Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

দোকা ।। মানসী গঙ্গোপাধ্যায়

 

 


খোলা জানলায় আকাশ দেখছিল লোটন। দৃষ্টিতে ভাষা নেই। জীবনটা তার থমকে গিয়েছে আচমকা বাবাকে তেমন তার মনেই পড়ে না। মাথার ওপর থেকে মায়ের স্নেহভরা হাত দু'খানি সরে গেল যেদিন, সেদিন থেকেই সত্যিকারের অনাথ হয়ে গেছে সে।

দূর-সম্পর্কের মানদাপিসি লোটনের আনাড়ি হাতে ঘরকন্না দেখে, আর বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

মানদাপিসির ছেলে সতু, লোটনেরই সমবয়সী। সারাটা দিন হাটে-মাঠে-বাটে ঘুরে-ঘুরে, গান গেয়ে-গেয়ে বেড়ায়।

মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যেতে সেই যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে লোটন, আজও অবধি ফিরে আসেনি। খুব ছোট্ট বয়স থেকে ছিল ছবি আঁকার নেশা। মা বেঁচে থাকতে মাস্টার রেখে পড়াশোনা আর আঁকা শেখা দুই-ই চলছিল তার। মা আর নেই, সাধের নেশার মুখে পাথর চাপা দিয়ে শেষ করে দিয়েছে লোটন। পড়ার টেবিলে স্কুল লাইব্রেরীর বই পড়ে রয়েছে, ওগুলো ফিরিয়ে দিলেই লোটনের দায় মুক্তি ঘটে।

দরজা ঠেলে দুদ্দাড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সতু। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁরে তোকে বুঝি ভূতে পেয়েছে? মা'র কাছে শুনলাম, তুই নাকি পড়াশোনা শিকেয় তুলে দিয়েছিস? মামি নেই বলে, তুই ভেবেছিস, তোর কোনো গার্জেন নেই? উত্তেজনায় কাঁপছে সতু।

শান্ত স্বরে উত্তর দিল লোটন, একজন অনাথ ছেলের এইসব বিলাসিতা মানায় না।

রাগে ফেটে পড়ল সতু। দু' চড়ে তোমার সবখানা দাঁত ফেলে দেব। বদমাশ কোথাকার!

সতু যেন কাশছে একটু একটু। কাশতে-কাশতেই চেঁচাল আবার, আমি তাহলে মালকড়ি কামাচ্ছি কার জন্য? অ্যাঁ? এই যে, এই নে। বলতে-বলতে এ-পকেট সে-পকেট থেকে মুঠো-মুঠো টাকা বের করে ছড়াতে লাগল টেবিলের ওপর।

বিচ্ছিরি কাশছে সতু। ঠাণ্ডা লাগিয়েছে বেশ।

এসবের মানে কি সতু? লোটন শুধোল ভয়ে-ভয়ে।

উত্তরটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সে।

মেলায়, হাটে, এখানে-ওখানে-সেখানে, গ্রামে-গঞ্জে মেলার মাঠে ম্যারাপ বেঁধে, টিকিট বেচে, লোকগীতি-পালাগানের আসর মাতিয়ে দিব্যি পয়সা কামাচ্ছে সতু। গানের একটা দলও বেঁধেছে সে।

মা মারা যাবার পরে এই প্রথম চোখের জলে ভাসল লোটন। সতুর হাত দু'খানা ধরে।

দিন যায়। মানদাপিসির গৃহস্থালীতে সূর্য ওঠে। চাঁদ হেসে যায়। ফুল ফোটে। পড়াশোনার ফাঁকে-ফাঁকে চিত্র সাধনায় বিভোর হয়ে থাকে লোটন।

সতুর কাশিটাই কেবল সারছে না কিছুতে। সন্দেহ দানা বাঁধে ক্রমে। আজ বেশ ক'টা দিন সতু ঘর ছেড়ে বেরোতে পারে না। গায়ে জ্বর। সর্বাঙ্গে বেদনা। ঘরেই শুয়ে-বসে থাকে। আর খুব-খুব কাশে। ওর দলের ছেলেরা মাঝেমধ্যে ওকে দেখা দিতে আসে, দুই হাত উপুড় করে টাকা-পয়সা দিয়ে যায় তাকে।

শেষে একদিন ধরা পড়ল সতু লোটনের কাছে। কাশতে-কাশতে বালিশ, বিছানার চাদর, মশারি কাঁচা রক্তে মাখামাখি করে ফেলল সে।

লোটনের বই-খাতাপত্র আরো একবার বাক্সবন্দী হল। পথে নেমে দাঁড়াল সে। অনির্দ্দিষ্ট ভবিষ্যতের পরোয়ানা নিয়ে। হাতে তার রঙ-তুলি-ক্যানভাস। আর বুকভরা প্রত্যয়। মনের মধ্যে দৃঢ় সংকল্প। ওরই জীবনটা গড়ে দিতে গিয়ে যে বন্ধু আজ মরণাপন্ন, যে কোনো মূল্যে তাকে বাঁচিয়ে তুলতেই হবে।

শুরুটা তার সুখের হল না মোটে। অনেকেরই তা হয় না। জীবনের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনীটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। আর তাইতেই মুখ থুবড়ে না পড়ে হঠাতই একজন রবার্ট ব্রুশ হয়ে উঠল সে। নিয়তি তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করছে। লোটন তাকে গ্রাহ্য না করে নিজের সাধনায় মগ্ন হয়ে রইল।

কথায় আছে, ফরচুন ফেবারস দ্যা ব্রেভ। লোটনের ক্ষেত্রেও এ-কথার ব্যতিক্রম ঘটল না। একাগ্র সাধনায় সুফল পেতে লাগল সে, একটু-একটু করে। তরুণ চিত্রকর স্কুলছাত্র শ্রীমান ললিত মোহন মণ্ডল, ওরফে লোটনের সুখ্যাতির ঢক্কানিনাদ পৌঁছে গেল দূর থেকে বহুদূরে।

স্কুলের হেডমাস্টারমশাই একদিন ডেকে পাঠালেন লোটনকে। তার হাতে ধরিয়ে দিলেন স্কুলের পরিচালন মণ্ডলীর নির্দেশনামা। স্কুল ক্যাম্পাসে একখানা একক চিত্র প্রদর্শনীর হুকুম হয়েছে তার। হেডমাস্টারমশায়ই লোটনের মাথায় হাত রেখে আদর করে বললেন, লেখাপড়াকে অবহেলা করে সরস্বতীর আরাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না ললিত। প্রদর্শনী সেরে নিয়ম করে ক্লাসে আয়। আমার কথার অবাধ্য হোসনে।

এমন একটা সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল শ্রীমান ললিত মোহন। খ্যাতির পথে লক্ষ্মীলাভ ঘটল তার।

তারপরে একদিন গ্রামের সবচাইতে বড়ো ডাক্তার এলেন সতুকে দেখতে। ওষুধ এল, পথ্যি এল, ঝুড়ি ভর্তি করে ফল এল সতুর জন্য।

লোটন তালপাতার হাতপাখাটা নিয়ে বসে গেল রোগীর সেবা করতে।

সতু কেঁদে বলল, পড়াশোনাটা ছেড়ে দিলি লোটন? মামির যে কত স্বপ্ন ছিল রে তোকে নিয়ে!

স্মিত হেসে জবাব দিল লোটন, পড়াশোনা ছেড়ে দেব? বাশ রে! তুই যদি দু'চড়ে আমার মুখের সব ক'খানা দাঁত ফেলে দিস, আমি তাহলে কী করে খাব রে সতু? না খেয়ে যে মরেই যাব।

সতু লজ্জা পেল খানিক। চোখের জল মুছে অস্ফুটে বলে উঠল, ভ্যাট, বদমাশ কোথাকার!­­

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বৈশাখ ১৪১৮ (এপ্রিল ২০০৯)

 

Topic : Friendship story, Children story, ছোটোদের গল্প, প্রগাঢ় বন্ধুত্বের গল্প, অনুভবের গল্প, Feeling story, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ