![]() |
দাদু বোধহয় একটু ঝিমোতে শুরু করেছিল। আমাদের হৈ-হৈ চিৎকারে দাদুর তন্দ্রা গেল ছুটে। একটা পেল্লাই হাই তুলে দাদু বললে, গোল হয়ে বোস সবাই। আজ একটা ভালো গল্প শোনাব তোদের।
সবাই দাদুকে ঘিরে বসলাম। টুনি বলল, দাদু কিন্তু ভূতের গল্প বলতে হবে।
দাদু বলল, ঠিক আছে তাই হবে। শোন তোরা-
আমার শ্বশুর বাড়িতে আমার কিছু ধান জমি ছিল। তোদের দিদা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি দেহ রাখতেই, ওই জমির মালিক হলাম আমরা। তাই ঠিকোতে চাষবাস করতে দিয়ে এলাম। ধানজমি ছাড়াও একটা ছোট বাড়ি আছে, ছোট-খাটো একটা আম-কাঁঠালের বাগান আর একটা পুকুরের চারআনা অংশ রয়েছে।
মাঝে মধ্যেই চাষাবাদ দেখতে ওখানে যাই। গেলে খুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি বেশ খাতির যত্ন করে। একে ভাইঝি জামাই, তার ওপরে জমি-জমা, পুকুর, বাগান সবটাই ওরা নেয়। মাঝে মাঝে শুধু পুকুরের দু-একটা মাছ, গোটাকয়েক আম, কাঁঠাল আর ধান বিক্রির টাকাটা আমায় দেয়।
তখন মাঘ মাস। ধান কাটা, মাড়াইয়ের মরশুম শেষ হতে চলল। এই সময় গেলে একেবারে খদ্দের ডেকে ধান বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পাওয়া যাবে। সোমবার আর শুক্রবার দূর দূর গ্রাম থেকে সাইকেল নিয়ে ধান কিনতে আসে। অনেকটা পথ তাই বেশ একটু রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল ওখানে পৌঁছে যাতে ধান বিক্রি করতে পারি। বিক্রি বাটা শেষ করে আবার ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। ভয়ের অবশ্য কিছু নেই। পথ-ঘাট সব চেনা, তবে মেঠো পথ। খাল-বিল, ধান জমি পেরিয়ে যেতে হয়। মাঝে দু-তিমটে গ্রাম পড়ে। সঙ্গে টাকা-পয়সা থাকবে তো ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাওয়াটাই ভয়ের। অবশ্য গাঁয়ের মোড়লকে বললে লাঠিগাছা নিয়ে সামনের মাঠটা পার করে দিয়ে যাবে। ওই সামনের মাঠটাই একটু বড়ো। মধ্যে একটা খাল পড়ে। লোকে বলে ওটা ভুতের খাল। শীতের দিনেও ওই খালে জল-কাদা থাকে।
কিন্তু মানুষ ভাবে একরকম, আর হয় আর একরকম। ধান বিক্রি বাটা হিসাব-নিকাশ করতে করতে আড়াইটে বেজে গেল। তারপর খুড়িমা জামাইকে যত্ন করে খাওয়াতে বসলেন। খেতে খেতে বেলা সাড়ে তিনটে। খুড়িমা পুকুরে অনেক মাছ-টাছ ভেজে ভাইঝির জন্য প্যাকেট করে দিলেন। বাড়ি থেকে যখন বেরুলাম, তখন প্রায় চারটে বাজে। সামনের মহিমপুর গ্রামটা পার হতেই শীতকালের সূয্যিমামা আমার পানে তাকিয়ে হেসে পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে পড়লেন। পরের গ্রামে শশুরমশায়ের বাল্যবন্ধু দ্বিজু মোড়লের বৈঠকখানা রাস্তার পাশেই। নিত্য যাতায়াত ছিল বলে আমিও মোড়লের খুব আদরের জামাই বাবাজীবন হয়ে গেছিলাম। দেখা হলে রেহাই নেই। বয়স সত্তর পার হয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক গল্প করবেন। তারমধ্যেই ওনার স্ত্রীকে বলবেন, জামাই বাবাজির একটু জল খাবারের ব্যবস্থা করো। ব্যাস হয়ে গেল আর কি। তাই ভাবছি, দেখা না হলেই ভালো হয়।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। বৈঠকখানার সামনে দিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দ্বিজু খুড়ো দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন, কি বাবাজি বয়স হয়েছে, চোখে একটু কম দেখি বলে ভেবেছো আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবে। বয়স হয়েছে, কবে আছি কবে নেই। দেখা না করেই তুমি চলে যাচ্ছ। শশুর নেই বলে কি আমাকে আর...
কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলি, ছি ছি! কি যে বলেন খুড়ো, আপনাদের কি ভুলতে পারি? অগত্যা বসতে হয়। বাড়ির ভেতরেও যেতে হয়। খুড়িমার হাতের মিষ্টি জল খেয়ে যখন বড়ো মাঠটায় নামলাম তখন রীতিমতো সাঝেঁর আঁধার জমে গেছে। পরের দিন আবার অমাবস্যা তিথি।
একটু ভয় ভয় করছিল কারণ সাথে অতগুলো টাকা। খুব জোরে হাঁটছি, ভুতের খালে নেমেছি হঠাৎ ম্যাঁও-ম্যাঁও শব্দে চমকে উঠি। ভাবছি, কাছে পিঠে কোনো গ্রাম নেই। ফাঁকা মাঠে বিড়াল কোথা থেকে এল! এইসব ভাবছি, এমন সময় নাকি সুরে বলে উঠল, এঁই ভাঁজা মাঁছের মুঁড়োটা আঁমায় দেঁ নাঁ খাঁই। একে শীত তারপর এইসব কাণ্ড। আমি ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিলাম। কিন্তু ভয় পেলে তো ওরা আমার ঘাড় মটকাবে। মাছের প্যাকেটটা চেপে ধরে আরো জোরে হাঁটতে লাগলাম। পুরো রাস্তাটাই পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি, আমি কিন্তু ভুলেও পিছনে তাকাইনি। অনেক কষ্টে বাড়ি এসে পৌঁছলাম।
বাড়ি ঢুকে তোদের দিদাকে সব কিছু খুলে বলতেই সে বলল, ওই মাছের মুড়ো দিয়ে দাও ওকে। ও আমি খাব না।
অগত্যা দোর খুলে মাছের মুড়ো সঙ্গে আরো দু'খানা মাছ একটা পাতায় রেখে বাইরে দিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে দেখি কিছু নেই।
পরের দিন সকালে বারান্দায় বসে আছি। সুবল এসে বত্রিশখানা দাঁত বের করে বলল, দাদা কালকে মাছ ভাজা কেমন খেলে? যাই বল দাদা, তোমার শ্বশুরের পুকুরের মাছের স্বাদ-ই আলাদা। যা খেলাম না, যেন অমৃত। অনেকদিন মুখে লেগে থাকবে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চাঁটি মারার জন্য হাতটা তুলতেই সুবল খানিকটা সরে গিয়ে বলল, বারে! তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিল বলে, বৌদি বলল আমাকে একটু এগিয়ে যেতে। একটু দূর থেকে তোমায় দেখতে পেয়ে একটু ভয় দেখাব ভেবেছিলাম। কিন্তু মাছের গন্ধটা পেয়ে ভাবলাম, একটু ভূতের ভয় দেখাই। আর যদি না ভূতের ভয় দেখাতাম, ওই অত বড়ো মুড়োটা আমায় খেতে দিতে?
অলংকরণ-অমর লাহা
প্রকাশিত-চিরকালের ছেলেবেলা । আগষ্ট-২০১১
Tpoic : Story of Ghost in Bengali, Best story of Childrens and kids, Funny ghost story ভূতের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ