Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হাতি নিয়ে কতকথা ।। দীপালি রায়


আজ তোমাদের প্রথমে একটা প্রচলিত গল্প শোনাই। গল্পটা হয়তো তোমরা অনেকেই শুনে থাকবে। তবু বলছি, কারণ, আজ যাদের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছি তাদের নিয়েই যখন গল্পটা, তখন বলে ফেলার লোভটা যে সামলানো যাচ্ছে না একেবারে।

এখন যেমন স্কুলে পড়াশোনা করো তোমরা, তখনকার দিনে গুরু মশাইয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে হত। এইরকমই এক গুরুর কয়েকজন শিষ্য, মানে ছাত্র ছিল। শিষ্যরা ছিল প্রত্যেকেই অন্ধ। একদিন গুরু মশাই, তাঁর শিষ্যরা কতটা শিক্ষা লাভ করেছে তা দেখার জন্য শিষ্যদের বললেন, যাও তোমরা বাইরে ঘুরে এসো আর ফিরে এসে কী দেখলে তা আমাকে সব গল্প করে জানাবে।

বাইরে ঘুরতে ঘুরতে শিষ্যরা এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। সেখানে একটা হাতি চেন দিয়ে বাঁধা আছে। শিষ্যরা তো চোখে দেখতে পায় না, তাই তারা হাতিকে স্পর্শ করে চিনতে চেষ্টা করল।

একজন হাতির কানে হাত দিল। একজন দিল পায়ে। অন্যজন হাতির শুঁড় ছুঁয়ে দেখল। আর একজন হাতির পেটে হাত বুলাল। এরা সবাই মাহুতকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কী? মাহুত বলল, এটা হাতি। শিষ্যরা গুরু মশাইয়ের বাড়িতে ফিরে এল। গুরু মশাই তখন জিজ্ঞাসা করলেন, এবার বলো তোমরা কী দেখলে? শিষ্যরা বলল, আমরা হাতি দেখেছি। গুরু মশাই প্রথমজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলতো হাতি কেমন দেখতে? সে বলল, লম্বা সাপের মতো, উপর থেকে ঝুলছিল আর খালি দুলছিল। দ্বিতীয়জন সঙ্গে-সঙ্গে বলল, না না, হাতি দেখতে লম্বা থামের মতো। অমনি সঙ্গে-সঙ্গে আরেকজন বলে উঠল, না, মোটেই হাতি ওরকম দেখতে নয়। হাতি দেখতে অনেকটা পাখার মতো। পাখির ডানার মতো ঝাপটাচ্ছিল। অন্যজন বলল, না, গুরু মশাই ওরা কেউই ঠিক মতো দেখেনি। আমি বলছি হাতি দেখতে বিরাট পাথরের মতো। এই নিয়ে তো ওদের মধ্যে ঝগড়া লাগে আর কি! শেষে গুরুমশাই বললেন, তোমরা সবাই ঠিক বলছ আবার ভুলও বলছ। তোমরা আসলে কেউ পুরো হাতিটার গায়ে হাত বুলাওনি। তোমরা এক-একজন একেকটা অংশে হাত বুলিয়েছ মাত্র। যেমন, তোমরা যে বললে হাতি দেখতে লম্বা সাপের মতো সে আসলে হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়েছিলে। আবার যে বলছ হাতি দেখতে লম্বা থামের মতো সে হাতির পাঁ ছুঁয়েছ। আর যে বললে পাখার মতো, পাখির ডানার মতো ঝাপটাচ্ছিল সে হাতির কানে হাত দিয়েছ। অন্যজন বললে যে হাতি দেখতে বিরাট পাথরের মতো ওটা হচ্ছে হাতির পেট আর শরীর। সবশেষে গুরু মশাই বললেন, তোমাদের উচিত ছিল পুরো হাতিটাকে ছুঁয়ে দেখা।

তোমাদের এই গল্পটা এই জন্যই বললাম, যে কোনো জিনিস দেখবে সবসময় সেটাকে পুরোপুরি জানার চেষ্টা করবে নয়তো ওই অন্ধ শিষ্যদের মতো হবে।

হাতি এমন একটি প্রাণী যার প্রতিটা অংশই ভালোভাবে জানা দরকার। তোমরা প্রত্যেকেই হাতি দেখে থাকবে চিড়িয়াখানায়। মোটা মোটা থামের মতো চারটে পা, কুলোর মতো দুটো কান, বিশাল দেহ আর বিশেষত মাথার সামনে লম্বা সাপের মতো শুঁড় দেখলেই বোঝা যায় যে এটা হাতি। অনেক সময় হাতির শুঁড়ের দুপাশে লম্বা সাদা সাদা মুলোর মতো দাঁত থাকে। চিড়িয়াখানায় হাতি তো দেখলে এবার দেখা যাক এই শুঁড়, কান, পা হাতির কী কাজে লাগে?

হাতির পা

প্রথমেই আসি হাতির পায়ের কথায়। হাতির পা একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আগেকার মানুষরা মনে করতেন হাতির ওই সোজা লম্বা থামের মতো পায়ের হাড়ে কোনো জোড়া জায়গা নেই। কিন্তু তা নয়, মানুষ ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে যে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো হাতিরও মালাইচাকি, কনুই, পায়ের গাঁট বা কব্জি, পায়ের আঙ্গুল সবই রয়েছে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, পায়ের গাঁট যেখানে থাকার কথা সেখানে না থেকে আছে কিছুটা ওপরে। হাতির পায়ের আর একটা বৈশিষ্ট্য হল, হাতি আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে হাঁটে বলে আঙুলের হাড়গুলো নিচের দিকে মুখ করা। এটা অবশ্য বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এদের পায়ের পাতা নরম গদির বা প্যাডের মতো ভর করে আছে, যাতে গোটা দেহের ওজন ছড়িয়ে যায়। এই গদি বা প্যাড হাতির ওজন বাড়লে আয়তনের ছোটো এবং হাতির ওজন কমলে তা বেড়ে যায়। ধরো, হাতি পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে তখন হাতির পুরো ওজন গিয়ে পড়বে পিছনের দু'পায়ে তখন ওই প্যাড কমে যায় আর হাতির পা শক্তভাবে মাটিতে থাকে, আর নামার সময় ঠিক তার উল্টোটাই ঘটে। যদি কোনো প্রকারে পা পিছলে যায় কি হবে বলতো? যদিও সেটা সচরাচর হয় না।

হাতির শুঁড়

এবার বলি হাতির শুঁড়ের কথা। এটা হাতির শরীরের সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস যেটা পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর নেই। এই শুঁড় আসলে নিচের ঠোঁট আর নাক মিলে গিয়ে সরু লম্বা হয়ে তৈরি হয়েছে। প্রায় ছ' হাজার বছর আগে হাতির পূর্বপুরুষরা মোটেও এরকম ছিল না। এদের না ছিল শুঁড়, না ছিল বিশাল দেহ। তখন হাতি একটা ছোট্ট প্রাণী ছিল আর নাক একটু লম্বা আর ঝোলা মতো ছিল। পরে ধীরে ধীরে এখনকার হাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। হাতির শুঁড়ে কোনো হাড় নেই বলে কোনো কিছু ধরতে সুবিধা হয়। এই শুঁড় দিয়ে গাছের পাতা বা মাটি থেকে ঘাস বা পাতা এক জায়গায় করে শুঁড়ের নিচে থাকা জিনিস মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।

তোমরা দেখে থাকবে হাতির শুঁড়ে অনেকগুলো ছিদ্র থাকে, এগুলো আসলে নাসারন্ধ্র। এই দিয়েই এরা শ্বাসকার্য চালায়। আবার হাতি এই শুঁড় দিয়েই জলপান করে। হাতির শুঁড় কিন্তু খুব শক্তিশালী। এরা লড়াই করার সময় এই শুঁড়টাই ব্যবহার করে আবার বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি বা ভারী ভারী জিনিস হাতি এই শুঁড় দিয়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। আর একটা কথা জানলে অবাক হবে যে হাতির দৃষ্টিশক্তি প্রখর না হওয়ায় হাতি শুঁড় দিয়ে স্পর্শ করে বুঝে নেয় জিনিসটা কি।

হাতি তো আর কথা বলতে পারে না। ওদের মনের ভাব বোঝাতে ওরা শুড়টাই ব্যবহার করে। কেমন করে? শোনো তাহলে, ওরা শুঁড়ের সাহায্যে জোরে জোরে হাওয়া বার করে, আওয়াজ করে অন্য হাতিদের সঙ্গে কথা বলে। সামনে বিপদ বোঝানোর জন্য হাতি তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে আবার নরম সুরে আওয়াজ করে আনন্দের খবর জানায়।

গরমকালে হাতির স্নান করা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। তোমরা দেখবে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় সিরিঞ্জে যেভাবে ওষুধটা তুলে নেয় হাতিও পুকুরে, জলাশয়ে বা নদীতে নেমে শুঁড়ে করে সেই কায়দায় জল তুলে সারা গায়ে ছিটিয়ে স্নান করে।

হাতির কান

হাতির কানটা আশ্চর্য একটা জিনিস। এদের প্রধান কাজ হল শব্দ শোনা ও মস্তিষ্কে পাঠানো। তোমরা চিড়িয়াখানায় হাতি দেখলে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবে কিছু হাতি আছে যাদের কান একটু ছোটো আর গোলাকৃতি। এরা হল ভারতীয় হাতি। আবার কিছু হাতির কান বেশ বড়ো এবং তিনকোনা, এরা হল আফ্রিকান হাতি। অবশ্য কান ছোটো-বড়োর সঙ্গে শ্রবণ শক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই ছোটো বড়ো হওয়ার কারণ আছে। ভারতীয় হাতির কান ছোটো, কারণ, এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জঙ্গলে থাকে। তাই, বেশিরভাগ সময়ই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। এতে এদের প্রখর সূর্যের তাপ সহ্য করতে হয় না। কিন্তু তৃণভূমি অঞ্চলের হাতিদের এই সুবিধা নেই। শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য হাতির কান বড়ো হয়।

তোমরা হয়তো ভাবছো, শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার সঙ্গে কানের বড়ো-ছোটো হওয়ার কী সম্পর্ক? আসলে হাতির কান ওদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। প্রচণ্ড গরম লাগলে এরা কানের ফ্ল্যাপ (কানের পাতলা চামড়ার মতো অংশ) সামনে-পিছনে নাড়তে থাকে, যাতে শরীরে বা কানের নিচে বাতাস লাগে। এরা কান পুরো খুললে ওদের কান আরও বড়ো দেখায়। একটা আফ্রিকান হাতি কান খুললে তার আয়তন হবে ছ-ফুটের বেশি ও প্রায় তিন ফুট চওড়া। আর ভারতীয় হাতির বেলায় তা হবে একফুট লম্বা ও প্রায় একফুট চওড়া।

হাতির চোখ

এবার আসি হাতির চোখের খবর নিতে। হাতির চোখ ওদের দেহের তুলনায় খুব ছোটো। মানুষের চোখের থেকে সামান্য বড়ো। এদের ছোটো চোখের জন্য অনেকের ধারণা, হাতির দৃষ্টিশক্তি খুব ভালো নয়। এটা কিন্তু একদম সত্যি। বাঘ, সিংহ, শিয়াল, নেকড়ে এদের সবার দূরের জিনিস দেখার জন্য যে ক্ষমতা থাকে তা কিন্তু হাতির নেই। হাতির বিশাল কান তার চেহারার পিছনের দিকে দেখার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। তা বলে তোমরা ভেব না হাতি খুব কম দেখতে পায়। হাতির প্রায় ১৫০ ফুট অবধি কিছুর নড়াচড়া খেয়াল করতে পারে।

হাতির দাঁত

হাতির দাঁত দেখতে যেমন সুন্দর তেমন ভয়ও লাগে। যদি দৌড়ে এসে পেটে ঢুকিয়ে দেয়। না, সে ভয় নেই। হাতির এই দাঁত কে গজদন্ত বলে। হাতির দাঁত আইভরি দিয়ে তৈরি, এই আইভরি ভীষণ দামি। এই আইভরির জন্যই মানুষ হাতির দাঁত সংগ্রহ করে রাখে। এই কারণেই হাতি হত্যা বেড়ে হাতির সংখ্যা পৃথিবী থেকে দ্রুত কমে যাচ্ছে।

এই দাঁত থেকেই সাধারণ পুরুষ হাতি আর স্ত্রী হাতি চেনা যায়। স্ত্রী হাতির দাঁত পুরুষ হাতির দাঁতের তুলনায় অনেক ছোটো। একটা আফ্রিকান পুরুষ হাতির দাঁতের দৈর্ঘ্য হতে পারে সাড়ে ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা, আর তার ওজন প্রায় ২১১ কিলোগ্রাম (একজোড়া)। কিন্তু দেখতে এত বড়ো আর ভারী হলে কী হবে? খাবার গুঁড়ো করে হজম করার কাজে এই দাঁতের কোনো ভূমিকা নেই।

প্রাগৈতিহাসিক হাতির কথা

এবার তোমাদের বলব প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের গল্প। মানে হাতির পূর্বপুরুষের গল্প। অবশ্য এখনকার হাতিদের পূর্বপুরুষ বলাটা পুরোপুরি ঠিক হবে না। কারণ, ওদের সবার থেকে আধুনিক হাতি আসেনি। তোমাদের বোঝাতে গিয়ে বলতে হচ্ছে, হাতিদের পূর্বপুরুষ। আসলে প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের কেউ আর বেঁচে নেই। তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, তাহলে আমরা কিভাবে তাদের কথা জানলাম? তবে শোনো, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে গিয়ে ওই সমস্ত পূর্বপুরুষ হাতিদের কঙ্কাল, হাড়, হাড়ের অংশ পাথরে জীবাশ্ম থেকেই তাদের সম্বন্ধে খুঁজে খুঁজে বার করেছেন।

প্রাগৈতিহাসিক হাতিরা কিন্তু মোটেও এখনকার হাতিদের মতো ছিল না। প্রাচীনতম হাতিরা ছিল ছোট্ট শুকোর বা শুয়োরের মতো। যার নাম মোয়েরি থেরিয়াম। এই মোয়েরি থেরিয়াম-এর আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় পাঁচ কোটি আশি লক্ষ বছর আগে সম্ভবত আফ্রিকায় বা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায়। এরা ছিল আধা জলচর, আধা স্থলচর প্রাণী। এই হাতি প্রাগৈতিহাসিক যুগের অন্যান্য হাতিদের সঙ্গে আধুনিক হাতিদের দু-একটা বিষয় ছাড়া কোনো মিল ছিল না। এদের দেহ ছিল লম্বা ৭০ সেন্টিমিটার, মাথাটা ছিল লম্বা। আর এদের চোখ থাকত নাকের থেকে অনেকটা দূরে। আর তোমরা অবাক হবে এই কথা শুনলে যে, হাতি বলতে আমরা বুঝি লম্বা একটা শুঁড়। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক এই হাতিদের কোনো শুঁড়ই ছিল না। কি মজার ব্যাপার না? তবে এদের নাকের হাড়টা একটু নীচু আর মুখের সামনে অনেকটা এগিয়ে থাকত। এই বর্ণনার একটি পশু যদি তোমাদের সামনে নিয়ে আসা হয় তোমরা কি হাতি বলে মেনে নিতে পারবে বল?

তবে হ্যাঁ, এদের সঙ্গে আধুনিক হাতিদের যেটা মিল ছিল সেটা হল দাঁত। গজদন্ত বলে কিছু ছিল না ঠিকই কিন্তু গঠনগত মিল থাকায় এদের শুঁড়যুক্ত প্রাণীদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয়।

প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের মধ্যে প্রাচীনতম সদস্যের মধ্যে বেশি শুঁড়যুক্ত প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য ছিল তার নাম হল প্যালিওমাস্টোডন, এদেরও আবির্ভাব ঘটেছিল মোয়েরি থোরিয়ামের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় পাঁচ কোটি আশি লক্ষ বছর আগে সম্ভবত আফ্রিকায় বা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায়।

প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের মধ্যে প্যালিওমাস্টোডন, মোয়েরি থোরিয়াম এদের প্রায় একই সঙ্গে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে এবং একসঙ্গে বহু দিন এই পৃথিবীতে ছিল। প্যালিওমাস্টোডন ছিল মোয়েরি থেরিয়ামদের তুলনায় একটু বড়ো। এদের উচ্চতা প্রায় দু-মিটারের মতো হত।

এই প্যালিওমাস্টোডন সবচেয়ে প্রাচীনদের মধ্যে যারা ছিল তাদের নাম ফিওমা। এদের মাথাটা বেশ বড়ো এবং চোয়াল ছিল লম্বা। এই চোয়ালের উপরে থাকত দুটো গজদন্ত, নীচের দিকে বাঁকানো আর নীচের চোয়ালেও দুটো দাঁত সেগুলো কিন্তু সোজা ছিল। এই দাঁতগুলো ছিল ছোটো। এদের একটা ছোটো মাপের শুঁড়ও ছিল।

এখন থেকে প্রায় দু-কোটি বছর আগে ইউরোপে বাস করত হাতির পূর্বপুরুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডাইনোথোরিয়াম। ফিওমাদের মতো এদেরও দুটো বাঁকানো দাঁত ছিল নীচের চোয়ালে। এই দাঁত দিয়ে ওরা মাটির তলা থেকে গাছের শিকড় খুঁজে বার করত। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম-এ এদের মাথার খুলির জীবাশ্ম রাখা আছে। এই জীবাশ্ম দেখলে তোমরা পরিষ্কার বুঝতে পারবে ওরা কি রকম দেখতে ছিল।

এদের কিছুকাল পরে মানে এখন থেকে প্রায় দেড় কোটি বছর আগে হাতির আর এক পূর্বপুরুষের আবির্ভাব ঘটে। এদের নাম মামুট বা আমেরিকান মাস্টোডন। এদের আকৃতি প্রায় এখনকার হাতিদের মতোই। তবে, এদের সারা দেহ বড়ো বড়ো লোমে ঢাকা ছিল। প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের মধ্যে স্টেগোন নামে আর এক ধরণের হাতি ছিল। এদের আবির্ভাব হয়েছিল ৭০ লক্ষ বছরেরও অনেক বেশি আগে। এই ৭০ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ বছরের মধ্যে এদের বেশ বাড়বাড়ন্ত ছিল। ভারতে শিবালিক পাহাড়ের পাথরে এদের জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। এই স্টেগোডনদের মধ্যে একজন সদস্য হল স্টেগোডন গণেশ। এদের দাঁতের দৈর্ঘ্য হত প্রায় সাড়ে চার মিটার। এরা উচ্চতায় প্রায় ৪.২ মিটার। শুঁড়ও ছিল বেশ লম্বা। আর পা-ও বেশ মোটা আর লম্বা।

হিমাচল প্রদেশের সাকেটি ফসিল পার্ক-এ এদের মডেল রাখা আছে। যদি কোনোদিন সুযোগ পাও দেখতে ভুলো না যেন।

প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে তিন ধরণের হাতির আবির্ভাব হয়েছিল। (১) লস্কোডন্টা (২) এলিফাস (৩) ম্যামথ।

লস্কোডন্টা, এরা বর্তমান আফ্রিকান হাতির পূর্বপুরুষ বা বাবাও বলতে পারো।

এলিফাস-এর বর্তমান ভারতীয় বা এশিয়ান হাতির পূর্বপুরুষ বা বাবা। আর ম্যামথ। এই ম্যামথ এবং এলিফাসরা বেশ কয়েক লক্ষ বছর বাদে আফ্রিকা ছেড়ে চলে গেল ইউরোপ আর এশিয়ায়। লস্কোডন্টারা আফ্রিকাতেই রয়ে গেল। তাই এদের বংশধরদের এখনও আফ্রিকাতেই দেখতে পাওয়া যায়।

কালক্রমে এশিয়া ছাড়া সব জায়গা থেকে এলিফাসরা আস্তে-আস্তে মুছে গেল। আর এশিয়ার কোথায় কোথায় এদের দেখতে পাওয়া যায় তা তো  তোমাদের আগেই বলেছি।

ম্যামথরা আফ্রিকা ছেড়ে এশিয়া, ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় চলে এসে বহুদিন রাজত্ব করার পর প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিল। সাইবেরিয়া এবং আলাস্কার বরফে ঢাকা অঞ্চলে এখনও এদের অবিকৃত দেহ পাওয়া যায়। আমরা যেমন ফ্রিজে কাঁচা মাছ-মাংস রেখে বেশ কিছুদিন পর রান্না করে খাই। ওই মাংস পচে গলে যায় না। সেই রকমই বরফের মধ্যে ম্যামথের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এই ম্যমথরা সব প্রেবোসিডিয়ানদের মধ্যে সবচাইতে বড়ো ছিল। এদের দাঁত ছিল খুব বড়ো। প্রায় তিন থেকে পাঁচ মিটার লম্বা আর সামনের দিকে বাঁকানো। এদের মধ্যে উলি ম্যামথরা ঠাণ্ডা অঞ্চলে থাকত ফলে এদের গায়ে বড়ো বড়ো লোম থাকতো। এই ম্যামথরা উচ্চতায় প্রায় কম করে চারমিটার লম্বা হত।

হাতির পূর্বপুরুষের গল্প এতটাই। আসলে প্রাগৈতিহাসিক হাতিদের বর্তমান দিনের হাতির পূর্বপুরুষ বলাটা ঠিক হবে না, কারণ ওদের সবার থেকেই আধুনিক হাতি আসেনি। এটা তোমাদের বোঝানোর জন্য বলতে হয়েছে।

হাতি সম্পর্কে বলতে গেলে হাতির বিশাল দেহের মতোই বড়ো লেখা হয়ে যাবে। অথচ সম্পূর্ণটা না জানলেই নয়। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছেলেবেলার পাতার এই চোখ রাঙানিতে থামতেই হচ্ছে আমাকে। আশা করব, আমার লেখাটি পড়ে নিশ্চয়ই তোমরা হাতিদের সস্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছ, তাহলে এবার সেই জানার জন্য খুঁজতে থাকো হাতিদের সম্পর্কে নানান বইপত্র। এই যেমন আমিই নানান বইপত্র ঘেঁটে তোমাদের জানালাম এতসব কথা, আর যদি কেউ এই লেখার পাঠক আগামীদিনে হাতিদের উপকারের বন্ধু হয়ে যাও তো আমাকে জানাতে ভুলও না কিন্তু। আমি সেই অপেক্ষাতেই চেয়ে রইলাম।

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬, মাঘ ১৪১৬ ও বৈশাখ ১৪১৭ (তিন পর্বে)

Topic : Knowledge of Elephant's, know about elephant, Elephant's story, Elephant short story in Bengali, Speaking of prehistoric elephants, হাতি নিয়ে নানা কথা, হাতি নিয়ে কতকথা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ