনবে, রূপচাঁদ তাদের দেখে গাছে উঠে পড়ে, গাছের তলায় তারা এলে রূপচাঁদ বলে, কি তোমরা আমার এই গাছটা কিনবে? তারা খুশি হয়ে বলে, হ্যাঁ-হ্যাঁ। আমরা তো গাছই খুঁজছি। তারপর অল্প কথায় দরদামটা ঠিক হত। টাকা হাতে পেয়েই রূপচাঁদ উধাও হয়ে যেত। গাছ তো তার নয়।
কোথাও থেকে রূপচাঁদ ক'টা ছাগল নিয়ে পথে চলা শুরু করত। এমনভাবে চলত যেন তার নিজেরই পোষা ছাগল। তারপর বেপারী দেখলে দাম বলত, এই টাকা দাও। বড্ড জ্বালাতন করছে ছাগলগুলো। আর রাখতে পারব না। পরের ছাগল কম দামে বিক্রি করে দিয়ে সে পালাতো এইভাবে।
এরকম শত-শত কাণ্ডকারখানা সে করে চলত। তবে সবসময় যে ঠকানোর কাজ করত তা নয়। মাঝেমধ্যে সে ভয়ানক বুদ্ধিদীপ্ত কাজও করত।
সেবার বৃদ্ধা ননীবালার চার ছেলে জোর করে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে চায় জেনে, রূপচাঁদ বিষয়টা মাথা দিল। বলল, তোমার কিছু চিন্তা নেই জেঠিমা। সন্ধ্যায় ওরা মারধোর করতে উদ্যত হয়েছে অমনি নাকি গলায় রূপচাঁদ বলে ওঠে, আঁমি তোঁদের বাঁপ চঁরণদাঁস বঁলছি, তোঁদের মাঁকে যঁদি আঁর কঁষ্ট দিঁস, তাঁহলে সঁব কঁ'টার ঘাঁড় মঁটকাব। আর যায় কোথায়, সবাই মায়ের পায়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। রূপচাঁদ মনে-মনে বলল, ধন্য আমার হরবোলা শিক্ষা। আর দেরি না করে সে চট করে গা ঢাকা দিল।
এইবারে সে ভাবনা-চিন্তা করে একটা বড়ো ধরণের কাজে হাত দেয়। অনেকদিন থেকেই এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করেছে। বন্ধুকে বলে, ভাই দেখছ তো, আমরা খুব গরিব। অনেক কষ্টে একটা স্বর্ণমুদ্রা জোগাড় করেছি। ভাঙাচোরা ঘরদোর। তোমার কাছে আমার স্বর্ণমুদ্রাটি যত্ন করে রেখে দাও। সময়ে আমি চেয়ে নেব। সরল বিশ্বাসে ব্যবসায়ী বন্ধু স্বর্ণমুদ্রাটি গচ্ছিত রেখে দেয়। রূপচাঁদ তখন সাবধানের সুরে বলে, ভাই গরিবের ধন খুব সাবধানে সিন্দুকে করে রেখো। ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলে বন্ধুও রূপচাঁদকে সান্তনা দেয়।
তার কিছুদিন পরে স্বর্ণ ব্যবসায়ী দেখে তার ঘরে একটা গহনার বাক্স উধাও। খোঁজ-খোঁজ, কিন্তু কিছুতেই আর পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ী বন্ধুর সন্দেহ হয়, গরিব বন্ধু অভাব পড়ে চুরি করলেও করতে পারে বলে। কিন্তু সরাসরি কীভাবে বলে সে কথা। সে রূপচাঁদের বাড়িতে যায়। ইতস্তত করছে ব্যাপারটা বলবে, ওমনি চোখে পড়ে যায় ঘরের জানলার উপর একটা খোপে সেই বাক্সটা বসানো। অবাক হয়ে যায় ব্যবসায়ী বন্ধু। প্রথমত কিছু বলতে পারে না। তারপর কোনোরকমে মনকে শান্ত করে বলে, বন্ধু ওই যে বাক্সটা, ওটা তো আমার।
রূপচাঁদ বলে, হ্যাঁ ভাই তোমারই তো।
ব্যবসায়ী বলে, ওতে অনেক সোনার গহনা আছে। এটা তোমার এখানে এল কী করে?
রূপচাঁদ বলে, এতে আশ্চর্যের কী আছে? তুমি তো আমাকে বাক্সটা বিক্রি করেছ। তাই-
ব্যবসায়ী বলে, ছিঃ-ছিঃ! তুমি কী বলছ! চুরি করে নিয়ে এসে বলছ, বিক্রি করেছি?
গোলমাল ভীষণ বাড়ল দু'জনের মধ্যে। রূপচাঁদ বলে, বিক্রি করেছ। ব্যবসায়ী বলে, চুরি করে এনেছ। একদিন-দু'দিন করে পক্ষকালেও বিবাদ মীমাংসা হয় না। অবশেষে সেই গোলমালের ঢেউ আছড়ে পড়ল রাজদরবারে।
রাজসভায় অভিযোগকারীর কাছ থেকে সবকিছু শুনলেন রাজা। তারপর তিনি সভায় উপস্থিত বিবাদীপক্ষ রূপচাঁদকে তার বক্তব্য শোনাতে বললেন। রূপচাঁদ রাজামশাইকে সম্মান জানিয়ে স্বচ্ছন্দে বলে দিল, তার বন্ধু সত্য গোপন করছে। সত্যিই সোনার বাক্স সমেত সে তাকে বিক্রি করেছে। প্রমাণ স্বরূপ সে বলল, বন্ধুর সিন্দুক পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন। তাতে তার দেওয়া অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রা আছে। একটিতে আবার তার নামও অঙ্কিত করা আছে। বন্ধু সব জানে, তবুও অস্বীকার করছে।
লোক পাঠানো হল ব্যবসায়ীর বাড়িতে। না, তাতে কোনো রূপচাঁদ লেখা স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল না।
বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, মহারাজ এবারে আমি বুঝতে পেরেছি সমস্ত ঘটনা। আমাকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বন্ধু আমার সিন্দুকে সমস্ত মুদ্রার সঙ্গে রাখতে বলেছিল। যাতে প্রমাণ হয় ওই সমস্ত টাকা বন্ধুর দেওয়া। কিন্তু সে টাকা আমি অন্য জায়গায় রেখেছি। মুহুরীর দস্তখত করা একটি তোবিলে নাম লেখা সে টাকা আছে।
রাজকর্মচারী একজন ছুটল আবার। সে এসে জানাল, হ্যাঁ স্বর্ণ ব্যবসায়ী যা বলেছে সবই সত্যি।
মহারাজ শেষবারের মতো রূপচাঁদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী রূপচাঁদ, তোমার কিছু বলার আছে?
রূপচাঁদ কিছু বলতে পারল না।
স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহারাজকে সবিনয়ে বলল, শেষের দিনে ও আমায় ভয় দেখিয়ে বলেছে, যদি রাজার কাছে যাস তো এমন প্রমাণ বার করব তুই কারাগারে যাবি।
রাজা একথা শুনে তো একেবারে রেগে লাল হয়ে উঠলেন।
অবস্থা বুঝে রূপচাঁদ কান্নাকাটি জুড়ে দিল। রাজার পায়ে ধরে বলতে থাকল, মহারাজ, আমি গরিব। অভাবে পড়ে এমন কাজ করে ফেলেছি। আপনি আমাকে পায়ে করে রাখুন। ক্ষমা করে দিন।
রাজার রাগ যায় না। সভাসদদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা কি বলছেন?
সকলে সমস্বরে বললেন, এমন অপরাধের শাস্তি মৃত্যু।
রাজামশাই একটু চুপ করে বসে থাকলেন। দেখলেন, দূরে রূপচাঁদের পরিবারের সকলেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে। বিশেষ করে রূপচাঁদের স্ত্রী, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে কাঁদছে। বুক ভেসে যাচ্ছে তাদের চোখের জলে।
রাজা রূপচাঁদকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম, এ কথা বলেও বলতে পারলেন না। অন্য কি মনে করে মুখ খুললেন। বললেন, রূপচাঁদ অপরাধী। মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য। কিন্তু তার বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেছি। তাই তাকে মৃত্যুদণ্ড নয়, একটা অভিনব শাস্তি দিতে চাই। ওর হাত-পা বেঁধে গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা হবে। সেখানে হিংস্র পশুরা আছে। সারারাত্রি কাটিয়ে ও যদি বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে ওর শাস্তি আমি পুনর্বিবেচনা করব। আর যদি মৃত্যু হয়, সেটাই হবে ওর যথার্থ শাস্তি। রক্ষী, একে হাত-পা বেঁধে জঙ্গলে ফেলে এসো।
রাজামশাইয়ের আদেশ পেয়ে কয়েকজন রক্ষী রূপচাঁদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে সকলের সামনে দিয়ে জঙ্গলে চলে গেল।
রূপচাঁদের পরিবারের সকলে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেল।
এদিকে দশ-বারোটা ঘোড়া ছুটিয়ে রক্ষীরা রূপচাঁদকে বাঁধা অবস্থায় গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোড়ার পদশব্দ মিলিয়ে গেল গভীর জঙ্গলে। একা পড়ে রইল রূপচাঁদ।
চারিদিক থেকে হিংস্র জন্তুর ডাক কানে আসতে লাগল রূপচাঁদের। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা গায়ের কাছে এসে যাবে! কেন না মানুষের গন্ধ ওরা বুঝতে পারে। কিন্তু সে তো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। দৌড়ে পালাতে পারবে না। মরণের হাতে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই।
রূপচাঁদ মনে-মনে চিন্তা করছে, বিপদের সময় বুদ্ধি হারালে চলবে না। সে অনেক বুদ্ধির খেলা খেলেছে। বিজয়ীও হয়েছে। আজ জীবনের কঠিন খেলার সামনে সে দাঁড়িয়ে।
সে চেয়ে দেখে তার কাছেই যে মোটা গাছটা আছে, তার গোড়াতে একটা কোটর আছে। সেটা বেশ গভীর। গড়িয়ে গড়িয়ে অতিকষ্টে সে গাছটার কাছে যায়। তারপর সে কোটরে মুখ ঢুকিয়ে বাঘের আওয়াজের গর্জন তোলে। হু-উ-উ-ম-, গাঁ-আঁ-আঁ-ফ-, গ-র-র-র-। অবিকল বাঘের ডাক। আজ গলা নকল করার বিদ্যেটা ভীষণ কাজে লেগে গেল তার।
রূপচাঁদ ভেবেছিল, বাঘের ডাক দিলে অন্য জন্তুরা অবশ্যই পালাবে। আপাতত বাঁচব। তারপর বাঘ যদি আসে তখনও ডাক দেব। একাধিক বাঘ এসে গেলে অবশ্যই বিরোধ বাধবে তাদের মধ্যে। কেন না, জন্তুরা সুখের দিনে ভাগ করে খেতে পারে না।
সত্যি সত্যি জন্তুরা যারা কাছে এসেছিল, তারা তো বাঘের এই জঙ্গল কাঁপানো ডাক শুনে ভাবল, বনে তো দুটো রাজা, তার মধ্যে কোনো এক রাজা ক্ষেপে গেছে। এই ভেবে, যে যেদিকে পারল প্রাণ ভয়ে পালাল।
ইতিমধ্যে একটা রাজার কানে গেল সে হুংকার। শুনে তো রেগে গরগর করে উঠল। এতো অন্য রাজার গলা নয়! এ নিশ্চয়ই অন্য রাজার ষড়যন্ত্র! একা পারবে না বলে, অন্য বন থেকে বন্ধু জুটিয়ে এনেছে! আমাকে জব্দ করবে বলে!
অন্য রাজাও সে ডাক শুনতে পেল। ঠিক প্রথম রাজার মতো সেও ধারণা করল। রেগে গেল ভয়ানক। আমাকে মারবার ফন্দি এঁটেছে! অন্য জায়গা থেকে বন্ধু জুটিয়ে এনেছে নিশ্চয়ই! দেখাচ্ছি মজা। বলেই গুহা থেকে লাফ দিয়ে বনের দিকে মারল ছুট।
দু'জনের মধ্যে চুক্তি ছিল, আজ প্রথম রাজা বেরোলে তো পরের দিন দ্বিতীয় রাজা বেরোবে' তাদের সামনা-সামনি যেন দেখা না হয়' কিন্তু আজ দু'জনেই দু'জনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে লড়াইয়ের জন্য বেরিয়ে পড়ল। আর কোথা থেকে সেই নতুন বাঘের গর্জন যেন বন কাঁপিয়ে তুলতে লাগল। যত আওয়াজ ওঠে দু'জনের রাগও চড়তে থাকে। তারপর কাছাকাছি আসতেই সে কি যুদ্ধ। কেউ তো কম যায় না। দু'জনেই শক্তিধর। দু'জন-দু'জনকে কামড়ে ধরে। সে কামড় আর ছাড়ে না। একে-অপরকে কামড়ে ধরা অবস্থায় গড়িয়ে নদীর জলে পড়ে যায়। তবু একে-অপরকে ছাড়ে না। আর নদীর গতিও খুব। দু'জনেই ভেসে যায় নদীর জলে, স্রোতের টানে।
অন্যান্য জীবজন্তু তাদের চিরশত্রু দুই রাজা মরে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
এদিকে সকাল হল। রূপচাঁদের পরিবারের লোকেরা রাজার কাছে রূপচাঁদের মৃতদেহ চাইল সৎকারের জন্য। রাজা লোক পাঠালেন বনে। তারা জঙ্গলে সেই স্থানে গিয়ে তো অবাক। রূপচাঁদ বেঁচে আছে! কেউ তার শরীরে আঁচড় পর্যন্ত দেয়নি! তারা তাড়াতাড়ি তার বাঁধন খুলে ঘোড়ায় চড়িয়ে রাজার দরবারে হাজির করল।
রাজা সব শুনে তো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অবশেষে বললেন, ধন্য রূপচাঁদ! বুদ্ধিতে তুমি বৃহস্পতি! সত্যিই তুমি অভাবে পড়ে অপরাধ করেছিলে! কিন্তু মৃত্যুর মুখে পড়েও যে তুমি বুদ্ধি হারাওনি এটাই তোমার সেরা কৃতিত্ব। যাক তোমার বুদ্ধিটা যাতে ভালো কাজে লাগাতে পারো তার জন্য আমি তোমায় রাজদরবারে সম্মানীয় কাজ দিচ্ছি। যথার্থ মাসোহারা দেব। যাতে তোমার দারিদ্রতা দূর হয়।
রূপচাঁদ ছুটে গিয়ে রাজার পায়ে ধরে বলল, মহারাজ, আপনার কথা আমি মাথায় তুলে নিলাম। যতদিন বাঁচব আমার বুদ্ধি সৎ কাজেই লাগাব।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ ১৪১৬ (জানুয়ারি ২০১০)
Topic : ছোটোদের সামাজিক গল্প, Bengali social story, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, বুদ্ধিমানের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ