Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ঢাক ঢাক গুড় গুড় ।। মধুমিতা ঘোষ



ভোরবেলায় ঢাকের আওয়াজে বিতানের ঘুম ভেঙে গেল। ছোটকাকুর তখনও মৃদু মৃদু নাক ডাকছে। বিতানের ঘরটা দোতলার কোনার দিকে। কড়িকাঠওলা খুব বড়ো ঘড়। খাটটাও খুব উঁচু। কাল রাতে ছোটকাকু চোখ নাচিয়ে বলেছিলেন, দেখেছিস একে বলে জমিদার বাড়ির পালঙ্ক।

পুজোতে ছোটকাকুর সঙ্গে বিতান বাহাবপুর এসেছে। জায়গাটা বর্ধমানের মেমারি থেকে 5 কিলোমিটার দূরে এখানে ছোটোকাকুর বন্ধু পীযূষকাকুদের জমিদার বাড়ি। কাল রাতে খাবার সময় পীযুষকাকু বলেছিলেন, পুজোয় আগের মত রমরমা নেই। তবু পুজোটা যে প্রায় দু'শো বছর ধরে চলে আসছে এটাই বড়ো কথা।

বিছানা থেকে বিতান সন্তর্পনে নামল। তারপর বাথরুমে গিয়ে চটপট মুখে-চোখে জল দিয়ে এল।

বিতান ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ফ্লাটের এক চিলতে বারান্দা থেকে যা দেখে তাই আঁকে। কোথাও বেড়াতে গেলেও ছবি আঁকার সরঞ্জাম সঙ্গে করে নিয়ে যায়। সেজন্য আলাদা একটা ছোটো ব্যাগ আছে। বিতান নিচে নেমে পায়ে-পায়ে উঠোনের ধারের দিকে এগোল। ইস! কি সুন্দর শিশির ভেজা ঘাসের ওপর শিউলিফুলের রাশি পড়ে আছে। প্রায় ওর বয়সি দুজন ছেলে-মেয়ে সাজি ভরে কুড়োচ্ছে। বিতানকে দেখে হেসে বলল, ও তুমি কাল রাতে কলকাতা থেকে এসেছ, না?

বিতান ঘাড় নাড়ল। মেয়েটি বলল, আমি মাম আর ও আমার জেঠুর ছেলে জয়।

জয় বিতানের হাতে ড্রয়িং কপিটা দেখে বলল, দেখি কি এঁকেছিস?

বিতান লাজুক হাসি হেসে বলল, এটা নতুন কপি। এখানকার সব ছবি এই কপিতে আঁকব বলে এনেছি।

জয় বলল, চল তোকে তাহলে কুয়োতলার ওখানে নিয়ে যাই। ওখান থেকে সবকিছু দেখতে পাবি।

বিতান এর আগে কখনও কুয়ো দেখেনি। দড়ি বাঁধা বালতি নামিয়ে অদ্ভূত কায়দায় একজন লোক জল তুলে তুলে ড্রামে ভরছে। কুয়োতলার পাশে বসে পড়ল বিতান। চটপট ওর ব্যাগ থেকে আঁকার সরঞ্জাম বার করে ছবি আঁকতে শুরু করল। মাম আর জয় হাঁ করে দেখতে থাকল কেমন করে পেন্সিলের টানে ফুটে উঠেছে কুয়োতলা, ভাঙ্গা আস্তাবল, গোশালা, বট গাছের শিকড় ছড়ানো দেওয়াল। বরাবরই আঁকার সময় বিতানের হুঁশ থাকে না। হঠাৎ কানে এল সুরেলা কন্ঠস্বরে কেউ গাইছে-

গিরি এবার উমা এলে

আর পাঠাব না।

বলবে বলবে লোকে মন্দ,

কারো কথা শুনবো না।

মাম বলল, চলো বোষ্টমী এসেছে। এখন গান শুনবে চলো।

ঠাকুরদালানের বোষ্টমী খঞ্জনি বাজিয়ে গান করছে। অনেকে বসে রয়েছেন। বিতানকে দেখে বড়ো কাকিমা হেসে বললেন, এরকম আগমনী গান কলকাতায় শুনতে পাস?

বিতান ঘাড় নাড়ল। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে বেরোল। ইতিমধ্যে বিতানের সঙ্গে রণি, চাঁদ, গোবিন্দ, রিয়াদিদি আর রুবিদিদির সঙ্গেও ভালো ভাব হয়ে গেছে। সবাই পূজা উপলক্ষেই এ-বাড়িতে এসেছে। ওরা ঘুরে ঘুরে নাট্যমঞ্চ, দোলমঞ্চ, অতিথিশালা দেখল। গুমঘরটা দেখিয়ে পীযুষকাকু বললেন, এই গুমঘর নিয়ে বহু ঘটনা আছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না।

তবে পরে আমার দাদুর বাবা গুমঘরটা মাটি ফেলে বন্ধ করেও দেন।

ফিসফিস করে রণি বলল, জানিস রাতে এই গুমঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। আমি নিজের কানে স্পষ্ট শুনেছি।

কথাটা শুনেই বিতানের গা-টা ছমছম করে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পীযূষকাকুদের কুলদেবতার মন্দিরে চলে এল। পূজো উপলক্ষে মন্দিরটা রং করা হয়েছে। ভিতরে অষ্টধাতুর রাধাগোবিন্দের মূর্তি। চমৎকার দেখতে। পীযুষকাকু বললেন, একসময় মন্দিরের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে বিরাট উৎসব হত। রীতিমতো মেলা বসে যেত। পুরো গ্রামের লোক তো বটেই, আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন এসে পাত পেড়ে খেয়ে যেত।

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখন সবই গেছে। জাস্ট নমো নমো করে পুজোটা হয়।

বিতান সময় পেলেই কপিতে স্কেচ করে নিচ্ছে। সপ্তমীর রাতে কতরকমের বাজি পোড়ানো দেখল। আবার হবে নবমীর রাতে। অষ্টমীর দিন ওরা সবাই মিলে ক্যানেলের ধারে গেল। চারিদিকে কাশফুল ফুটে আছে। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবি। পীযূষকাকুর দাদা অনীষ জেঠু বললেন, এখানে আগে জলের খুব কষ্ট ছিল। চাষ ভালো হত না। আমার দাদু ছিলেন স্বর্গীয় মনাথনাথ ঘোষচৌধুরী। উনি খুব প্রজাবৎসল ছিলেন। উনি নিজের খরচায় দুর্গাপুর থেকে খাল কাটিয়ে বাহাবপুর পর্যন্ত এনেছিলেন।

বিতান জমিদার বাড়ির কথা যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে। অষ্টমীর দিন রাতে ধুনুচি নাচ দেখল। এখানে বিতান প্রতিদিন ভোরবেলায় বেরিয়ে রণি, জয়, মাম আর রিয়াদিদির সঙ্গে পুজার ফুল তোলে।

আজও বেরিয়েছিল। হঠাত রিয়াদিদি চেঁচিয়ে বলল, দ্যাখ দ্যাখ মন্দিরের গেটের তালা ভাঙা। মন্দিরের দরজাটাও তো খোলা দেখছি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওরা মন্দিরের মধ্যে ঢুকল। রাধাগোবিন্দের মূর্তি উধাও। রণি ঠাকুরমশাইয়ের ঘরে ধাক্কা দিতে লাগল। ইতিমধ্যে কেউ ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে খবর দিয়ে এসেছে। নিমেষের মধ্যে যে যেমন অবস্থায় ছিলেন ছুটে এলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পর ঠাকুরমশাই দরজা খুলেছেন। তবে দেখে মনে হয় তিনি ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। অথচ প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি মন্দিরের কাজে লেগে যান।

সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে স্থানীয় থানায় খবর দেওয়া হল। মুখে-মুখে মূর্তি চুরির খবরটা ছড়িয়ে যায়। তাই গ্রামের লোকজনও একে-একে ভিড় জমাতে থাকে। মিনিট কুড়ির মধ্যে ওসি দু'জন কনস্টেবলকে নিয়ে চলে এলেন। প্রথমে বিতানদের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা জেনে নিলেন। তারপর ঠাকুরমশাইকে জেরা করতে শুরু করলেন।

ঠাকুরমশাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন, কাল ধুনুচি নাচ দেখে ফিরছিলাম। ঠাকুর স্নান করাতে হবে বলে বেশ ভিড়ও ছিল। তা একজন ঢ্যাঙাপাড়া ঢাকি এসে বলল, ঠাকুরমশাই আপনি তো রোজ আফিম সেবা করেন। তো আমাদের একটু দ্যান ক্যানে। আমরাও একটু প্রসাদ পাই। আর একজন বলল, ঠাকুরমশাই আমাদের কাছেও জব্বর আফিম আছে। এক খানদানি বাড়িতে ঢাক বাজাতে গিয়ে পেয়েছিলাম। নেশার জিনিসে দোষ নাই। একটু খেয়ে দেখেন ক্যানে।

ওসি বললেন, তারপর?

ঠাকুরমশাই হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি লোভ সামলাতে পারলাম না দারোগাসাহেব।

ঢাকিদের খোঁজ করা হল। দুজন ঢাকি রয়েছে। আর ওদের সঙ্গে একজন ছেলে আছে। ও কাঁশি বাজায়। তারা অঘোরে ঘুমিয়ে। বাকি দু-জন উধাও। ওদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, ওরা পাঁচজন-ই এক গ্লাস করে কোলড্রিংকস খেয়েছিল। ব্যাস আর কিছুই মনে নেই।

ওসি গম্ভীর মুখে বললেন, ঢাকিদের কোথা থেকে এনেছিলেন মনীশবাবু?

পীযূষকাকুর দাদা মনীশজেঠু বললেন, আসলে প্রতিবছর যারা আমাদের বাড়িতে ঢাক বাজাতে আসে তাদের একজনের অশৌচ চলছে, আর একজন পা ভেঙে বসে আছে। তাই পঞ্চমীর দিন সকালে ওই দুজন ঢাকিকে বর্ধমান স্টেশন থেকে এনেছিলাম। আর এরা আমার দিদির বাড়িতে পুজো-আচ্চায় ঢাক বাজায় বলে আনা হয়েছে।

ওসি বললেন, ছবি আছে নিশ্চয়ই ওদের।

পীযূষকাকু বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ কারো মোবাইলে তো থাকবেই। এর-ওর মোবাইল ঘেঁটে দেখা গেল, অনেক ফটোই তোলা হয়েছে। কাল ধুনুচি নাচের ছবিও আছে। কিন্তু ঢাকিদের ছবি একজনের মোবাইলেও নেই। শুধু অনীশজেঠুর ছেলে দীপদাদার মোবাইলে আছে। কিন্তু পুরো ধোঁয়ায় ঢাকা তাই ভীষণ অস্পষ্ট।

ওসি বললেন, কী আশ্চর্য দেখুন! এত ছবি তুলেছেন অথচ ঢাকিদের ছবি নেই।

এমন সময় বিতান লাফিয়ে উঠে বলল, আমার কাছে আছে। তারপর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একছুটে দোতলার ঘর থেকে ওর ড্রইংকপিটা নিয়ে এল। ওসি পাতার পর পাতা উল্টে ছবিগুলো দেখতে থাকলেন। তারপর বিতানের পিঠ চাপড়ে বললেন, বাহঃ এই বয়সেই এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারো? ঠিক আছে, এর মধ্যে থেকে ঢাকিদের ঢাক বাজানোর ছবি আর গাছের তলায় গামছা পেতে ঘুমানোর ছবি দুটো আমি নিচ্ছি। অসুবিধে নেই তো?

বিতান  ঘাড় নাড়ল।

ওসি যাবার সময় বললেন, চিন্তা করবেন না। ফটো যখন পেয়ে গেছি, বাছাধনেরা ধরা পড়বেই। এই ঘটনার পর পুজো বাড়ির আনন্দ উচ্ছাস এক নিমিষে যেন উবে গেল। শুধু পূজার নিয়ম-কানুন মেনে পুজো হতে থাকল। দিদা, বড়োকাকিমা, জেঠিমারা তো ঘন ঘন চোখের জল মুছছেন। নবমীর দুপুরে মস্ত একটা কুমড়ো বলি দেওয়া হল। কিন্তু সবই নিয়ম মাফিক। রাতে বাজি পুড়লনা। চারিদিকে শুধু হা-হুতাশ আর আলোচনা।

হঠাৎ দশমীর দিন বেলা দশটা নাগাদ খবর পাওয়া গেল, আসানসোল স্টেশনে বামাল সমেত ঢাকি দুজন ধরা পড়েছে। সবাই আনন্দে হৈ, হৈ করে উঠল। মনীশজেঠুর সঙ্গে ওসির চেনা-জানা আছে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ছুটলেন। ফিরে এসে মনীশজেঠু হাত নেড়ে নেড়ে বললেন, ওর মুখে শুনলাম সমস্ত স্টেশন আর বাসস্ট্যান্ডে ওদের ছবি পাঠানো হয়েছিল। এমনকি কিউরিও শপগুলোকে পর্যন্ত অ্যালর্ট করে দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকিরা একটা ঢাক ফাঁসিয়ে তার মধ্যে মূর্তিটা রেখে দিয়েছিল বড়ো গামছা দিয়ে ঢাকটা বেঁধে দিব্যি কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিল। পুজোর সময় ঢাকিদের দেখে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিলও না। আসানসোল স্টেশন থেকে বেরোনোর মুখে ব্যাটারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এখন বাছাধনরা আসানসোলের শ্রীঘরে। আর মুর্তি জামা আছে থানায়। এখন আর আসানসোল থেকে আমাদের মূর্তিটা আনতে যেতে হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনীশজেঠু, পীযূষকাকু আর ছোটকাকু গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। ফিরলেন বিকেলের আগে। তখন সে কী হুল্লোর! শাঁখ,উলু আর ঘন্টার আওয়াজে কান পাতা দায়। এদিকে, দুর্গা ঠাকুরের বিসর্জনের বাজনার সঙ্গে বাজি পোড়ানো শুরু হল। হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেল।

সন্ধ্যের ট্রেনে তুলে দেবার জন্য স্টেশনে দলবেঁধে অনেকে এসেছিল। বিতানের ব্যাগটাও নানা গিফটে ভর্তি। ওর আঁকা ছবির জন্য যে মুর্তি চোরদের এত সহজে ধরা সম্ভব হয়েছে একথা বিতান সবার মুখে শুনেছে। মুখে লজ্জার ভাব দেখালেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছে। বিতান জানে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মা, বাবা আর ছোটকাকু বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেন।

বিতান শোবার ঘরে বিছানায় বসে গিফট প্যাকেটগুলো খুলছিল। হঠাৎ কানে এল, ছোটকাকু বলছেন, আসল অষ্টধাতুর মূর্তিটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। ওটা ওদের ব্যাঙ্কের লকারে রাখা আছে। যদিও এ কথাটা ওদের ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া আর কেউ জানে না। গতকাল পীযূষ চুপিচুপি আমায় বলল বলে জানতে পারলাম। বিতান কথাটা শুনে চমকে গেল। গিফটগুলো আগের মতো ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতে দিতে ভাবল, ছিঃ ছিঃ একটা নকল মূর্তি উদ্ধারে ওর ভূমিকা নিয়ে এতক্ষণ ও গর্ব করছিল। স্কুল খুললে পুরো ঘটনাটা বন্ধুদের বলবে বলে মনে মনে লাফাচ্ছিল। নিমেষের মধ্যে ওর খুশির বেলুনটা চুপসে গেল। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর মনে হল, হোকনা মূর্তিটা নকল। কিন্তু নকল বলে তো কোন রকম অবজ্ঞা ছিল না। ওদের বাংলা বইতেই তো পড়েছে, নকল বুঁদির কেল্লা রক্ষা করার জন্য কুম্ভ প্রাণ দিয়ে বীরের মর্যাদা পেয়েছিল। তাহলে বিতানের কৃতিত্বটা কম কীসের?

বিছানা থেকে নেমে থেকে বিতান গিফট-এক প্যাকেটগুলো আবার বের করে খুলতে থাকল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৯

Topic : রহস্য গল্প, পুজোবাড়ির গল্প, একটা ছোটো ছেলের গল্প, Mystery story, The story of the house of worship, The story of a little boy

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ