Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

রথের মেলায় গিয়ে ।। মানিক রায়


 


গল্পটা বাবার মুখে শোনা। আগে প্রতিবছরই রথের দিন বাবা গল্পটা শোনাতেন। রথের দিন এলেই মনে হত এই বুঝি বাবা গল্পটা বলতে শুরু করবেন। বছর কয়েক হল কেন জানি না গল্পটা আর শোনান না। মেয়ের জন্য রথ কিনতে গিয়ে মনে পড়ে গেল। এসো, সেই গল্পটাই আজ তোমাদের বলি-

আমি আর নীলকন্ঠ রথের মেলায় যাবার পরিকল্পনা করতেই আমাদের সঙ্গে জুটে গেল বৈদ্যনাথ, জগৎ, অনাদি আর বাসুদেব।বিকাল হতে না হতেই দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আজকের দিনের মতো তখন ঘরে ঘরে রথ চালানোর রেওয়াজ ছিল না। অনেকগুলো গ্রামের মাঝে একটা বড়ো রথ বেরুত। রথ উপলক্ষে মেলা বসত। সেই রথ আর রথের মেলাকে ঘিরে কত মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা। বছরের এই দিন দুটোর জন্য আমরা প্রতীক্ষায় থাকতাম। সোজা রথ আর উল্টোরথ। ছোটোবেলায় তো উল্টোরথ বলতে বুঝতাম রথটা উল্টে চালানো হবে। কেমন করে হবে? এই প্রশ্নটা মনের মধ্যে কৌতুহল বাড়িয়ে দিত। পরে যখন বুঝতে পারলাম যে, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সোজা রথে মাসির বাড়ি যায় আর উল্টোরথে বাড়ি ফেরে, তখন যে কি হাসি পেত।

আকাশে সূর্যটা ঢলে পড়েছে। আমরাও মেলায় চলে এসেছি। হালকা সুরে ভক্তিগীতি, বাউল, ভাটিয়ালি গানের  সঙ্গে-সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কিছু ঘোষণাও চলছে। ঘোষণার বেশিরভাগটাই জুড়ে থাকত উমুক জায়গা থেকে উমুক এসেছেন, আপনার জন্য উমুক আমাদের কার্যালয়ে অপেক্ষা করছেন। আমরাও যেতাম  আমাদের নামটা মাইকে শোনার জন্য মিছিমিছিই বলতে। মেলায় নাগরদোলার ক্যাঁচোর-ক্যাঁচ, ঘড়োশ-ঘড়, ভেঁপুর প্যাঁ-প্যাঁ, শাঁখ-কাঁসরের আওয়াজ আর কত মানুষের যে হৈ-চৈ! সব মিলিয়ে জমজমাট মেলা। কত দূর-দূরান্ত থেকে আমতার জোনতীর এই মেলায় মানুষের সমাগম হয়। কত চেনা মানুষ, প্রিয়, আত্মীয়-কুটুমের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত এই মেলায়। এই মেলার আভিজাত্যই আলাদা।

নীলকন্ঠ বলল, এই অনিল চল না আলুর দম খাই। কষা আলুর দমের যা গন্ধ! সত্যিই লোভ সামলানো গেল না। আলুর দম খাওয়ার পর ভেঁপু কেনা, নাগরদোলা চড়া হল। রথের মেলায় গেলাম আর ভেঁপু কেনা হবে না! দলবেঁধে ভেঁপু বাজিয়ে গ্রামে ফেরার আনন্দই ছিল আলাদারকম। গ্রামের মানুষকে তো জানাতে হবে আমরা মেলা থেকে ফিরছি। মেয়েরা মেলা থেকে কিনত পুতুল, খেলনা, কাচের চুড়ি, ঠাকুরের মূর্তি, থালা-গেলাস এমনি আরো কতকিছু। মা-মাসিমারা কিনতেন সংসারের কত দরকারি জিনিসপত্র। আমি বললাম, কিরে মেলায় এলাম আর পাঁপড় ভাজা খাওয়া হবে না? কথাটা সবার মনে ধরল। কিন্তু পকেট হাতড়ে পয়সা এক-করে দেখা গেল সকলের একটা করেও পাঁপড় হবে না। আসলে নাগরদোলা চড়ার সময়ই আমরা একটু বেহিসেবি হয়ে পড়েছিলাম।

এমন সময় জগৎ চেঁচিয়ে উঠল, মাস্টারমশাই! আমরা সবাই চমকে উঠলাম। তখনকার দিনে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যাওয়া মানে কে-কোথায় লুকোই এমনি একটা ভাব মনের মধ্যে কাজ করত। কিন্তু যখন দেখলাম পঞ্চাননবাবু, তখন আমাদের আনন্দটা বেড়েই গেল।

পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের মহিষামুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। খুব মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। যেমন তাঁকে দেখতে, তেমনি তাঁর ব্যবহার। কোনোদিন কোনো ছাত্রের গায়ে হাত তো তোলেনইনি, এমনকি তাঁকে বকাবকি করতেও শুনিনি কখনো। মিষ্টি গলায় তিনি আমাদের সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। পড়াশুনোর ফাঁকে-ফাঁকে তিনি শোনাতেন কতরকমের গল্প। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের আদর্শের কথা, মানুষের মতো মানুষ হবার কথা। কেমন করে যেন তিনি আমাদের মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতেন। আমরা অবাক হয়ে যেতাম এই ভেবে যে, আর মাস্টারমশাইয়েরাও আমাদের ভালোবাসেন, স্নেহ করেন, কিন্তু পঞ্চাননবাবু যেন তাঁদের সকলের থেকে আলাদা।

আমরা কিছু বলে ওঠার আগেই উনি এগিয়ে এসে বললেন, কিরে, তোরা মেলা কেমন ঘুরছিস? আমরা বললাম, ভালো মাস্টারমশাই। গ্রামের আর যেসব বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে ছিল না উনি তাদেরও খোঁজ নিলেন। তারপর বললেন, আমাকে তোদের সঙ্গে মেলা দেখতে নিবি নাকি? মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে আমাদের মাথা লুকোবার জায়গা পাচ্ছিলাম না। মাস্টারমশাই-ই আমাদের হাত ধরলেন। কিন্তু ভাগ্যদেবী বুঝি এ বিষয়ে তেমন প্রসন্ন ছিলেন না। তিনি আমাদের জন্য আরো ভালো কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

আকাশটা কখন যেন মেঘে মেঘে সেজে উঠেছে। গুরুম-গারুম গর্জনে অনেকক্ষণ ধরেই চোখ রাঙাচ্ছিল। আমরা তেমন আমল দিইনি। আসলে এরকম দিন তো বছরে রোজ-রোজ আসে না। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালিপনায় চিরকাল তো মানুষকে হারতে হয়েছে, আমরাও তার শিকার হলাম সেদিন। হঠাৎ  শোঁ-শোঁ শব্দে ধুলো উড়িয়ে ধেয়ে আসতে থাকল ঝড়। বুকের ভেতরটা যেন রথের চাকার ঘড়াশ-ঘড়াশ শব্দ অনুভূত হতে থাকল আমাদের। মাস্টারমশাই বললেন, ভয় নেই, সামনেই আমার বাসা। জোরে ঝড় ওঠার আগেই পৌঁছতে পারব বোধহয়। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতেই তিনি বললেন, আমার মা তোদের দেখে খুব খুশি হবেন। আর দেরি করিস না। জোরে পা চালা।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছবার আগেই আমাদের ধুলো মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছিল ঝড়-বৃষ্টি। আধো জানালা খুলে মাসিমা যেন আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে মাষ্টারমশাইকে বললেন হাত পা ধোয়ার জল আনতে, নিজে নিয়ে এলেন গামছা। তারপর যা দিলেন তাতে আমাদের সংকোচবোধে আপত্তিই ছিল, কিন্তু মাসিমার আদর মাখানো বকুনিতে আমাদের আপত্তি টিকল না। আমাদের চাপা হাসির উচ্ছ্বাস ঘরের বাঁধ ভেঙে বাইরেটাও প্লাবিত করে তুলছে বুঝেও আমরা হাসি থামাতে পারছিলাম না। মাসিমার দেওয়া মাস্টারমশাইয়ের বড়ো-বড়ো জামা-প্যান্টগুলো আমাদের চাষের জমির কাকতাড়ুয়া বানিয়ে দিল। অনাদি বলল, কাকতাড়ুয়াই তো? নাকি তালপাতার সেপাই রে? আমার হাতগুলো এ্যাইয়া বড়ো-বড়ো, প্যান্ট তো হাফেরও বেশি গুটোনো।

মাসিমা মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে নিয়ে এলেন একটা বড়ো গামলায়। আচারের তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি জিভে জল এনে দিল। একটা বড়ো থালায় পাঁপড় ভাজা নিয়ে এসে মাষ্টারমশাই দাঁড়ালেন মাসিমার পাশে অবাধ্য ছেলের মতো। মাসিমা বললেন, তোমাদের লজ্জার কিছু নেই। তোমাদের মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি মানে তোমাদেরই বাড়ি। নাও খেয়ে নাও। বৈদ্যনাথ বলল, মাস্টারমশাই আর আপনি? কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মাসিমা বললেন, মাস্টারমশাই তো তোমাদের সঙ্গেই আছেন। নাও খেয়ে নাও দেখি এবার।

মুড়ি খেতে খেতে দেওয়ালে টাঙানো দুটো ছবির দিকে চোখ পড়ল আমাদের। টাটকা রজনীগন্ধার মালায় সাজানো দুটি ছবি। ছবি দুটি কাদের আমরা জিজ্ঞাসা করতেই মাস্টারমশাই যেন অপ্রস্তুতে পড়লেন। মাসিমা বললেন, উনি তোমাদের মাস্টারমশাইয়ের বাবা, আর ইনি মাস্টারমশাইয়ের আপন মা। আমরা একে অন্যের দিকে তাকাতে থাকলাম। মুহূর্তে নিস্তব্ধতা ঘিরে ফেলল ঘরটা। মাসিমা বললেন, আমিও মাস্টারমশাইয়ের মা। ওর জন্মদাত্রী মা ছোটোবেলাতে মারা যাওয়ার পর আমি এ বাড়িতে এসে আমার এই ছেলেকে পেয়েছি। নাও তোমরা খেয়ে নাও। বলে চোখ মুছতে-মুছতে উনি ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

অপরাধীর মতো আমাদের মুখগুলো শুকিয়ে গেল। মাস্টারমশাই বললেন, কী হল? তোরা এমন চুপ করে গেলি কেন? জানিস, আমার ওই ছবির মাকে আমি যখন হারিয়েছি তখন আমার জ্ঞান হয়নি। যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই এই মাকে মা বলে জেনেছি। আমার কখনোই মনে হয় না যে, ইনি আমার মা নন। মায়ের ভালোবাসাতেই আমার লেখাপড়া শেখা, বড়ো হওয়া। আজও মা আমাকে সেই ছোট্ট ছেলের মতো ভাবেন। আমি কোনো ভুল কাজ করলে শুধরে দেন।

সেদিন মাস্টারমশাইয়ের কথাটা তেমন ভাবে মনের মাঝে দাগ কাটেনি। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে ভাবি, এমন মা কজন হয়! সব ঘরে সন্তানদের আগলে রাখতে যদি এমন মায়েরা থাকতেন! সন্তানরাও যদি এমনই করে মা-বাবার ভালোবাসায় কৃতজ্ঞ থাকত!

ঝড় বৃষ্টি থামার পর বাড়ি ফেরার কথা বলতেই মাসিমা বললেন, তোমরা আজ থেকে যাও। মাস্টারমশাই তোমাদের বাড়িতে খবর দিয়ে আসছেন। আমরা অনেক কাকুতি-মিনতি করে তবে ছাড়া পেলাম। মাসিমাকে প্রণাম করার সময় বললেন, একদিন সবাই বাড়িতে জানিয়ে সকাল-সকাল চলে এসো। খুব আনন্দ করা যাবে। বাইরেটা তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। শুনশান রাস্তাঘাট দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই যে, কিছু আগেই এই রাস্তায় লোকে-লোকারণ্য ছিল। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে কোথাও-কোথাও, দু-একটা ব্যাঙ গান গাইতে শুরু করেছে ততক্ষণে। টর্চ হাতে মাস্টারমশাই এগিয়ে দিয়ে গেলেন আমাদের।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শ্রাবণ ১৪১৫

 

Topic : Feeling story, Children story, chariot fair story, Teacher's story, অনুভবের গল্প, ছোটোদের গল্প, রথের মেলার গল্প, মাষ্টারমশাইয়ের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ