আত্মার প্রতিশোধ ।। জয়তী চট্টোপাধ্যায়
![]() |
ওকে সকলে রবার্ট বলেই চেনে। শ্রীলঙ্কায় থাকতে থাকতে ওর ধবধবে ফর্সা রংটা তামাটে হয়ে গিয়েছে। তিনকূলে কেউ নেই। শ্রীলংকারই এক স্থানীয় সাংবাদিকের বাড়িতে পেইং গেস্ট হয়ে থাকে। সে হয়ে গেল প্রায় বছর কুড়ি।
চোরাই হীরে-জহরত সস্তায় কিনে, সুবিধা বুঝে খদ্দের পাকড়াও করে চড়া দামে বিক্রি করেই আজ রবার্টের ব্যবসার এত রমরমা। কলকাতার ফকিরা ওর চিফ এজেন্ট। খোঁজখবর সবই প্রায় ওই আনে।
এবার রবার্টকে ইন্ডিয়ায় পাড়ি দিতে হবে। খোদ কলকাতায়। তারপর ওখান থেকে আন্দামানে। পাসপোর্ট, ভিসা সবই রেডি।
জানুয়ারি মাস। কলকাতায় জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। ফকিরা এয়ারপোর্টে ছিল। সোজা ট্যাক্সিতে চড়ে মানিকতলায়, সৌভাগ্য গেস্ট হাউসে। পথে ফকিরা দুটো মাত্র কথা বলেছে। তিরিশ লাখের মাল তিন কোটিতে বিক্রি করা যেতে পারে, তবে সাবধানে।
সৌভাগ্য গেস্ট হাউসটি চমৎকার। ওদের ১৬ নম্বর ঘর বুক করা ছিল। হঠাৎ ম্যানেজারবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ওটা ভুল করে অন্য লোককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্যার, প্লিজ ১৩ নম্বর ঘরটি ওর থেকে ভালো ছাড়া খারাপ নয়।
অগত্যা। রবার্ট ফকিরাকে নিয়ে নির্ধারিত ঘরে পৌঁছল। গা-টা কি একটু ছমছম করে উঠল। একটা ভ্যাপসা গন্ধ। বহুদিন পরে যেন ঘরটা খোলা হল। দরজা, জানলা খুলতেই রবার্ট বলে উঠল, নট ব্যাড।
ভারী কালো ফ্রেমের চশমা পরা রবার্টের চোখ দুটি অজান্তেই আকর্ষিত হল দেওয়ালে টাঙানো অসাধারণ একটা ছবির দিকে। মনে হয়, কোনো রানি, মহারানি হবেন। এত জীবন্ত ছবি রবার্ট কোনোদিন দেখেনি।
একটু থিতু হয়ে কফি আর হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে ফকিরা চলে গেল। বলে গেল, সন্ধের আগেই মাল নিয়ে আসবে।
রর্বাট ক্লান্ত ছিল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কীরকম নেশাগ্রস্ত হয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। লাঞ্চ খাবে না বলাই ছিল। ফকিরা এল সন্ধে ছ-টা নাগাদ। শীতের সন্ধে, অন্ধকার অনেক আগেই ঘনিয়ে এসেছে।
ফকিরা পকেট থেকে রুমাল বের করে খুলতেই হীরেগুলো ঝলমল করে উঠল। রবার্ট হীরের কাটিং দেখে বলে দিতে পারে ওগুলোর দাম কত হতে পারে। তবু ও হাতে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত এক শিহরণ। ওর মনে হল হীরেগুলো কোথায় যেন দেখেছে। পঁচিশটি হীরে। বিভিন্ন সাইজের।
ফকিরাকে ওর পাওনা টাকার অর্ধেক দিয়ে বিদায় করল রবার্ট, বাকিটা বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরে। ডিনার ঘরেই দিতে বলল।
পরদিন ভোরেই আন্দামানের ফ্লাইট। সারারাত একটা অশরীরী কিছুর যাওয়া-আসা রবার্টকে ঘুমোতে দিল না। আন্দামানে পোর্ট ব্লেয়ারে যখন নামল, তখন বেলা প্রায় বারোটা। আদিগন্ত বিস্তৃত নীলসমুদ্র। রবার্টের ব্যবসায়ী চোখও মুগ্ধ হয়ে গেল। রবাটের খোদ্দের আন্দামানের বাসিন্দা। আগে থেকে বুক করা সমুদ্র লজে একটা ক্যাব ভাড়া করে চলে এল।
এখানেও রুম নম্বর ১৩। রবার্ট আশ্চর্য হল, ঘরে ঢুকে আবার চমক। দেওয়ালের সেই মহারানির ছবি। এও কি সম্ভব !
রবাটের খদ্দের বনমালী হালদার। বিশাল হীরে-জহরতের দোকান আন্দামানে। একচেটিয়া ব্যবসা।
খবর দেওয়াই ছিল। বিকেলে এলেন। দামে বনিবনা হল না। ভেবে দেখতে বললেন রবার্টকে। একটু সময় দিলেন।
রবার্ট বনমালী হালদারকে হীরেগুলো দেখিয়ে আবার বালিশের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিল। চুম্বকের মতো চোখ চলে গেল ছবিটার দিকে। আরে! মহারানির গলায় একটা হীরের নেকলেস। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে গুনে দেখল, ঠিক পঁচিশটা হীরে। রবাটের মাথায় ঢুকল না দুটি ভিন্ন জায়গায় গেস্ট হাউসে ১৩ নম্বর ঘরে একই ছবি কী করে এল! ভয়াবহ একটা চিন্তা ওকে গ্রাস করে ফেলল।
খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠল। বালিশ আঁকড়ে ধরে রবার্ট সারারাত তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকল। বনমালী বাবুর দামেই হীরেগুলো বেচে দেবে ঠিক করল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দেখল মহারানি দুহাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। চোখে তীব্র লালসা, ক্রুর দৃষ্টি।
পরদিন ভোরেই ফকিরাকে ফোন করল রবার্ট। হীরেগুলো কার?
স্যার, কোনো এক মহারানির ছিল। উনি মারা যাবার পরে ওঁর স্বামী টাকার প্রয়োজনে ওগুলো বিক্রি করে দেন। তবে শুনেছি, ওই হীরে-বসানো হারটি মহারানির প্রাণাধিক প্রিয় ছিল। মৃত্যুর সময়ও ওটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
তুমি ওর কোনো ছবি দেখেছ?
না তো স্যার।
সেদিন সকালে রবার্ট সমুদ্র লজের লোকজন ডাকিয়ে ছবিটা সরাতে গিয়ে দেখল, দেওয়াল ফাঁকা। আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রবার্ট। এতদিনের জিম করা, সিকস প্যাক বানানো শরীর মুহূর্তে চুপসে যায়।
আপনার দামেই আমি রাজি। আগামীকাল সকালে আসুন। দুপুরের ফ্লাইটে আমি কলকাতা ব্যাক করব। বনমালী হালদারকে জানিয়ে দেয়। প্লেনের টিকিট পাওয়া গেলে রর্বাট চলে যেত।
কলকাতায়, মানিকতলায় সৌজন্য গেস্ট হাউসে ফোন করে জানাল, ১৩ নম্বর ঘরের দেওয়ালে কোনো ছবি নেই।
হাত-পা ভয়ে সেঁধিয়ে গেল রর্বাটের।
সারাদিন হোটেল চত্বরে ঘুরে, রাতে ডাইনিং রুমে
ডিনার সেরে ঘরে ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠল। একটা অজানা ভয় রর্বাটর গলা টিপে ধরল।
লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ল রর্বাট। ঠিক বারোটায় লোডশেডিং। রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িটা দেখল রবার্ট। অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে টর্চ ফেলল দেওয়ালে। সেই ছবি। আকণ্ঠ বিস্তৃত হাসি নিয়ে মহারানি এগিয়ে আসছেন দুহাত বাড়িয়ে তারই দিকে।
রবার্ট সেগুলো বের করে হাতের মুঠোয় ভরে শক্ত করে ধরে রাখল। না, কিছুতেই দেবে না সে। মহারানি তার পায়ের কাছে। তারপর….
পরদিন লোকাল আন্দামান নিউজ পেপারে হেডলাইন। সাগর লজে ১৩ নম্বর ঘরে এক ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু। ডান হাতের মুঠোটি যেন কেউ অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে কেটে নিয়েছে। মৃতের নাম রবার্ট। বাস- শ্রীলংকা। মৃত্যু অবশ্য ভয়ে, হার্টফেল করে।
বনমালী বাবু স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। তন্নতন্ন করে পুলিশকে দিয়ে ঘর সার্চ করালেন। হীরেগুলো গেল কোথায়? চুরির চিহ্নমাত্র নেই... তাহলে?
হঠাৎ নজরে পড়ল দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে। কই! কাল তো ওই ছবিটা ছিল না! মহিলার গলায় হীরের হারটা এত দ্যুতিময় কেন! সারা ঘর যেন আলোয় ঝলমল করছে!
রবাটের আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। ডায়েরি দেখে ফকিরা আর শ্রীলঙ্কায় ফোন করে অনুমতি নিয়ে আন্দামানে কবর দেওয়া হল। অনেক ঝামেলা চুকিয়ে।
সাগর লজে ওই ঘরটা থেকে ছবিটা উধাও হয়ে গেল চিরদিনের মতো। জানল না কেউ মহারানির স্বামী ওই লোভেই খুন করিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর অতৃপ্ত আত্মা শুধু রবার্টকেই মেরে শান্ত হয়নি, দুদিন পরে মহারাজকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাঁর বাড়ি সংলগ্ন বাগানে।
আজও আন্দামানের কবরখানায় রবার্টের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাওয়া যায় রাতের
আকাশে-বাতাসে। দোষ কী তার? সত্যিই কিছু ছিল!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত-চিরকালের ছেলেবেলা । মার্চ ২০১৪
Topic : ভূতের গল্প. ছোটোদের গল্প, গা-ছমছমে গল্প, আত্মার গল্প, Ghost stories, Children's stories, Creepy stories, soul stories
0 মন্তব্যসমূহ