Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাড়ি থেকে পালিয়ে ।। দীপালি রায়

বুম্বা আর কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যাবে। রোজ রোজ এ অপমান আর সহ্য হয় না। সে না হয় নেপালদাদুর বাগান থেকে গোটা কতক পেয়ারা পেড়েছে। তা বলে, এত অপমান! আর নেপালদাদুটাই বা কিরকম লোক! বাগানে অত পেয়ারা! কত পেয়ারা তো দেখতেই পায় না কোথায় পেকে আছে। পরে পাখিতে খেয়ে যায়। কই তখন তো পাখিদের মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করে না। তার বেলাতেই যত দোষ! তার বন্ধুরাই বা কি ভাবল, ওদেরকে কত আশা করে ডেকে নিয়ে গেল, আজ জমিয়ে পেয়ারা খাওয়া হবে বলে। ওদের কাছেও তো আর মুখ দেখাতে পারবে না।

আজ সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে বলে বাবা কত কথা শুনিয়ে দিল। বলল, এ ছেলে আর মানুষ হবে না। যত বড়ো হচ্ছে দস্যিপনাও বয়সের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। লেখাপড়া শিকেয় তুলে দিনরাত এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ানো। স্কুল থেকে গার্জেন কল করা হচ্ছে। ''আপনার ছেলে পড়াশোনা তো  করেই না উল্টে ওর জ্বালায় ভালো ছেলেগুলোও দস্যি হয়ে উঠেছে। এরপরও যদি ও না শুধরায়, তাহলে আমরা ওকে টি.সি দিতে বাধ্য হব''। দিদিমণিদের সামনে আমার মাথা নত হল আর উনি বেলা ন'টার সময় ঘুম থেকে উঠছেন। বাবার মান-সম্মানের কোনো চিন্তা আছে ওর। কত ভালো করে বোঝালাম, দেখ বাবা, পড়াশুনো শিখে মানুষের মতো মানুষ হ। দেখবি সবাই কত ভালোবাসে। আমার কি আর সে কপাল। যে এ ছেলে কথা শুনবে, মানুষ হবে।

স্কুলে গিয়েও শান্তি নেই। ইংরেজি দিদিমণি সারা ক্লাস কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল। আমি না হয় পিন্টুর জামায় একটু পেনের কালি লাগিয়ে দিয়েইছি। তো কি হয়েছে। জামাটা কাচলেই তো উঠে যেত। পিন্টু অমনি দিদিমণির কাছে নালিশ করল। টিফিনেও খেলতে পারলাম না। অঙ্ক দিদিমণিও ডাস্টার দিয়ে এমন চড় মারল, কপালটা ফুলে গেল। একটু আস্তে মারা যেত না! ওসব অঙ্ক-টঙ্ক আমার মাথায় যদি না ঢোকে তো আমি কি করব!

স্কুল থেকে ফিরে দেখলাম, মা ঘরে নেই। রাস্তার টাইম কলে জলের জন্য লাইন দিয়েছে। আসতে দেরি হবে। ভাবলাম, যাই বন্ধুদের নিয়ে নেপালদাদুর বাগানটা ঘুরে আসি। সবে মাত্র কটা পেয়ারা পেড়ে ঘরে ঢুকেছি, পেছনে-পেছনে নেপালদাদু নালিশ করতে আসছে কি করে জানবো! তাহলে তো সন্ধের আগে ঘরেই ঢুকতাম না। এমনিতে সন্ধ্যাতেই ঢুকি, কিন্তু আজ খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছিল যে। দাদুর নালিশ শুনেই মা হাতের কাছে কুকুর তাড়াবার লাঠিটা দিয়েই মারতে শুরু করল আমায়। একবারও ভাবল না, আমার খাওয়া হয়নি।

তাই বুম্বা ঠিকই করে নিয়েছে, আর এমুখো হবে না। বেশ অনেকটাই চলে এসেছে। অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটতেও অসুবিধা হচ্ছে। পেটেও ছুঁচো ডন মারছে। হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দেখল, দুটো পেয়ারা আছে। বাকিগুলো মা মারার সময় মনে হয় পড়ে গেছে। যাক, এই দুটোতেই এখন চলে যাবে। একটা গাছের তলায় বসে পেয়ারা দুটো খেল। তারপর বসে বসে ভাবতে লাগল, এবার কোথায় খাওয়া যায়।

হঠাৎ বুম্বার মনে পড়ল আচ্ছা, বাসে উঠে হিরোদিদির বাড়ি গেলে কেমন হয়! হিরোদিদির বাড়িটা ও চেনে। মায়ের সঙ্গে গেছে কয়েকবার। বাসে উঠে বলতে হবে বেলপুকুর নামব। বাস থেকে নেমে পাঁচ-দশটা বাড়ির পরেই হিরোদিদির শ্বশুরবাড়ি। বাসে উঠে ও বসল। বাসটাতে খুব একটা ভীড় নেই। কন্ডাকটর পাশের জনকে টিকিট চাইতে মনে পড়ল, ওর পকেটে পয়সা নেই। কি হবে এখন! কনডাক্টর কাছে এসে পয়সা চাইতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল বুম্বা। বুদ্ধি করে বলল, আমি মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি ফিরছিলাম। হোগলাশী মোড়ে বাস পাল্টাবার সময় মাকে খুঁজে পাইনি। আমার কাছে পয়সা নেই। আমাকে একজন বলল, খোকা ওই বাসটায় উঠে যাও, তোমার বাড়ি পৌঁছে যাবে। তাই উঠে পড়েছি। বুম্বার কান্না দেখে পাশের জন কনডাক্টরকে বলল, ঠিক আছে। ওর ভাড়াটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। বুম্বাকে বলল, কোথায় তোমার বাড়ি? বুম্বা বলল, বেলপুকুর। লোকটা বলল, বেলপুকুরে নেমে তুমি বাড়ি যেতে পারবে এই অন্ধকারে? বুম্বা বলল হ্যাঁ, বাস থেকে নেমে কাছেই আমাদের বাড়ি। কথা বলতে বলতেই বেলপুকুর এসে গেল। কনডাক্টর বেলপুকুর বলে চেঁচাতেই লোকটাকে বলল, কাকু আসছি। ধন্যবাদ।

কিন্তু একি! এটা বেলপুকুর তো নাকি! সব অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। সব শুধু কালো। এখানে অনেক দোকান-টোকান ছিল। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বুম্বা ভাবল, লোডশেডিং হয়েছে বোধহয়। আন্দাজ করে দিদির বাড়ির রাস্তাটা ধরে নিয়ে এগোতে শুরু করল। কিছুটা গিয়েই জলে পড়ে গেল ঝপাং করে। প্রথমে ভাবল, বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমেছে হয়তো। কিন্তু একি! আস্তে আস্তে ও ডুবে যাচ্ছে তো। সাঁতার  বুম্বা জানে, কিন্তু এখন সাঁতার কাটতেও পারছে না। আরে এবার ফেলে আসা দোকানগুলো দেখতে পাচ্ছে সে। সে বাঁচাও-বাঁচাও বলে খুব জোরে চিৎকার করল, কিন্তু গলা দিয়ে একটু আওয়াজ বেরল না। বুম্বা হাবুডুবু খাচ্ছে জলে। একটা লোক এদিকেই আসছে। বাবা, লোকটার কিরকম যেন চেহারা! দেখলে ভয়-ভয় লাগে। তবুও সে যতটা জোরে চেঁচানো যায় চেঁচিয়ে বলল, আমাকে বাঁচাও কাকু। আমি ডুবে যাচ্ছি।

এবার বুম্বার গলার আওয়াজ বেরিয়েছে, লোকটা শুনতেও পেয়েছে। কিন্তু লোকটা অমন করে হাসছে কেন? বুম্বা আবার পিছল। কাকু আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আমাকে এখান থেকে তোলো কাকু। আমি তোমার পায়ে ধরছি। লোকটা কর্কশ গলায় বলল, আমি এমন বাজে ছেলেদের বাঁচাই না। যারা মা-বাবার কথা শোনে না, পড়াশোনা করে নাসারাদিন দস্যিপনা করে বেড়ায় তাদের বিপদে কেউ সাহায্য করে না। তুমি পড়ে থাকো ওখানে। বলে লোকটা চলে গেল। বুম্বা আবার বলল, আমি এরকম করব না। এবারের মতো আমাকে বাঁচাও। আমি মন দিয়ে পড়াশুনা করব। মা-বাবার কথা শুনব। কিন্তু লোকটা আর ফিরেও তাকালো না। খিদে আর বাঁচার লড়াইয়ে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে বুম্বা। খুব জোরে হাত-পা ছুঁড়ে একবার শেষ চেষ্টা করছে বুম্বা।

বুম্বা সোনা, কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? মাকে পেয়ে বুম্বা জড়িয়ে ধরল। মা, আমাকে বাচাও। মা, আমি আর কোনোদিন দুষ্টুমি করব না। মন দিয়ে পড়াশোনা করব। আমাকে বাঁচাও।  বুম্বা ঘেমে-নেয়ে উঠেছে একেবারে। মা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে তোর? রাগ করে বাড়ি থেকে এসে এখানে বসে আছিস কেন? ঝাঁকুনিতে বুম্বা চোখ খুলে দেখল, মা কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, এমন দুষ্টুমি কেন করিস বাবা? স্কুল থেকে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত হয়নি। চল  বাবা, বাড়ি চল। অনেক রাত হয়েছে। আমরা তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি।

তার চারপাশে টর্চ, হারিকেন হাতে লোকজন ভর্তি। বাবা, পাশের বাড়ির রতনকাকু, রঞ্জনকাকু, বিল্লুদাদা, রাতুলমামা সবাই তাকে ঘিরে রয়েছে। আরে নেপালদাদুও এসেছে! মাকে ছেড়ে নেপালদাদুর কাছে গেল বুম্বা। মাথা নিচু করে বলল, দাদু আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কোনোদিন এরকম করব না কিন্তু চাইলে দু-একটা পেয়ারা দেবে তো? তোমার গাছের পেয়ারাগুলো খুব মিষ্টি যে, লোভ সামলানো যায় না।

বুম্বার কথা শুনে সকলে হেসে ওঠে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা ।  শরৎ ১৪১৭

 

Topic :  Children best story, feeling story, little boy story, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকার গল্প, অনুভবের গল্প, ছোটো ছেলের গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ