Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাঁশিওয়ালা ।। বিপ্লব কুমার দত্ত

লোকটা গাছের তলায় বসে বিশ্রাম করছে। একটা ছেলে খুব হন্তদন্ত হয়ে দৌড়তে-দৌড়তে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখান দিয়ে আমার গরুটাকে যেতে দেখেছ? সাদা গরু, একদম সাদা। শুধু কপালে একটা টিপ। আমি বন্ধুদের সঙ্গে গরু চরাতে এসেছিলাম। গরুগুলোকে ছেড়ে দিয়ে আমরা খেলছিলাম। এখন আমার ধবলীটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

লোকটা নজর করে দেখল, পাঁচ ছয় বছরের একটি ছেলে রঙটা কালো, যেন কষ্টি পাথর কেটে তৈরি হয়েছে। কিন্তু মুখশ্রী খুবই সুন্দর। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়। ছেলেটার কাঁদো-কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটার খুব মায়া হল। বলল, না আমি দেখিনি। তবে তোমার  ধবলীকে আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। এই বলে সে তার ঝুলি থেকে একটা বাঁশি বের করে বাজাতে লাগল।

ছেলেটা এবার অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ও বাঁশিওয়ালা, তুমি পরে বাঁশি বাজাও এখন আমার ধবলীকে একটু খুঁজে দাওনা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হলে আমার মা যে খুব চিন্তা করে। বাঁশিওয়ালা কিছু না বলে সেখানেই বসে বাঁশি বাজাতে লাগল।

একটু পরে ছেলেটা দেখল, তার গরুগুলো সেই দিকেই আসছে। কি আশ্চর্য! ভাবনাটাও তো তাদের মধ্যে রয়েছে। এবার ছেলেটার মুখে হাসি ফুটল। দু'হাত দিয়ে বাঁশিওয়ালার গলা জড়িয়ে, তার দু গালে চুমু দিয়ে বলল তুমি কি ভালো জানো আমার কি ভয় করছিল ওই বনে কত বাঘ সিংহ আছে যদি ধবলী তাকে মেরে ফেলত তাহলে কি হত? আচ্ছা বাঁশিওয়ালা তুমি আমাকে ওইরকম বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দাও না। তাহলে আমি সময়মতো আমার গরুগুলোকে ডেকে আনতে পারব।

বাঁশিওয়ালা বলল, যদি শিখতে চাও নিশ্চয়ই তোমাকে শিখিয়ে দেব। শুধু গরু কেন ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া এমনকি বাঘ, সিংহ, হাতি, কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর সবাইকে বাঁশি বাজিয়ে কাছে আনতে পারবে। তোমার ভালোবাসার মানুষ কেউ পারবে।

ছেলেটা অবাক জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি সেরকম করতে পারো? লোকটা উত্তর দিল, পারি বৈকি। তাহলে শোনো, আমি সব মানুষকে ভালবাসি। সবার ভালো চাই। কিন্তু যখন সেই মানুষগুলোই শয়তানি করে তখন তাদের শিক্ষা দেবার জন্য কঠোর শাস্তিও দিই। যেমন দিয়েছিলাম, সেই শহরের লোকগুলোকে।

ছেলেটা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল সেখানে?

লোকটা উত্তর দিল, একটা শহরে হঠাৎ প্রচুর ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছিল। কোথা থেকে এল কে জানে? কিন্তু শহরের সব জায়গাতেই ইঁদুর আর ইঁদুর। জামা কাপড় কেটে দিচ্ছে, খাবারে মুখ দিচ্ছে। চাল-গম রাখা যাচ্ছে না। বড়ো ইঁদুরেরা আবার বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শহরের বাসিন্দারা ইঁদুরের অত্যাচারে নাজেহাল। বহু রকম চেষ্টা করল, কিন্তু ইঁদুর আর কমে না!

অবশেষে তিতিবিরক্ত হয়ে পৌরপ্রধান ঘোষণা করলেন, যদি কেউ সেই ইঁদুরগুলোকে শহর তারা করতে পারে তাহলে কুড়ি হাজার সোনার মোহর পুরস্কার দেওয়া হবে। আমি তখন সেখানে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, টাকার থেকে বড়ো কথা মানুষগুলোকে  স্বস্তি দেওয়া। কাছে গিয়ে বললাম, আমি তোমাদের শহর থেকে ইঁদুর তাড়িয়ে দিতে পারি। শুনে তারা তো একেবারেই আহ্লাদে গলে জল। বলল, এক্ষুনি এক্ষুনি।

আমি আমার বাশিঁতে ইঁদুর সম্মোহনী সুর বাজাতে শুরু করলাম। সব ইঁদুর পালে-পালে আমার পিছনে-পিছনে চলতে লাগল। শহরের পাশে একটা নদী ছিল। আমি সেই নদী পার হয়ে গেলাম। আমার পিছনে আস্তে, আস্তে সব ইঁদুরগুলো নদীতে পড়ে ডুবে মরে গেল। আর শহরটাও ইঁদুর মুক্ত হয়ে গেল।

ছেলেটা একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, কুড়ি হাজার সোনার মোহর! সে তো অনেক। তাহলে তুমি এখানে এই পুরোনো জামাকাপড় আর ছেঁড়া ঝুলি নিয়ে কি করছো?

লোকটা বলল, সেটা আর পেলাম কোথায়? লোকগুলো ভীষণ পাজি। আমাকে খালি কাল এসো, পরশু এসো বলে ঘোরাতে লাগল।

তারপর একদিন বলল তুমি এমন কিছু কাজ করোনি, যে তোমাকে কুড়ি হাজার মোহর দিতে হবে। তোমাকে কুড়িটা মোহর দিলেও অনেক বেশি দেওয়া হয়। তাই নিয়ে তুমি বিদায় হও।

শহরটাতে ছোটো ছেলেমেয়েদের মনোরঞ্জনের কোন ব্যবস্থা নেই।

ভেবেছিলাম ওই টাকাগুলো দিয়ে শহরের মাঝখানে একটা সুন্দর বাগান বানাবো। যেখানে সব ছোটোরা খেলতে পারবে। আমিও ওদের সঙ্গে খেলব। কিন্তু যখন টাকাগুলো পেলাম না, তখন ঠিক করলাম ওই বদমাসগুলোকে এমন কঠিন শাস্তি দেবো যে আর কোনদিন কথার খেলাপ করবে না। আবার আমার বাঁশি বের করলাম। এবার বাঁশি বাজাতে ওই শহরের সব বাচ্চাগুলো যাদের ৬ মাস থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বয়স, সবাই আমার পিছনে-পিছনে চলতে আরম্ভ করল। ছ'মাসের বাচ্চারা হামাগুড়ি দিয়ে, এক বছরেরগুলো হেলে-দুলে আর বড়োগুলো তো নেচে নেচেই  আমার পিছনে চলতে লাগল। বাচ্চাগুলোকে আমি একটা পাহাড়ের গুহার ভেতর নিয়ে গিয়ে গুহার দরজাটা একটা বিশেষ সংকেত দিয়ে বন্ধ করে দিলাম।

ছেলেটার চোখে একটু মজার ভাব ঝিলিক দিয়ে উঠল। তারপর কী হল?

লোকটা বলল, যখন বাচ্চাদের মায়েরা জানতে পারল, কেন আমি তাদের বাচ্চাদের নিয়ে গেছি তারা দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে গেল।

ছেলেটা বলল, ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো তো নিজেরা কিছুই করতে পারেনা। ওদের মা এদেরকেও নিয়ে এসেছিল কি?

লোকটা বলল, গুহাতে নিয়ে আসার পর আমার খেয়াল হল যে লোকগুলোর উপর রাগ করে বাচ্চাদের তো নিয়ে আসলাম। কিন্তু ওদের কী দোষ! ওদের খাওয়াবো কি! পড়াবো কি! আর ওদের দেখাশোনাই বা কি করে করবো! অনেক ভেবেচিন্তে ভালো করে চেয়ে দেখলাম, ওরা তো বাচ্চা নয় এক-একটা  রত্ন। সোনার টুকরো, হীরের টুকরো, কত রকমের মণিমাণিক্য। তাই ওদের আমি বাঁশি বাজিয়ে সেইসব রত্ন বানিয়ে রেখে এসেছি ওই গুহার মধ্যে।

বলতে বলতে লোকটার চোখ দুটো স্বপ্নীল হয়ে ওঠে। ও বলে, চলে এক-একসময়ে এক-একটা রত্নকে আমি আবার বাঁশি বাজিয়ে জীবন্ত করে দেব। সে তখন মানুষের ভালোর জন্য, মানুষের শান্তির জন্য, বা মানুষের জীবন আরো সরল এবং উন্নত করার জন্য কাজ করবে। কেউ মানুষকে জানাবে ওই কদম গাছ থেকে কদমফুলটা কেন মাটিতে পড়ে। কেউ মানুষকে ওই পাখিটার মতো আকাশে ওড়বার কোনো কল বানিয়ে দেবে। কেউ মানুষের জন্য এমন যন্ত্র তৈরি করবে যা দিয়ে সে বহুদূরের কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে। কেউ অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার জন্য নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করবে। কেউ শান্তির বাণী ছড়াবে, কেউ আবার মানুষকে কর্মযোগী হবার শিক্ষা দেবে। এইরকম কত মানবকল্যাণ ব্রতী তৈরি হবে তার কোনো হিসাব নেই।

কিন্তু যদি কোন মানুষ অসৎভাবে অন্যদের সাথে শঠতা করে, সব লোকের দুঃখ দেয় তাহলে সৃষ্ট লোকেদের বাঁচাতে এবং অসুস্থ লোকেদের উচিত শাস্তি দিতে আমি তখন আমার বাশি অন্য ভাবে  বাজাবো।

ছেলেটা বলল তোমার এই বাণী আমি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব। তোমার কাছ থেকে আমি এই বাঁশি বাজানো শিখতে চাই।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১৪

 

Topic : রূপকথার গল্প, ছোটোদের গল্প, ছোটোদের পত্রিকার গল্প, বাঁশিওয়ালার গল্প, শেখার গল্প, Fairy tales, Children stories, flutist story, Learning stories  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ