Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মায়াজাল ।। মানব মণ্ডল


 


তোমরা নিশ্চয়ই নদীর কথা শুনেছ, বা পড়েছ বইয়ের পাতায়। এখানে একটা নদী আছে, যে আঁচল পেতে সারাদিন ধরে গল্প বলে। তাই এখানে অকারণে কথা বলা বারণ। নদীর পাড় থেকে নামতেই একটা রোগা-সোগা খাল। তার পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে পথ। আমাকে দেখে বোধহয় পছন্দ হল না। তাই প্যাঁক-প্যাঁক করতে-করতে জলে নেমে পড়ল হাঁসগুলো। সর্দি-কাশি লাগবার তোয়াক্কা না করে খালি ডুব মারছে পানকৌড়িটা। একটা ব্যাঙ কী একটা মতলব নিয়ে তিরিক করে লাফ মেরে মিলিয়ে গেল ধানক্ষেতে। এটাই কমলির গ্রাম।

, তোমরা তো কমলিকে চেনই না। ও খুব ছোটো বয়সে কাজে এসেছিল আমাদের বাড়ি। তবে তোমাদের মতো ও অন্ধকারকে ভয় পেত না। মা ছাড়া থাকতেও ওর কষ্ট হত না। আমাদের বাড়ির মেজবৌ তো বিশ্বাস করতে পারেনি, অতটুকু মেয়ে অত কাজ করতে পারে। তবে সেজজন ভীষণ রাগারাগি করল চাইল্ড লেবার রাখবে না বলে।

চাইল্ড লেবার কী? তোমরা জানো কি? আসলে তোমাদের তো এটা স্কুলে যাওয়ার বয়স। এ বয়সে দুষ্টুমি করবে, আইসক্রিম খাবে, খেলাধুলা করবে। কিন্তু এই বয়সে কমলি কাজে এসেছিল বাড়ির লোক খেতে পাচ্ছিল না বলে। এটা তো কমলির ওপর অন্যায় করা হচ্ছিল, তাই না? তবে তারপর থেকেই তেরো বছর ধরে ও এ বাড়িতে কাজ করে চলেছে।

জানো, কমলি নিজের গ্রামে খিচুড়ি স্কুলে পড়েছে। খিচুড়ি স্কুল কী তাও তো তোমরা জানো না। অভাবে পড়ে গ্রামের ছেলেমেয়েরা যাতে কাজে না গিয়ে খিচুড়ির লোভে স্কুলে পড়তে যায় তাই খিচুড়ি খাওয়ানো হয় বলেই এই নাম।

এ বাড়ির ছোটো মেয়ে ছুটকি, ওকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করাল। খুশিতে তো কমলির মা গ্রাম শুদ্ধু মানুষকে শুনিয়ে বেরিয়েছিল।

ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওদের পাড়ার বণিক বাড়ির মেজ ছেলের সঙ্গে। ইংরেজি জানা মেয়েকে পেয়ে ওরা হাতে চাঁদ পেল।

মেয়ের বিয়ে, খরচ-খরচা তো কিছু থাকেই। এ বায়না নিয়েই কমলির মা সেদিন ঘুরে  গেল আমাদের বাড়ি থেকে। বাড়ির মধ্যে একটা চাপা আলোচনা, কানাঘুষো হতে লাগল। এমনকি সানাই আর সেজটার ছোটো মেয়ে, যেটা এক্কেবারে গাছপাকা বুড়ি। সেও বলল, বড়ো জেঠু যখন চাকরি ছাড়ল তখন অফিস থেকে কত টাকা, উপহার পেল। তা কমলি যখন কাজ ছাড়ছে ওই-বা টাকা পাবে না কেন?

জানো, সানাইয়ের জন্মদিনে এবার পাপ্পিকে আনা হয়েছে। ওর বড়ো গা-ঘেঁষা স্বভাব। গলায় একটুও জোর নেই। খালি  ক্যাঁও ক্যাঁও করে, আর সারাদিন খালি লাফালাফি। সবার কোলে ওঠার জন্য ব্যস্ত। অসভ্য একেবারে। আমি অবশ্য ওর সঙ্গে মিশি না।

কমলি তো বাড়ির মেয়ের মতোই ছিল। তাই ভালো কিছু তো দিতেই হবে। এটা শুনেই ঝগড়াঝাটি শুরু হল। তিলকে একেবারে তাল করতে ওস্তাদ সেজটা। আসলে এতদিনে ওর আশ  মিটল।

প্রোমোটারকে দিয়ে দেওয়া হবে আমাদের বাড়িটাও। ইস! বিল্টু, পাপন, টুকাইদের আর কোনো খেলার জায়গা থাকবে না। স্কুলে যা পড়ার চাপ। দেখে খুবই কষ্ট হয়। জানো, মাকেও ওরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে বলেছে। তারপর ছুটকির বাড়িতে থাকবে বলে ঠিক হল। বাবানের কি মজা। দিদানের কাছ থেকে রোজ গল্প শুনতে পাবে।

কপালটা পুড়ল আমারই। সেজটা বলল, কমলির সঙ্গে এই নাক বোঁচা বুড়ো বুলডগটাকেও বিদায় কর। কমলি আমাকে নিয়ে এল ওর বাড়িতে। ওর মা, বোন আমাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। পাড়া-পড়শির সঙ্গে দেখলাম একটা মুরগি ছানা-পোনা নিয়ে আমাকে দেখে গেল।

বড়ো হয়েছি। ওরা বুঝতে চাইল না আমার কথা। ক'দিনই বা বাঁচব। নুন-ভাতে রাখলেই হবে। কমলির চিন্তা, আমি মাংস-ভাত ছাড়া খেতে পারি কি না!

কমলির বড়ো মায়া। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, রাজা, আমরা বড়ো গরীব। তবুও মাছ দিয়ে তোকে খেতে দিলাম। কষ্ট করে খেয়ে নে। আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। জীবনে প্রথম কারোর মুখ চেঁটে দিলাম। কমলি আমাকে জড়িয়ে ধরল। একটা ডাহুকের পিছু-পিছু তার বাচ্চাদুটো বোধহয় স্কুল থেকে ফিরছিল। আমাদের কাণ্ড দেখে ওরাও থমকে দাঁড়াল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

 

Topic : Wonderful Children & Kids Feeling story in Bengali, অনুভবের গল্প, জীবজন্তুর গল্প, বোধের গল্প, পোষ্যদের গল্প, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকার গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ