![]() |
তিতিল পাঁচ বছরের মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। সরস্বতী বিদ্যামন্দিরে কেজি টু'তে পড়ে। পড়াশোনায় তার খুব মনোযোগ। সুকুমার রায়ের প্রায় সব ছড়াগুলো সে মুখস্ত বলতে পারে। ''বোম্বাগড়ের রাজা'' তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
এইতো সেদিন রাতে শুতে যাওয়ার সময় মা বলল, তুই শোবার ঘরে যা। আমি একটু রান্না ঘরটা গুছিয়ে আসছি। শুতে গিয়ে তিতিল বোম্বাগরের রাজা ছড়াটি পড়ছিল। হঠাৎ তার সামনে সুকুমার রায় এসে হাজির।
সুকুমার তিতিলের মাথায় হাত বুলিয়ে ছড়া কেটে বলেন, তিতিল খুব মিষ্টি মেয়ে, দুষ্টু তো নয় মোটে / আমার ছড়া পড়ে তিতিল, হাসে রাঙা ঠোঁটে।
তিতিল একরাশ খুশির আমেজে আপ্লুত হয়ে ওঠে। স্বয়ং সুকুমার রায় তাকে নিয়ে ছড়া বানিয়েছেন।
এরপর সুকুমারই তিতিলকে বলেন, বলো, তুমি আমার কাছে কি চাও?
তিতিল বলে, বোম্বাগড় কি সত্যিই আছে?
সুকুমার বলেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই আছে।
তিতিল বলে, আপনি আমাকে একটিবার বোম্বাগড়ে নিয়ে যান না!
সুকুমার এরপর সত্যিসত্যিই তিতিলকে বোম্বাগড়ে নিয়ে গেলেন।
তিতিল সেখানে দেখে- সত্যিই বোম্বাগড়ের রাজা ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্ব ভাজা বাঁধিয়ে রাখে। হ্যাঁ, সেখানের রানির মাথায় সত্যিই অষ্টপ্রহর বালিশ বাঁধা থাকে। সে এও দেখে- রানির দাদা পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে। কারো সর্দি হলে, সেখানে সত্যি সত্যি সবাই ডিগবাজি খায়। তারপরে সে একে-একে সবটাই দেখতে পায়- যা যা ছড়াটিতে লেখা আছে।
বোম্বাগড়ের এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ দেখে তিতিল ভাবে- এখানের সবার কি মস্তিষ্ক বিকৃত! তার মনের প্রশ্ন ছড়াকারকে করতে তিনি ছোটো তিতিলকে বলেন, মানুষের কিছু ব্যতিক্রমী ক্রিয়াকলাপ দেখলেই তাকে মস্তিষ্ক বিকৃত বলে আখ্যা দেওয়া উচিত নয়। আসলে বোম্বাগড়ের রাজা সবসময় চায় তার প্রজারা আনন্দে থাকুক, সুখে থাকুক। তাই তিনি ওসব কার্যকলাপ করে থাকেন।
আসলে ওনার ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ধার। তাহলে তোমাকে একটা ঘটনা বলি। একদিন পিসির সঙ্গে যখন রাজা কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলছিল, তখন হঠাৎ এক বৃদ্ধ গোছের চাষা এসে রাজাকে নতজানু হয়ে বলল, হে রাজন! আমি ধান বিক্রি করা টাকায় আমার পত্নীর জন্য এক সেঁকরার কাছে গয়না বানিয়েছিলাম। সেই সেঁকরা আমার আসল টাকার বিনিময়ে নকল গয়না দিয়েছে। আপনি এর প্রতিকার করুন।
রাজা বললেন, আগামীকাল তোমার পত্নীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আমি তোমাদের একটা বুদ্ধি দেব। দেখবে তাতেই কাজ হবে।
পরেরদিন চাষা তার পত্নীকে রাজার কাছে নিয়ে এলে রাজা তাদের চুপিচুপি একটা পরামর্শ দেয়। আর সেই পরামর্শকে সফল করতে তাদের কিছু টাকা-কড়িও দেয়।
রাজার বুদ্ধি শুনে তারা দুষ্টু সেঁকরাকে নিমন্ত্রণ করে। সেঁকরা ভয়ে ভয়ে নিমন্ত্রণ খেতে আসে। কিন্তু সে ভাবে, আমি তো ওদের ঠকিয়েছি। আর, ওদের এত ঘটা করে আমাকে নিমন্ত্রণ খাওয়ানোর মানেটা কি! সেঁকরা তখন জানতে চায়, কীসের জন্য এত ঘটা করে নিমন্ত্রণ?
চাষা আর চাষার বউ দুজনেই বলে, আগে তো খাওয়া-দাওয়া হোক, তারপর না-হয় কারণটা জানানো যাবে।
এলাহি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লুচি, মাংস, বরফি, পানতোয়া, দই, মিষ্টি। কোনোটারি অভাব রাখেনি চাষা দম্পতি।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সেঁকরার স্ববিস্ময়ে জিজ্ঞাসা, এবার আসল কারণ বলো তো তোমরা?
চাষার বউ সেঁকরাকে বলে, শুনুন তাহলে, আমরা এক সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটা গরু পেয়েছি। যার থেকে আমরা যখন খুশি ইচ্ছে মতো দুধ, ঘি, মাখন পাই। সেই গরুটির কথা রাজার কানে পৌঁছতে, রাজা আমাদের অনেক টাকা দিয়েছেন গরুটি নেওয়ার জন্য। তাই সেই টাকা দিয়ে ভাবলাম আপনার মতো গুণী সেঁকরাকে একটু নিমন্ত্রণ করে খাওয়াই।
সেঁকরা বলে, সত্যিই তাই আবার হয় নাকি?
চাষার বউ বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে যান না, গোয়ালে গিয়ে দেখে আসুন। ঘরা-ঘরা সব দুধ, ঘি, মাখন রাখা আছে। আর গরুটির রাজপোশাক দেখেই বুঝতে পারবেন, গরুটি আর পাঁচটা সাধারণ গরুর মতো নয়।
সেঁকরা পরখ করে, চাষা দম্পতি মিথ্যে বলেনি। গরুটিকে পাওয়ার জন্য সেঁকরার তো ভারি লোভ হল। যেনতেন প্রকারে গরুটিকে পেতে চায় সে। নিজের লোভ সংবরণ করতে না পেরে সরাসরি যেকোনো মূল্যে গরুটিকে কেনার জন্য প্রস্তাব দেয়।
চাষা দম্পতি বলে ওঠে, না-না। এখনই রাজপেয়াদা এসে দেখে যাবে গরুটিকে। রাজা রোজ ওদের পাঠিয়ে দুধ, ঘি, মাখন নিয়ে যান। রাজকুমারের জন্মদিনে এই গরুটি উপহার দেবেন তিনি।
এরপর সত্যিই-সত্যিই রাজপেয়াদা এসে গরুটিকে দেখে যায়, আর দুধ, ঘি, মাখন নিয়ে যায়।
সেঁকরার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। সে বলে, এই গরুটিকে আমার চাইই-চাই। গরুটিকে পেতে চাষা দম্পতিকে ১০ ভরি সোনার গহনা দিতে রাজি হয়।
চাষা দম্পতি বলে, তাহলে আপনি একটা কাজ করুন ১০ ভরি গয়নার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের জন্য ভিন গাঁয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। নইলে রাজার কোপে আমাদের অকালে প্রাণ হারাতে হবে।
সেঁকরা তাতে সম্মত হয়ে গেল।
চাষা দম্পতি গরুটি সেঁকরাকে দিয়ে দেয়।
সেঁকরা বাড়ি ফিরে গরুটির অলৌকিক ক্ষমতা পরোখ করতে গিয়ে দেখে সব মিথ্যে। চাষা দম্পতি তাকে বুজরুকি দিয়েছে। তখন রাজার কাছে বিচারের জন্য যায়। আর গিয়ে দেখে, সেই চাষা দম্পতির সঙ্গে বোম্বাগড়ের রাজা 'হুক্কাহুয়া' চিৎকার করে আনন্দ করছেন। সেঁকরার মুখ চুন হয়ে যায়।
ঘুমের ঘোরে তিতিল হাততালি দিতে দিতে বলে ওঠে, বেশ হয়েছে! বেশ হয়েছে! দুষ্টু সেঁকরা জব্দ হয়েছে!
মা এসে তিতিলকে ডাকেন, কিরে তিতিল স্বপ্ন দেখে এসব কি বকছিস!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বৈশাখ ১৪১৬ (এপ্রিল ২০০৯)
Topic : Best children story in Bengali, Wonderful filling story for kids, ছোটোদের গল্প, অনুভবের গল্প, ছোটোদের পত্রিকা চিরকালের ছেলেবেলার গল্প, বোধের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ