![]() |
আমার একমাত্র মামা, স্বনামধন্য পল্টুমামা একটা মূর্তিমান অঘটন। যে কাজে হাত দেবে সেখানে কোনো না কোনো অঘটন ঘটবেই। আমরা সেই পল্টুমামার পাল্লায় পড়েছি। আমরা মানে আমাদের এই ছোটো মফস্বল শহরের আমরা তরুণ স্পোটিং ক্লাবের সদস্যরা। আর এর জন্য দায়ী আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি ফটিকচন্দ্র।
একদিন আড্ডা দেওয়ার সময় আমি মুখ ফসকে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান করার কথা বলতেই অধীর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, যা বলেছিস অন্তু। আমরা শুধু খেলাধুলাই করি, এটা আমাদের একটা নতুন কিছু করা হবে। অন্য সকলে একযোগে তা সমর্থন করে কীভাবে তা করা যায় সে বিষয়ে তখনই আলোচনা শুরু হল।
নবীন বলল, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান যখন, তখন শহরের একজন লেখককে প্রধান অতিথি করতে হবে। রফিক বলল, তা তো অবশ্যই। অন্তু তুই উপস্থাপনায় থাকবি আর একটা কবিতা আবৃত্তি করবি। রফিকের কথা শেষ হওয়া মাত্রই অধীর বলল, আমি কিন্তু বক্তৃতা দেব। ওর কথা শুনে আমরা সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ফটিক বলল, তুই জীবনে কোথাও কোনোদিন বক্তৃতা দিয়েছিস?
ফটিকের কথা শুনে অধীর কিছুটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, অত খবরে তো তোদের কোনো দরকার নেই। অনুষ্ঠানের দিন দেখিস কেমন বক্তৃতা দিই। আমাদের যেন আর তর সইছিল না। তখনই অনুষ্ঠানসূচি ঠিক করা হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে কোনো গায়ক না থাকায় এবং বাইরে থেকে গায়ক আনতে গেলে খরচের ব্যাপার তাই গান রাখা হল না। আর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের বহর পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই অনুষ্ঠান দীর্ঘ করার দিকেও গেলাম না। কয়েকজনের আবৃত্তি, একজনের বক্তৃতা, প্রধান অতিথি ও সভাপতির ভাষণ, এই হল আমাদের অনুষ্ঠানসূচি। প্রধান অতিথি হিসেবে কাকে আনা যায় তা ঠিক করার জন্য আমরা তিনদিনের সময় নিলাম।
এই তিনদিন আর ক্লাবের দিকে যাইনি। তাই কারও সঙ্গে দেখাও হয়নি। তৃতীয় দিন সকালে ফটিক আমাদের বাড়িতে হাজির। এর মধ্যে আমি প্রধান অতিথি হিসেবে মনে মনে একজনের নাম ঠিক করে রেখেছি। আমি সে প্রসঙ্গ তোলার আগেই ফটিক বলল, অন্তু প্রধান অতিথি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
কে সে? আমি প্রশ্ন করলাম।
পল্টুমামা প্রধান অতিথির দায়িত্ব নিয়েছে।
পল্টুমামার কথা শুনে আমি আঁতকে উঠে বললাম, বলিস কীরে! পল্টুমামা দায়িত্ব নিয়েছে। আবার কোনো অঘটন না ঘটায়। ঠিক সময়ে প্রধান অতিথিকে নিয়ে হাজির হলে হয়। তা মামাকে এ দায়িত্ব দিতে গেলি কী জন্যে?
মামা কি আমাদের ক্লাবের সদস্য যে তাকে দায়িত্ব দিতে যাব। কাল সকালে মামার সঙ্গে দেখা হতেই মামা বলল, তোরা নাকি রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠান করবি? তা প্রধান অতিথি কাকে করবি? আমি বললাম, এখনো ঠিক হয়নি। আমার কথা শুনে মামা বলল, ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি বললাম, মামা, প্রধান অতিথিকে কিন্তু একজন লেখক হতে হবে। আমার কথা শুনে মামা একটু রেগে বলল, সে আর তোকে শেখাতে হবে না। তুই কি ভেবেছিস রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠানে তোদের এই পল্টুমামা লোহা-লক্কড়ের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি চটপটিরাম ফুচকাওয়ালাকে প্রধান অতিথি করে আনবে? তোকে ওসব ভাবতে হবে না। আমার একজন খুব চেনা-জানা লোক আছে, ভালো লেখক। শুধু ও-ই নয় ওরা তিন পুরুষ ধরে লেখক। তার যাতায়াতের খরচ তোদের দিতে হবে না। ও খরচ আমার। তোরা শুধু একটু ভালো নাস্তার ব্যবস্থা রাখিস। আর আমি বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকব, কিন্তু কোনো বক্তৃতা দেব না। কেবল মাইকে আমার নামটা ঘোষণা করিস।
ফটিক থামতেই আমি প্রশ্ন করলাম, কে সে ব্যক্তি যারা তিন পুরুষ ধরে লেখক। আর মামা বিশেষ অতিথি হবে কেন, সে লেখক নাকি?
কে সে ব্যক্তি তা তো জানি না। আর মামা বিশেষ অতিথি হলে ক্ষতি কী? মামা তো একেবারে হেলাফেলারও লেখক না হোক, শহরের বিখ্যাত ইলেভেন জয়ান্টাস ফুটবল ক্লাবের একজন খেলোয়ার তো।
অনুষ্ঠানের জন্য ছোটোখাটো একটা মঞ্চ তৈরি করেছিলাম। মঞ্চের পেছন দিকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দুটো ছবি টাঙানো হয়েছিল। অধীরের মামার দোকান থেকে নামমাত্র টাকায় দু'ঘণ্টার জন্য মাইক ভাড়া নিয়েছিলাম।
নির্দিষ্ট সময়ে ফটিক আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই নে, এতে প্রধান অতিথির নাম লেখা আছে। নামটা দেখে আমার তো ভিরমী খাবার জোগাড়। বগলা বরণ বর্মন। ''পাখি পাকা পেঁপে খায়'' বাক্যটা বলার মতো প্রধান অতিথির নাম বলাটাও আমাকে ঘন্টাখানেক ধরে প্র্যাকটিস করতে হবে।
একটু পরে মামা যাকে নিয়ে অটোরিক্সা থেকে নামল তার পোশাক দেখে মনে হল, তার বাড়ির কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো লন্ড্রি নেই এবং ওই এলাকার কারও বাড়িতে কোনো ইলেকট্রিক আয়রনও নেই। শার্টটা বোধহয় দীর্ঘদিন কোনো পোঁটলার মধ্যে সযত্নে রক্ষিত ছিল। প্যান্টটার অবস্থাও অথৈবচ। তবে প্যান্টটার ঝুলের সঙ্গে আমেরিকার প্রাক্তণ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যে প্যান্ট পরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সেটার মিল আছে। এসব দেখে আমার মন খুঁত খুঁত করছিল তা দেখে তৈয়ব বলল, এ নিয়ে মন খারাপ করিস না। কবি-সাহিত্যিকরা পোশাকের ব্যাপারে একটু উদাসীন থাকে। ছবিতে আইনস্টাইনের পোশাক-আশাক দেখিসনি? আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, আইনস্টাইন মোটেই কোনো কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না।
মাইকে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ও সভাপতির নাম ঘোষণা করলাম তাদের আসন গ্রহণের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। ফটিকচন্দ্র ক্লাবের সেক্রেটারি। কাজেই, সে এই অনুষ্ঠানের সভাপতি। দর্শকদের অধিকাংশই আমাদের ক্লাবের ছেলেরা। দর্শকের সংখ্যা ও অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে আমাদের অনেকের দাদু, নানুকে আসতে অনুরোধ করেছিলাম। এমনিতেই তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত। কোনো কাজকর্ম থাকে না তাঁদের। তাই তাঁরা যদি এসে বসেন তো দর্শকাসন পূর্ণ হয়। কিছু ছোকড়াও এসে ভিড় জমালো।
অনুষ্ঠানের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতা আবৃত্তির জন্য নবীন মাইকে এল। নবীন আবৃত্তি করার পর আর কিছু মনে করতে পারল না। তখন সে জামা-প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগল। এই ফাঁকে মাঝখান ও পেছনের সারির দর্শকরা খুব একচোট হাততালি দিয়ে দিল। এরপর আমি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করলাম, আসলে আমার ওই কটা লাইনই মুখস্ত ছিল। হঠাৎ ফটিক আমার কানে কানে বলল, রফিক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। আমি একটু ক্ষুব্ধ হলাম, গাইবে মানে, বলা নেই কওয়া নেই অমনি...!
ও নাকি পনের দিন ধরে রেওয়াজ করে শিখেছে।
কী আর করার আছে! মাইকে রফিকের নাম ঘোষণা করলাম। কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই ''সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে...'' গানটা গাইল, না আবৃত্তি করল কিছু বোঝা গেল না। অবশ্য তাতে প্রচুর হাততালি পড়ল। প্রথম সারির দর্শকরা বোধহয় হাততালির পক্ষপাতি ছিলেন না, তাই তাঁরা নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলেন। তাঁদের অনেকের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে দর্শক হিসেবে তাঁদের আসনগুলো অলংকৃত করে রাখার এতটুকুও ইচ্ছে তাদের নেই। শুধুমাত্র চক্ষুলজ্জার খাতিরে উঠতে পারছেন না। অধীরের বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল, ক্লাসে স্যার ওকে তোমার প্রিয় কবি রচনাটা ধরেছেন, আর ও পয়েন্ট টু পয়েন্ট মুখস্ত বলে যাচ্ছে।
এবার মাইকে প্রধান অতিথিকে বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ জানাতেই তিনি উঠে এসে জোরে জোরে বার দুয়েক মাউথপিসে ফুঁ দিলেন। আর অমনি মাইক অকেজো হয়ে গেল। অপারেটর সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এই সুযোগে সবার দর্শক আসন ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম শুরু হল। ঠিক তখনই আমি তাদের কাছে গিয়ে কিছু টিফিনের ব্যবস্থা আছে, সেটা গ্রহণ করার জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানালাম।
ফিরে গিয়ে দেখলাম মাইক অপারেটর তার গোটাতে শুরু করেছেন। কি আর করা যায়! প্রধান অতিথি মাইক ছাড়াই বক্তৃতা শুরু করলেন। তাঁর বক্তৃতা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মনে হল এবার যদি অনুষ্ঠান শেষ না করি, তবে নির্ঘাত জুতো, ইট-পাটকেলের বারিষ হবে স্টেজে। তাই তড়িঘড়ি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলাম।
দর্শকরা সব চেয়ার-টেয়ার উল্টে হট্টগোল করতে করতে চলে গেল।
প্রধান অতিথি হতভম্ভ হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। হঠাৎ স্থানীয় পত্রিকার লম্বা চুলওয়ালা সাংবাদিক তাঁর পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা তো তিন পুরুষ ধরে লেখক। তা আপনারা এখন পর্যন্ত কটা বই বেরিয়েছে?
প্রধান অতিথি বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি লেখক। তবে আমি কবিতা, গল্প, উপন্যাস এসব কিছু লিখি না, যে আমার বই বেরবে। আর তাছাড়া বই লিখে কি আমার পেট চলবে? আমি দলিল লিখি, আমি দলিল লেখক।
একথা শুনে আমরা সবাই শুধু হাঁ করে তাকিয়েই থাকলাম। ততক্ষণে পল্টুমামা সেখান থেকে হাওয়া।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
Topic : Funny story, children story, Laugh story, মজার গল্প, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানের গল্প, হাসির গল্প, ছোটোদের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ